ঢাকা | শনিবার
২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৬ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কর্মযজ্ঞে মুখর মাতারবাড়ী

কর্মযজ্ঞে মুখর মাতারবাড়ী

পর্যটন নগরী কক্সবাজার শহর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে মহেশখালী উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন মাতারবাড়ী। এই এলাকাতেই দেশের বৃহৎ ১২০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চলছে কর্মযজ্ঞ। সঙ্গে কয়লা আমদানির জন্যও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজও চলছে। যা হবে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর। তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র ও সমুদ্রবন্দরের চারপাশে নির্মিত হচ্ছে পাওয়ার হাউস, কোল ইয়ার্ড, সাবস্টেশনসহ বহুমুখী অবকাঠামো।

তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকায় সরেজমিনে গত ৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে দিয়ে দেখা যায়, হাজারো শ্রমিকের কর্মচাঞ্চল্যে মুখর প্রকল্প এলাকা। দেশি–বিদেশি প্রকৌশলীরা কাজের তদারকি করছেন। প্রকল্পের উত্তর–পশ্চিম পাশে তৈরি হয়েছে দুই হাজার ১৫০ মিটার লম্বা পাথরের বাঁধ। এর পাশে ১৪ কিলোমিটারের গভীর চ্যানেল। চ্যানেলে নোঙর করা প্রকল্পের মালামাল নিয়ে আসা চারটি জাহাজ। জেটি দিয়ে জাহাজের মালামাল খালাস হচ্ছে।

চ্যানেলের পাশে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি কোম্পানির কার্যালয়, কর্মকর্তা–কর্মচারী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের থাকার ডরমেটরি। দেখা যায়, প্রায় ৯-১০ হাজার শ্রমিক-কর্মকর্তা ও প্রায় দেড় হাজার বিদেশির সমন্বয়ে রাতদিন কাজ করে মেগা প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ৬০০ মেগাওয়াট করে দুটি ইউনিটে বিভক্ত। এই মেগা প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫১ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড। কাজের অগ্রগতি ৬৭ শতাংশ। আগামী আড়াই বছরের মধ্যে বাকি কাজ শেষ হলে এ প্রকল্প থেকে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ হবে জাতীয় গ্রিডে।

তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের পাশেই হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর। আর এ বন্দরের মালামাল পরিবহনের জন্য তৈরি হচ্ছে ২৬ কিলোমিটার রেলপথ। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে স্থানীয় লোকজনের কর্মসংস্থান হবে, ঘটবে ব্যবসা- বাণিজ্যের প্রসার- স্থানীয় লোকজন এমনটাই স্বপ্ন দেখছেন।

সূত্রমতে, মাতারবাড়ীর ১৬০০ একরের পরিত্যক্ত লবণমাঠে গড়ে উঠছে তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের এ মেগা প্রকল্প। প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন প্রকল্প এলাকায় আসছেন কর্মযজ্ঞ দেখতে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ দৃশ্যমান হওয়ায় এলাকার জমির দামও বেড়ে যাচ্ছে।

মাতারবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম আবু হাইদার বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার ভিত্তিক এ মেগা প্রকল্প আমাদের গর্ব। এ উন্নয়নের মহাযজ্ঞে পাল্টে যাবে এলাকার দৃশ্যপট।

প্রকল্পের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাপানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সুমিতমো করপোরেশন, তোশিবা করপোরেশন ও আইএসআইয়ের তত্ত্বাবধানে ১৭টি দেশের অন্তত ১১৪০ জন বিদেশি নাগরিক এই তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পে কাজ করছেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রথম ইউনিটে ৬০০ মেগাওয়াট এবং একই বছরের জুলাইয়ে দ্বিতীয় ইউনিটে আরও ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বরাদ্দ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা দিচ্ছে ২৮ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। অবশিষ্ট টাকা বাংলাদেশ সরকারের।

এ প্রকল্প নিয়ে কথা হয় মাতারবাড়ীর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এলাকার দেড় হাজারের বেশি একর জমি আমরা প্রকল্পের জন্য দিয়েছি। এর একটিই কারণ- উন্নয়ন। এখনো অনেকে অধিগ্রহণের টাকা পায়নি মামলা জটিলতার কারণে। দ্রুত মামলা প্রক্রিয়া শেষ করা গেলে আমাদের কষ্ট অনেকটা লাগব হবে। ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের ৪২ প্রকারের ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিলেও বাস্তবায়ন স্বপ্ন হয়ে আছে।

শিক্ষক মোহাম্মদ আলী বলেন, গভীর সমুদ্রবন্দরের দিকে তাকিয়ে আছি সবাই। কিছুদিন আগে সংবাদপত্রে দেখলাম ১০০টি জাহাজ ভেড়ার রেকর্ড অর্জন মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরের। এটি হলে মাতারবাড়ীর সঙ্গে সরাসরি চট্টগ্রাম-ঢাকার রেল ও সড়কপথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা পাবে। তবে বন্দর হবে আমাদের মাটিতে। আর এর কর, ভ্যাট সুবিধা পাবে চট্টগ্রাম বন্দর কতৃপক্ষ। অথচ ইউনিয়নের রাস্তাঘাটের বেহাল দশা দেখার কেউ নেই।

সূত্রমতে, আগামীর সম্প্রসারণশীল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে দেশের কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বাড়াতে ১৬ মিটার গভীর আর আট হাজার টিইইউ’স (২০ ফুট দৈর্ঘের কনটেইনার) ধারণক্ষমতাসম্পন্ন কনটেইনার জাহাজ ঢোকার সুবিধা বাড়তে নির্মিত হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর। এর পোতাশ্রয়ে ১৬ মিটার পর্যন্ত ড্রাফটের জাহাজ প্রবেশ করতে পারবে। ফলে সামগ্রিক পরিবহন ব্যয় হ্রাস পাবে আনুমানিক ১৫ শতাংশ।

প্রকল্প বাস্তবায়নে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় গভীর বন্দরটির নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব তহবিল ২ হাজার ২১৩ কোটি এবং বাংলাদেশ সরকারের বরাদ্দ ২ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা।

সংযোগ সড়ক নির্মিত হলেই বাণিজ্যিকভাবে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ শুরু হবে। ২০২৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এ সমুদ্রবন্দর চালু হওয়ার কথা। কোল পাওয়ারের এক কর্মকর্তা বলেন, ৭ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়কের কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের অক্টোবরে। ৩২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ সড়কের কাজ আড়াই বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা যায়নি। এখন পর্যন্ত ৮১ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে।

কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, মাতারবাড়িকে গড়ে তোলা হবে বিদ্যুৎ ও শিল্পোৎপাদন এবং জ্বালানি আমদানির হাব হিসেবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় কয়েকটি মন্ত্রণালয় মিলে ধাপে ধাপে সেখানে বাস্তবায়ন করবে ৬৮টি প্রকল্প। এগুলোর মধ্যে তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, তরলীকৃত প্রাকৃতি গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনালের এসপিএম প্রকল্প, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প অন্যতম। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে এলাকাটি বাণিজ্যিক হাব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। তখন সামাজিক উন্নয়ন যেমন ঘটবে, তেমনিভাবে যাতায়াত ব্যবস্থায়ও আমূল পরিবর্তন হবে। পরিবর্তন হবে মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন।

এদিকে, জাপানের অন্যতম বৃহৎ কোম্পানি জাইকা ২০৫০ সালের মধ্যে ‘কার্বন নিউট্রালিটি’ অর্জনে ধাপে ধাপে কয়লানির্ভর প্রকল্প থেকে সরে আসার পরিকল্পনা নিয়েছে। এর অংশ হিসেবেই মাতারবাড়ির সম্ভাব্য দ্বিতীয় প্রকল্পে তারা না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ইনস্টিটিউট অব এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) জানিয়েছে। এ বিষয়ে সুমিতোমো করপোরেশনের বক্তব্য জানতে তাদের ইমেইল করা হলেও সাড়া মেলেনি।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন