ধান, নদী, খালের বরিশালে ঐতিহ্যবাহি কীর্তনখোলা নদীতে একসময় কীর্তনের উৎসব হতো। আবার এই নদীতেই কৃষ্ণলীলার কাহিনি নিয়ে কীর্তনীয়রা গানে গানে মেতে থাকতেন। তবে কীর্তনের সেই উৎসব হারিয়ে গিয়ে এখন পরিণত হয়েছে দখল আর দূষণ উৎসবে। বরিশালে কীর্তনখোলা নদী থেকে শুরু করে জেলার ২৫টি নদীর দুপাড় দখল করে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
আর নেতাদের মদদে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, আইনজীবী, শিক্ষক, শ্রমিকসহ ছোট-বড় সংগঠনের নেতৃবৃন্দও নদী দখলে বড় ভূমিকা রাখছে। বছর যেতে না যেতেই যে যার মতো করে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দখলদারিত্ব বাড়িয়েই চলছে। দখলদারদের দাপটের কাছে অসহায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন।
বরিশাল নদী-খাল বাঁচাও আন্দোলন কমিটির সদস্যসচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, সরকার নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করেছে। যা রক্ষায় কঠোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তবে নদীটির তীরের অবৈধ দখলদার উৎখাতে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বিআইডব্লিউটিএ ও জেলা প্রশাসন। এ কারণে কীর্তনখোলা নদী দখলে সংকুচিত হয়ে গেছে।
কাজী এনায়েত আরও বলেন, কয়েক বছর আগে ধান গবেষণা এলাকায় নদী তীরের অনেক জায়গা দখল করে নির্মিত স্থাপনা জেলা প্রশাসন ভেঙে দিয়েছিল। তবে তখন যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ায় দখলদারেরা ক্রমাগত কীর্তনখোলা গ্রাস করছে। বিআইডব্লিউটিএ ইতোমধ্যে কীর্তনখোলার তীর দখলকারী ৪ হাজার ৩২০ জন অবৈধ দখলদারের তালিকাও করেছে। তবে রহস্যজনক কারণে তাদের উচ্ছেদে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
মূলত, কীর্তনখোলা নদী ঘিরেই গোড়াপত্তন বরিশাল শহরের। নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে নানা কর্মযজ্ঞ। নদীই এখানকার মানুষের প্রাণ। এই নদীকে নির্ভর করে বিশাল জনগোষ্ঠীর আয় ও জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে। প্রতিদিন এ নদীর বুক চিরে চলে কতশত নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার, কার্গো জাহাজ।
তবে সেই কীর্তনখোলা দূষণ-দখলে প্রতিনিয়ত জৌলুস হারাচ্ছে। সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদ থেকে দপদপিয়া সেতু পর্যন্ত নদীর তীরে স্থাপনা তৈরি করে দখল করা হচ্ছে। গত কয়েক বছরে কয়েক হাজার স্থায়ী ও অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ হয়েছে। নগরীর বেলতলা ঘাট সংলগ্ন নদীর জমিতে ডকইয়ার্ড করা হয়েছে। এছাড়া নৌপথে চলাচল করা বিশাল আকৃতির লঞ্চে যাত্রীদের মলমূত্রসহ ময়লা-আবর্জনা নদীতেই ফেলা হচ্ছে। ফলে মারাত্মক দূষণের কবলে নদী।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, নদীর জমি দখল হলেও বিআইডব্লিউটিএর বরিশাল কর্মকর্তারা নীরব ভূমিকা পালন করছেন। তারা বিভিন্ন সময় জরিপ ও দখলদারদের চিহ্নিত করলেও তাদের তালিকা প্রকাশ করেনি। অভিযোগ রয়েছে, তারা দখলদারদের কাছ থেকে মাসোহারা পেয়ে থাকেন। নতুন করে দপদপিয়া সেতুর নিচের মেরিন একাডেমির পাশ দিয়ে জিএসআর নামে একটি কোম্পানি জেটি তৈরির করে দখলের পায়তারা চালাচ্ছে নদীর ভেতরে এমনভাবে দখল করেছে যাতে মনে হবে নদীর অধেক দখল তাদের হাতে চলে গেছে।
নিজের জমি দাবি করে সুরুজ মোল্লা নামে এক ব্যক্তি দখল চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সুরুজ মোল্লা জানান, এটা আমাদের নিজের জমি জি এসআর কোম্পানির কাছে ভাড়া দিয়েছি। নদীর ভেতরের অতিরিক্ত দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা প্রতি মাসে খাজনা দিয়ে আসছি। এরচেয়েও বেশি জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএ অফিসে গিয়ে জানতে পারেন। তারাই আমাদের দখলের অনুমতি দিয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, বরিশাল নগরী ঘিরে রাখা কীর্তনখোলা নদীর নগরীর প্রান্তে আশির দশকে ২৩ একর জমি নিয়ে জেগে ওঠে রসুলপুর চর। এরপর যে দল ক্ষমতায় এসেছে সে দলের প্রভাবশালী নেতাকর্মী ও সমর্থক চর সংলগ্ন নদী দখল করে সৃষ্টি করেছে কৃত্রিম বড় চর। তাদের সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক পরিচয়ধারী প্রভাবশালী নেতারা। ২৩ একর চর এখন ৫০ একরে পরিণত হয়েছে। আর সেখানে বহুতল ভবন থেকে শুরু করে মাছের ঘের, মুরগির ফার্ম, বালুর ব্যবসা, ডকইয়ার্ড এবং ছোট ছোট ঘর করে তা ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এমনকি প্লট আকারে বিক্রি করা হচ্ছে সেখানকার জমিও।
অভিযোগ রয়েছে, বরিশাল নগরঘেঁষা কীর্তনখোলা নদীর প্রায় এক কিলোমিটার তীর দখল করে ডকইয়ার্ড গড়ে তোলা হয়েছে। উচ্ছেদের পর দেড় বছর ধরে চলছে এই দখল। তবে দখল বন্ধে প্রশাসন নির্বিকার। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। তারা বলছেন, কীর্তনখোলার চিহ্নিত চার হাজারের বেশি দখলদার উচ্ছেদে টালবাহানা করছে বিআইডব্লিউটিএ ও জেলা প্রশাসন।
বরিশাল স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মো.শহিদুল ইসলাম বলেন, ব্যক্তিগত জমি থাকলেও, আইন অনুযায়ীগ নদী দখল করে জেটি স্থাপনা করা যাবে না। বিআইডব্লিউটিএকে নিয়ে দখলদারদের হালনাগাদ তালিকা করা হচ্ছে।
বরিশাল বিআইডব্লিউটিএ সূত্রমতে, ১৯৬০ সালে বরিশাল নদীবন্দর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কীর্তনখোলা নদীর পানির স্তর থেকে স্থলভাগের দিকে জমির ৫০ গজ পর্যন্ত বিআইডব্লিউটিএ’র। সে অনুযায়ী নৌবন্দরের উত্তর ও দক্ষিণে প্রায় ৩৮ একর জমি বিআইডব্লিউটিএ’র। তবে ওই জমিতে সীমানা প্রাচীর না থাকায় বিভিন্ন সময়ে ভূমিখেকোরা এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা প্রভাবশালীরা দখলে নিয়ে গড়ে তুলেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বসতঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
সূত্রমতে, রসুলপুর চরের ৮ একরেরও অধিক জমি এবং জেলখাল থেকে এপিবিএন দপ্তর পর্যন্ত কীর্তনখোলা তীরের ২৮ একর জমির মধ্যে এক তৃতীয়াংশ এখন বেদখল হয়ে গেছে।
বরিশাল বিআইডব্লিউটি এর যুগ্ম পরিচালক মামুনুর রশীদ বলেন, নগরের আমানতগঞ্জ খাল থেকে রূপাতলী দক্ষিণ পাশ পর্যন্ত ৩ দশমিক ৫৭০ কিলোমিটার কীর্তনখোলার তীর বিআইডব্লিউটিএর। নদীতীরের দিকে ৫০ গজ পর্যন্ত উভয় তীরে ৩৬ দশমিক ৪০ কিলোমিটার ফোরশোর রয়েছে, যার অর্ধেকই বেদখল হয়ে গেছে। নগরীর এবং আশপাশে কীর্তনখোলার দখলদারের সংখ্যা ৪ হাজারের বেশি। এ জায়গা উদ্ধারে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যৌথভাবে জরিপ চলছে।
মামুনুর রশীদ আরও বলেন, কীর্তনখোলা নদী দখলদারদের খসড়া তালিকা তৈরি হয়েছে। এতে ৪ হাজার ২১৯ দখলদারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। জরিপ কমিটির কয়েকজন সদস্য স্বাক্ষর না করায় ওই তালিকা চূড়ান্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।
সরজমিন দেখা দেছে, বর্তমানে যে যার মতো করে এই নদী ব্যবহার করছেন। কেউ নদীর পাড়-সীমানা দখল করে গড়ে তুলছে বিভিন্ন স্থাপনা, কেউ আবার নদীর তীর দখল করে গড়ে তুলছে ইট ভাটা, ইট,বালু, পাথর ও কয়লা বিক্রি কেন্দ্র। এমনকি কীর্তনখোলা নদী ভাঙন রোধে ফেলা জিও ব্যাগ থেকে বালি ও বেড়িবাঁধের জন্য ফেলা ব্লগ নিজেদের দখলের জন্য ব্যবহার করছেন। এছাড়া কীর্তনখোলা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে জেগে ওঠা মোহাম্মদপুর চর, দপদপিয়ার চর, কর্ণকাঠী চর, পলাশপুর চরসহ একইভাবে বৃদ্ধি করা হয়।
প্রশাসনের কঠোরতা না থাকায় চর ছাড়াও বিভিন্ন নদীর তীর দখল করে নির্মিত হচ্ছে পাকা স্থাপনা। যার অন্যতম উদাহরণ সিটি এলাকার মুক্তিযোদ্ধা পার্ক থেকে ত্রিশ গোডাউন এলাকা। অবৈধ ঘর তুলে এখানে বেদখল হয়ে আছে প্রায় ৫ কিলোমিটার পাড় এলাকা।
বরিশাল পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) জেলা সমন্বয়কারী লিংকন বায়েন বলেন, আইন অনুযায়ী একটি নদীর জোয়ারের সময় পানির স্তর থেকে তীরবর্তী ১০ ফুট জায়গাকে ফোরশোর বলা হয়। এই ১০ ফুট এলাকার মধ্যে কেউ কোনোভাবে নদীর তীর দখল বা কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে পারবে না, যদি ওই জমি কারোর নিজেরও হয়ে থাকে।
লিংকন বায়েন আরও বলেন, কীর্তনখোলা নদী এ অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকা এবং যাতায়াতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে এবং নদীর তীর দখলমুক্ত রাখতে সকল ধরনের অবৈধ স্থাপনা অবিলম্বে গুঁড়িয়ে দেয়ার দাবি তিনি।
বরিশাল নগরীর বিভিন্ন খাল ও ড্রেন থেকে কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য আর লঞ্চের ময়লা-আবর্জনা ফেলে কীর্তনখোলা নদীর পানিকে করা হচ্ছে বিষাক্ত। পাশাপাশি নিয়মিত ড্রেজিং না করায় নদীতে দেখা দিয়েছে নাব্যতা সংকট। সব মিলে দখল-দূষণ-নাব্যতা সংকটের ব্যর্থতায় অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে কীর্তনখোলা নদী।
২০১৯ সালের ২৩ মে বরিশালে অবৈধভাবে দখল হওয়া নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়-জলাধারের তালিকা চেয়ে বরিশালের জেলা প্রশাসক বরাবরে চিঠি প্রেরণ করেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান। এরপর দখলদারদের তালিকা তৈরি করে পাঠানো হয়েছে। ছোট-বড় মিলে দেশে নদীর সংখ্যা দুই সহস্রাধিক। অথচ নদী দেখভাল করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো মন্ত্রণালয় নেই।
নদীর অংশবিশেষের সঙ্গে যুক্ত এখানের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। নদী রক্ষায় তাই এই মন্ত্রণালগুলোর কার্যকর সমন্বিত উদ্যোগ আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। নদীর সামগ্রিক কাজের তদারকির জন্য একক কোনো মন্ত্রণালয় না থাকায়, সমন্বয় করে করে নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনার কাজ করতে হয়। যে কারণে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নদীগুলো।
বরিশাল জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বরিশালে এক হাজার ৭৩৬ দখলদার চিহ্নিত করা হয়েছে। এরই মধ্যে ২০৮ জনের স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। চার একর সরকারি খাসজমি উদ্ধার করা হয়েছে।
বরিশাল জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার জানান, চিহ্নিত দখলদারদের উচ্ছেদে বরিশালের ১০ উপজেলায় অভিযান চলমান। কীর্তনখোলা নদীর দখলদারদের তালিকা চূড়ান্ত করতে পারেনি বিআইডব্লিউটিএর বরিশাল কার্যালয়। তাদের ধীরগতি ও উদাসীনতার কারণে কীর্তনখোলায় অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
আনন্দবাজার/শহক