ঢাকা | মঙ্গলবার
২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভরাট তিস্তাই ভয়ঙ্কর

ভরাট তিস্তাই ভয়ঙ্কর
  • হারাচ্ছে নাব্যতা হুমকিতে অববাহিকার জীববৈচিত্র্য

তিস্তার প্রবাহ

  • মোট দৈর্ঘ ৩১৫ কিলোমিটার
  • বাংলাদেশে ১১৩ কিলোমিটার
  • বন্যায় তিস্তা হয়ে পড়ে সাগর

ভারতের সিকিম থেকে ১৭৮৭ সালের দিকে তিস্তা নদীর গতিপথ বদলে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। এরপর লালমিনরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা ছুঁয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিলিত হয়েছে তিস্তা। ৩১৫ কিলোমিটারের এই প্রবাহের মধ্যে নদীটির ১১৩ কিলোমিটার বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অবস্থিত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২৩৫ বছরের প্রবাহমান তিস্তা নদীর সঠিক পরিচর্যা হয়নি। বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নদীর পরিচর্যা করা না গেলে এক সময় তিস্তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। পাশাপাশি নদী কেন্দ্রিক মানুষের আর্থ-সামাজিকতা পরিবেশ বিনষ্ট হবে। ইতোমধ্যে শুষ্ক মৌসুম এলেই তিস্তা অববাহিকায় মানুষের জীবন যাত্রা স্থবির যাচ্ছে। জীব-বৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ছে।

মূলত, এককালের স্রোতস্বীনি তিস্তা অযত্ন অবহেলায় এখন অনেকটাই মৃতপ্রায়। নাব্যতা হারিয়ে দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি আর উজানের অল্প ঢলেই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অববাহিকা। স্থানীয়রা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে বন্যা ও উজানের ঢলে বালু আর পলি পড়ে পড়ে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এতে নদীর গতিপথ বদল হয়ে সীমানা বেড়ে গেলেও গভীরতা কমে গেছে। এতে উজানের সামান্য ঢলেই পনি বিপদসীমা অতিক্রম করছে বার বার।

সূত্রমতে, দুই দফায় ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহের পরিমাপ (গেজ রিডার) সংখ্যাটি পরিবর্তন করেও কোনো কাজে আসছে না। সামান্য ঢলেই তিস্তাপাড়ের ফসলি জমি ও নিম্নাঞ্চলের বসতবাড়ি তলিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে তিস্তা রক্ষার্থে ‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও’ সংগ্রাম কমিটির পক্ষে ইতোমধ্যে ৬ দফা দাবি তোলা হয়েছে।

নদীপাড়ের প্রবীণ মানুষজন বলছেন আমাদের এত প্রশস্ত নদীর প্রয়োজন নেই। মূল তিস্তা এতো প্রশস্ত ছিল না। তিস্তা পলি ও বালুতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদী নাব্য থাকলে প্রশস্ত হতো না। তিস্তায় নাব্য রাখা জরুরি।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রমতে, চলতি বছরে ৫ দফায় তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করে। এর মধ্যে ১৭ জুন, ২০ জুন, ২৯ জুন, ১ আগস্ট ও ১ সেপ্টেম্বর পানি বিপদসীমার ৩১ ও ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। চলতি বছর উজানের বৃষ্টিপাত ও ঢলের সঙ্গে বাংলাদেশ অংশের বৃষ্টিও হয়েছে প্রচুর। এবার অনাবৃষ্টির কথা বলা হলেও দেখা যায় গত বছরের তুলনায় এবার তিস্তা অববাহিকায় অনেক বেশি বৃষ্টিপাতা রেকর্ড করা হয়েছে।

ডালিয়া পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮ মাস ৬ দিনে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ২ হাজার ৪৩৯ মিলিমিটার। অথচ গত বছরে তা ছিল ২ হাজার ৩২৭ মিলিমিটার। এই হিসাবে এখন পর্যন্ত ১১২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত বেশি হয়েছে। যদিও এ বছরের হাতে আরও চার মাস রয়েছে।

গত বছরে ১৯ ও ২০ অক্টোবরে ৪৮ ঘণ্টায় ২৫৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। সেই সঙ্গে উজানের বৃষ্টি ও ঢল যুক্ত হয়ে তিস্তার পানি বিপদসীমার (৫২.৬০) ৬০ সেন্টিমিটার (৫৩.২০) উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। যাতে ফ্লাড বাইপাস বিধ্বস্ত হয়ে যায়। মূলত বাংলাদেশ অংশের তিস্তায় পলি ও বালু ভরাটের কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও’ সংগ্রাম কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী জানান, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বৈঠকে তিস্তা নদীর পানির শতকরা ৩৬ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ এবং ৩৯ শতাংশ পাবে ভারত। বাকি ২৫ শতাংশ নদীপ্রবাহের জন্য নদীতেই সংরক্ষিত রাখা হবে সিদ্ধান্ত হয়। যা এখন সময়ের অপেক্ষা।

অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম আরও বলেন, উজান থেকে শুষ্ক মৌসুমে ভারত গোজলডোবা ব্যারাজের মাধ্যমে পানি আটকিয়ে রাখে। পানির অভাবে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার প্রবাহ খুব একটা থাকে না। আবার বর্ষাকালে পানি ছেড়ে দিলে প্রবল পানির চাপে মূল গতিপথ বদলে তিস্তা প্রচণ্ডভাবে প্রবাহিত হতে থাকে। কারণ তিস্তার তলদেশ ভরাট, অল্প পানিতেই প্লাবিত হয় নিম্নাঞ্চল। তখন কূলকিনারাবিহীন সমুদ্র হয়ে যায় তিস্তা। তখন তিস্তার বাংলাদেশ অংশে এর প্রস্থ কোনো কোনো জায়গায় ৫ কিলোমিটারেরও বেশি হয়ে পড়ে। মূলত, তিস্তার পানির চাপ ও বন্যায় প্রতিবছর উত্তরাঞ্চলের শত শত মানুষ বাড়িঘর, গাছপালা, আবাদি জমি হারিয়ে ভূমিহীন ও ছিন্নমূল হয়ে পড়ছে।

নদী ব্যবস্থাপনায় সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার দাবি জানিয়ে ৬ দফা দাবি জানিয়েছে ‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও’ সংগ্রাম কমিটি। দাবিগুলো হলো- তিস্তা নদী সুরক্ষায় বিজ্ঞানসম্মত মহাপরিকল্পনার দ্রুত বাস্তবায়ন, অভিন্ন নদী হিসেবে ভারতের সঙ্গে ন্যায্য হিস্যার ভিত্তিতে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন, তিস্তা নদীতে সারাবছর পানি প্রবাহ ঠিক রাখতে জলাধার নির্মাণ, তিস্তা নদীর শাখা-প্রশাখা ও উপ-শাখাগুলোর সঙ্গে নদীর সংযোগ স্থাপন ও নৌ-চলাচল পুনরায় চালু করা, ভূমিদস্যুদের হাত থেকে অবৈধভাবে দখল হওয়া নদীর জমি উদ্ধার করা, নদীর বুকে ও তীরে জেগে ওঠা সমস্ত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, তিস্তার ভাঙন, বন্যা ও খরায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা।

এছাড়া নদী ভাঙনের শিকার ভূমিহীন, গৃহহীন, মৎসজীবীসহ নদী ভাঙনে উদ্বাস্তু মানুষের পুর্নবাসনেরও দাবি জানানো হয়। অন্যদিকে, তিস্তা মহাপরিকল্পনায় তিস্তা নদী ও তিস্তা তীরবর্তী কৃষকদের স্বার্থ সুরক্ষায় সমবায় ও কৃষিভিত্তিক করকারখানা স্থাপন এবং মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তিস্তা পাড়ের মানুষদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার দাবিও জানানো হয়।

তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদ্দৌলা প্রিন্স জানান, প্রতিবছর বন্যার সময় উজানের ঢলে নদীতে পলি ও বালু দিয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে নদীর গভীরতা কমেছে এবং প্রসারতা বেড়েছে। ফলে উজান থেকে একটু ঢল নামলেই তিস্তা নদী বিপদসীমা অতিক্রম করছে। আসফাউদ্দৌলা প্রিন্স বলেন, প্রথম পর্যায়ে তিস্তা নদীর ডালিয়া পয়েন্টে নদীর পানি প্রবাহের বিপদসীমার পরিমাপ (গেজ রিডার) সংখ্যাটি ছিল ৫২ দশমিক ২৫ মিটার। যা ২০০৭ সালের ৭ জুলাই পরিবর্তন করে ৫২ দশমিক ৪০ মিটার বৃদ্ধি করা হয়। এরপরেও উজানের সামান্য ঢলে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা বারবার বিপদসীমা অতিক্রম করতে থাকলে নদীর পলি অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তারই আলোকে ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও নদী ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের উদ্যোগ নেয় সরকার।

এ লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ‘ক্যাপিটাল (পাইলট) ড্রেজিং অর রিভার সিস্টেম ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ২০১২ সালের মার্চ মাসে তিস্তার পলি অপসারণের জন্য তিস্তা ব্যারেজের উজানে ৫০০ মিটার ও ভাটিতে তিন হাজার মিটার এলাকায় পলি অপসারণের জন্য ২৩ কোটি ২৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়। চারটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমের ওই সময় পলি অপসারণ করা হলেও পরবর্তি সময় নদী পুনরায় পলিতে ভরাট হতে থাকে।

এ অবস্থায় ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে ভারীবর্ষণে উজানের ঢলে পলিতে ভরাট তিস্তা অববাহিকায় ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। সেসময় নদীর পানি বিপদসীমার ৫২ দশমিক ৪০ মিটার অতিক্রম করে ৫৩ দশমিক ০৫ মিটার অর্থ্যাৎ ৬৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। তাই তিস্তা নদীর বিপদসীমা পরিমাপ সংখ্যাটি দ্বিতীয় দফায় পরিবর্তন করে তা বৃদ্ধির জন্য প্রস্তাব করা হয়।ওই প্রস্তাবে পরিমাপের সংখ্যা করা হয়েছে ৫২ দশমিক ৬০ মিটার। যা ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর হতে কার্যকারিতা করা হয়।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন