প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে চারদিনের সরকারি সফরে ভারতে অবস্থান করছেন। তাঁর সফর ঘিরে কূটনৈতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নানা আলোচনা, পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ চলছে। তারই অংশ হিসেবে দু’দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক অর্থনীতি, বাণিজ্য, আন্তঃসীমান্ত নদী, অবকাঠামো উন্নয়ন ও রাজনৈতিক বিষয়ে কূটনীতিক ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে বিশেষ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে দৈনিক আনন্দবাজারে। আজ ৬ষ্ঠ পর্ব- দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে গতি।
ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য সম্পর্ক শুরু হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে ১৯৭২-৭৩ সালে। যদিও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধটি পরিচালিতই হয়েছিল ভারত থেকে। সেই যে প্রাণের টান তা অব্যাহত রয়েছে বিগত ৫০ বছরে। বাংলাদেশের তিন দিকে ঘিরে থাকা ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। দেড়শ কোটি মানুষের দেশটির সঙ্গে আমদানি-রপ্তানিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বাংলাদেশ।
২০১৯-২০ সাল থেকে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের পঞ্চম দেশ। আর আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান দেশ ভারত। কৃষিজাত পণ্য, ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, কেমিক্যাল, গার্মেন্ট এক্সেসরিজ, কম্পিউটার, স্পোর্টস আইটেম, হস্তজাত শিল্প, সফটওয়্যার, কসমেটিকস, পোল্ট্রি ইত্যাদিসহ হাজারো পণ্য ভারত থেকে বাংলাদেশে আমদানি করা হয়ে থাকে।
এ ব্যাপারে হোয়াইফা এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার শারমিন আক্তার জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানটি ভারত থেকে লেডিস আইটেম, মেশিনারিজসহ বিভিন্ন পণ্য ভারত থেকে আমদানি করে থাকে। তাছাড়া অন্যরাও তাদের এলসিতে ভারত থেকে পণ্য আমদানি করতে পারে। তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়ায় খুব কম খরচে পণ্য আমদানি করা হয়। সময়ও কম লাগে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ১৯৭২-৭৩ সালে ৩৪৮ কোটি টাকা রপ্তানির মাধ্যমে ভারতের বাজারে ঢোকে বাংলাদেশ। ১৯৯০-৯১ সালে বাংলাদেশ-ভারতে পণ্য রপ্তানি করে ১৭১৮ কোটি টাকার, আর আমদানি করে ৩৫১১ কোটি টাকার অর্থাৎ বাণিজ্যঘাটতি ১৭৯৩ কোটি টাকা (৪৮.৯৩ ভাগ)। ২০২০-০১ সালে রপ্তানি হয় ৬৪৬৭ কোটি টাকার, আমদানি ছিল ৯৩৬৩ কোটি টাকা আর বাণিজ্যঘাটতি ২৮৯৬ কোটি টাকা (৬৯.০৭)।
২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ৩৮ হাজার ৭৫৮.৩১ কোটি টাকার, আমদানি ছিল ৫৪ হাজার ৪০২.৬০ কোটি টাকা, বাণিজ্যঘাটতি ১৫ হাজার ৬৪৪.২৯ কোটি টাকার (৭১.২৪)। ১৯৯০-৯১ সালে বাণিজ্যঘাটতি ছিল ৪৮.৯৩ শতাংশ আর ২০২০-২১ অর্থবছরে তা ৭১.২৪ শতাংশে দাঁড়ায়।
২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ৫২ হাজার ৮২.৬৬ কোটি টাকা, আমদানি হয় ৭৮ হাজার ৮০.২০ কোটি টাকা ও বাণিজ্যঘাটতি ২৫ হাজার ৯৯৭.৫৪ কোটি টাকা (৬৬.৭০)।
অভিষেক সিকদার নামের এক ব্যবসায়ী জানান, নারীদের পোশাকের প্রায় ৭০ ভাগ ভারতীয়। খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে পিঁয়াজ, চাল, রসুন, আদা, চকলেট ইত্যাদি। মোটরসাইকেল, স্কুটার, অটো রিক্সা: দেশে প্রায় ৯৫ শতাংশ অটো ভারতীয়, ৭০-৮০ শতাংশ বাইক, তারমধ্যে বাজারের ৫৬ শতাংশ দখলে, সুজুকি, ইয়ামাহা, টিভিএস, আর সিএনজি অটোরিকশা মহেন্দ্র আলফা সবই ভারতের তৈরি। তা ছাড়া ট্রাক্টর এবং ট্রাকের বাজার টাটা, আইশার, অশোক লেইল্যান্ড, মহেন্দ্র, ফোর্স উল্লেখযোগ্য। টাটা কোম্পানির ট্রাক বন্ধ করে দিলে পণ্য পরিবহন ৬০ শতাংশ বন্ধ হয়ে যাবে।
দ্য পলিসি টাইমসের তথ্যমতে, আগামীতে যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও চীনকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম রপ্তানির দেশ হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি বছরের মে মাসের বৈদেশিক লেনদেনের হিসাব মতে, ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ৬ হাজার ১৫২ কোটি ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এটি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৯ মাসে ৪ হাজার ২৭৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি।
সিনিয়র সাংবাদিক কলামিস্ট ফারাজী আজমল হোসেন তার একটি নিবন্ধে দাবি করেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ২০১৭-১৮ সালের তুলনায় ২০১৮-১৯ সালে রেকর্ড ৫২ শতাংশ বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। গত এক দশকে দেশ দুটিতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদারে পরিণত করেছে। আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্ভাবনা ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, কোভিড-১৯ মহামারির পরে নতুন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, যা থেকে উত্তরণের জন্য ভারত-বাংলাদেশ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে কম্প্রিহেন্সিভ ইকোনোমিক পার্টনারশিপ এগরিমেন্ট-সিইপিএকে। বিশ্বের সমস্ত বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান, যেমন ইউএনসিটিএডি, ডব্লুইটিও, আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক এরই মধ্যে জানিয়েছে, খাদ্য ও জ্বালানিসহ পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈশ্বিকভাবে বাণিজ্য এবং প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্নিত হয়েছে। আর এ কারণেই বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি হবে। এমন এক সময়ে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশ-ভারত উভয়ের জন্য দুর্দান্ত এক বার্তা বয়ে আনতে সক্ষম।
ভারতের সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কম্প্রিহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট-সিইপিএ/সেপা চুক্তি করতে চায় বাংলাদেশ। গতকাল বুধবার দিল্লিতে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেন, সেপা অবশ্যই হবে ভারতের সঙ্গে, তবে কিছুটা সময় লাগবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটি করতে চায় বাংলাদেশ।
আনন্দবাজার/শহক