ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যৌথ রেলপ্রকল্পে ঢিমেতাল

যৌথ রেলপ্রকল্পে ঢিমেতাল
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে চারদিনের সরকারি সফরে ভারতে অবস্থান করছেন। তাঁর সফর ঘিরে কূটনৈতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নানা আলোচনা, পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ চলছে। তারই অংশ হিসেবে দু’দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক অর্থনীতি, বাণিজ্য, আন্তঃসীমান্ত নদী, অবকাঠামো উন্নয়ন ও রাজনৈতিক বিষয়ে কূটনীতিক ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে বিশেষ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে দৈনিক আনন্দবাজারে। আজ পঞ্চম পর্ব- যৌথ রেলপ্রকল্পে ঢিমেতাল।

বাংলাদেশের রেলপথ উন্নয়নে বড় স্বপ্নের বড় বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে ভারত। তবে স্বপ্ন বড় হলেও অর্থছাড়ে বড় অবদান নেই। বড় বড় সাতটি প্রকল্প এখন অনেকটাই গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম খুলনা হতে মংলা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের কাজ। যার ৯৫ দশমিক ৫০ শতাংশের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। আর কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশনের পুনর্বাসন প্রকল্প করা হয়েছে মাত্র ২৫ দশমিক ৪১ শতাংশ। তৃতীয় আরেকটির কাজ শেষ হয়েছে ৬৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। অন্য আরেকটির কাজ শেষ হয়েছে ২৫ দশমিক ৪১ শতাংশ আর অর্থছাড় করা হয়েছে মাত্র ২০ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। বাকি তিনটি প্রকল্পের কাজ তো শুরুই করা হয়নি।

ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের সূত্রমতে, বাংলাদেশের ৪২টি প্রকল্পে ভারত ৭ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। যার মধ্যে শুধু রেলওয়ের ১৭টি প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে ২ বিলিয়নের বেশি ডলার। প্রকল্পগুলোর মধ্যে এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ১৪টির কাজ শেষ হয়েছে। ভারতীয় রাষ্ট্রীয় ঋণ লাইন অব ক্রেডিড-এলওসির আওতায় ৬টি ও ভারতীয় সরকারের অর্থায়ন প্রকল্প ১টিসহ মোট ৭টি রেলওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে। প্রথম ৬টিতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১২ হাজার ৭৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা। ভারতীয় সরকারের অর্থায়ন প্রকল্প একটি সেখানে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় একশ ৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছর পর্যন্ত ভারত অর্থছাড় করেছে ৮৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, অর্থাৎ ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। অপর একটিতে কোনো বরাদ্দই দেয়নি। বাংলাদেশ সর্বমোট অর্থছাড় করেছে ১ দশমিক ৩১ শতাংশ।

খুলনা-মংলা প্রকল্প
খুলনা হতে মংলা (বাগেরহাট জেলার উপজেলা মংলা) বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, রেলপথ নির্মাণ, রূপসা রেলসেতু নির্মাণ ও সিগনালিং এই তিনটি প্রকল্প ছিল। সেখানে রেলপথ নির্মাণ ও রূপসা রেলসেতু নির্মাণের যাবতীয় কার্যক্রম ৯৫ দশমিক ৫০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। অচিরেই সিগনালিংয়ের বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর হবে। এটি ভারতের বিনিয়োগে হচ্ছে।

সূত্রমতে, প্রথম লাইন অব ক্রেডিড-এলওসির প্রকল্প খুলনা-মোংলা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজের অগ্রগতি আগস্ট পর্যন্ত হয়েছে ৯৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। ২০১০ সালে ৬৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণে ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকার প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়। দুই দফায় বেড়ে তা দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ রেলওয়ের এক কর্মকর্তা দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, খুলনা হতে মংলা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ভারতের ২ হাজার ৯৪৮ লাখ টাকা বিনিয়োগের কথা ছিল। সেখানে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত অর্থছাড় হয়েছে ২ হাজার ৪২৯ লাখ টাকা। বাংলাদেশ দিয়েছে এক হাজার ১৫৬ লাখ টাকা। সর্বোচ্চ অর্থছাড় ও কাজ এই প্রকল্পেই হয়েছে। ভৌত অবকাঠামোতে ৯৫ দশমিক ৫০ শতাংশ ও আর্থিক ছাড় ৮৪ দশমিক ১৫ শতাংশ টাকা।

কুলাউড়া-শাহবাজপুর প্রকল্প
বাংলাদেশ রেলওয়ের কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশনের প্রকল্পটি এলওসির আওতায় প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৬৭৮ কোটি টাকা। সেখানে ভারতের অংশ ৫৫৫ কোটি টাকা। প্রকল্পটিতে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত দিয়েছে ১৩৫ কোটি টাকা, অর্থাৎ ২০ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।

প্রকল্প পরিচালক মো. সুলতান আলী কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, এই প্রকল্পে ৪৪ কিলোমিটারের কাজ রয়েছে। তাতে ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ২৫ দশমিক ৪১ শতাংশ। তাছাড়া ঠিকাদারের কারণে কাজের গতি ধীর। রেলভবন সূত্রে জানা যায়, কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশনের পুনর্বাসন (প্রথম সংশোধিত) লাইন অব ক্রেডিড-এলওসি ১ জুলাই ২০১১ হতে ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ সালে শেষ হওয়ার কথা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এডিপি বরাদ্দ করা হয় ২২ কোটি টাকা।

ঢাকা-টঙ্গী প্রকল্প
ঢাকা-টঙ্গী সেকশনের তৃতীয়, চতুর্থ ডুয়েল গেজ লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর ডুয়েল গেজ লাইন নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১২ সালে শুরু হয়ে ২০২৩ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত এখানে ভৌত ৬৪ দশমিক ২৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সর্বমোট আর্থিক ছাড় হয়েছে ৬৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ। প্রকল্পে ভারতের অংশগ্রহণ ৯২৬ কোটি বাংলাদেশ সরকার-জিওবির ২০৪ কোটি টাকা। ২০২২ সাল পর্যন্ত ভারত অর্থছাড় করেছে ৬২১ কোটি ও বাংলাদেশ ৯২ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে প্রকল্পটির পরিচালক নাজনীন আরা কেয়া দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আমরা জয়দেবপুর থেকে বনানী পর্যন্ত কাজ সমাধা করে ফেলেছি। এখন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কারণে কিছুটা স্থবির। সেই কাজ এগিয়ে গেলে আমরা আবার শুরু করতে পারবো। এখানে সবমিলে ৬০ কিলোমিটারের মতো রেলপথ রয়েছে। ২০২৩ সালে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সেটি সম্ভব হবে না। কেননা করোনাকালে কাজ বন্ধ ছিল। তাতে গতি কিছুটা কমে গেছে।

খুলনা-দর্শনা প্রকল্প
খুলনা-দর্শনা (চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলায় অবস্থিত দর্শনা) জংশন সেকশনে ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি শুরু হয়ে চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তবে এই প্রকল্পটি শুরুই করা হয়েছে ৪ বছর পরে। গত ২৫ আগস্ট পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ৫৬ কোটি টাকা। তার মধ্যে ভারত ২ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা ও বাংলাদেশ ৮১৬ কোটি টাকা। এসব অর্থের মধ্যে এক পয়সাও ছাড় করেনি ভারত।

পার্বতীপুর-কাউনিয়া প্রকল্প
দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলা হতে রংপুর জেলার কাউনিয়া উপজেলা পর্যন্ত মিটারগেজ রেলওয়ে লাইনকে ডুয়েলগেজে রুপান্তর করতে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি শুরু হয়ে চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তবে এই প্রকল্পটিও শুরু হয়েছে ৪ বছর পরে। গত ২৫ আগস্ট পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রকল্পটিতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। তাতে ভারত ১ হাজার ৩৬৭ কোটি ও বাংলাদেশ ৩১৫ কোটি টাকা। এই প্রকল্পেও কোন অর্থছাড় দেয়নি দেশটি।

বগুড়া-সিরাজগঞ্জ প্রকল্প
বগুড়া জেলার শহিদ এম মনসুর আলী স্টেশন, সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত নতুন ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ কাজটি ১ জুলাই ২০১৮ সালে শুরু হয়ে আগামী বছরের ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্পে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৫ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা। সেখানে ভারতের অংশ ৩ হাজার ১৪৬ ও বাংলাদেশের ২ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা। সেখানে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ভারত দিয়েছে ৫৫৭ কোট টাকা ও বাংলাদেশ ২১৭ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে কাজ হয়েছে ৪ দশমিক ৯০ শতাংশ।

প্রকল্পটির ভৌত অবকাঠামো কাজ হয়েছে ৪ দশমিক ৯ শূন্য শতাংশ ও অর্থছাড় শূন্য দশমিক ১৪ শতাংশ। এলওসির এসব প্রকল্পে মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১৬৮১৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। তাতে ভারতের বিনিয়োগ বা ঋণ ১১ হাজার ৬১০ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর বাংলাদেশের অংশ ৫ হাজার ২০৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত মোট অর্থছাড় হয়েছে ৪৪৪৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর ভারত অর্থছাড় করেছে ৩ হাজার ১৭৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ও বাংলাদেশ ১ হাজার ২৬৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন