দেশে তৃতীয় লিঙ্গের উদ্যোক্তা, সমাজের সুবিধা বঞ্চিত উদ্যোক্তা, প্রতিবন্ধী ও রাখাইনসহ সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোগ (এসএমই) খাতের আওতায় ঋণ প্রদান করার নির্দেশনা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক সার্কুলারে গত ২০১৫ সালের ১০ জুন এমন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সুফল প্রান্তিক পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের মাঝে পৌঁছে দেয়ার জন্য দেশে প্রথম নীতিমালার আওতায় ঋণ বিতরণের এমন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সেই নির্দেশনার বিষয় মাথায় রেখে নিয়মিত ঋণ বিতরণের প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়ে আসছে। তবে সেসব ঋণগ্রহিতার তালিকায় লাখ লাখ নারী-পুরুষ থাকলেও নেই তৃতীয় লিঙ্গের কেউ। হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের উদ্যোক্তারা ব্যাংকঋণের সেই সুবিধা থেকে গত প্রায় আট বছর ধরেই বঞ্চিত হয়ে আসছেন। তবে ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনাগ্রহের কারণেই তাদের মাঝে ঋণ বিতরণ করা যাচ্ছে না। যদিও হিজড়া সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন, ব্যাংকের নানা জটিল নিয়মের কারণে ইচ্ছে থাকা সত্বেও তারা ঋণ নিতে পারছে না। নিয়মের ভেড়াজালে আটকে আছেন তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চের (ত্রৈমাসিক) প্রতিবেদন বলছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ১১ লাখ ৫১৯ জনের মাঝে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ২৬ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে বর্তমানে তৃতীয় লিঙ্গের যে ১২ হাজার ৬২৯ জন রয়েছেন তাদের কারো নামই টেকসই অর্থায়নে ঋণগ্রহীতার তালিকায় নেই।
টেকসই অর্থনীতিতে বলা হয়েছে আর্থিকখাতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় পরিবেশগত, সামাজিক ও সুশাসন (ইএসজি) বিষয়কে বিবেচনায় নেওয়ার কথা। আরো বলা হয়েছে, সমাজে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক কার্যক্রম এবং ব্যবসায়িক নৈতিকতার মানগুলো রক্ষার দিকেও নজর দেয়ার কথা। সমাজের সব শ্রেণিপেশার মানুষকে বিচেনায় রেখে ঋণ বিতরণের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ খাতে সমাজে পিছিয়ে পড়া নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে।
তবে কোনো উদ্যোগই নিতে দেখা যাচ্ছে না তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) জনগোষ্টির ক্ষেত্রে। কোনো প্রচারণাও চোখে পড়ছে না। যে কারণে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হলেও এর বাইরে থেকে যাচ্ছে এ জনগোষ্ঠি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতি তথ্য বলছে, বিগত সময়ের মতো এবারও ঋণশূন্য এ জনগোষ্ঠি।
ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যাংকখাতে ১০ লাখ ৯১ হাজার ৮৯২ জনের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে ২৫ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭ লাখ ৯৮ হাজার ৫৩০ জন পুরুষ এবং ২ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬২ জন নারী। এ খাতে কোনো হিজড়াকে ঋণ দেয়া হয়নি কিংবা তারা নেননি। এদিকে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ৮ হাজার ৬২৭ জনের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে ৮৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক হাজার ৫২৫ জন পুরুষ এবং ৭ হাজার ১০২ জন নারী। আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও কোনো হিজড়াকে ঋণ দেয়া হয়নি কিংবা তারা নেননি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমরা যে টেকসই অর্থনীতির কথা বলছি তা সবাইকে নিয়েই বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশের জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য একটা অংশ হিজড়া। তাদের কেউ ভিক্ষা আবার কেউ চাঁদাবজি করে জীবন ধারন করে। তাদের এ পথ থেকে ফেরানোর বিকল্প নেই। স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে তাদের ঋণ সম্পর্কে অবগত করতে হবে। তাহলেই তার ঋণ নিতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। তাহলেই সামনের বছরগুলোতে ব্যাংকের জন্য টেকসই অর্থায়নের লক্ষ্যমাত্রা আর ও বৃদ্ধি পাবে।
প্রতিবেদনে গ্রাম-শহরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঋণগ্রহীতার শীর্ষে রয়েছে গ্রাম। গ্রামে ঋণ নিয়েছেন ৮ লাখ ২২ হাজার ৯০০ জন। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ৮ লাখ ১৫ হাজার ৫৮২ জন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়েছেন ৭ হাজার ৩১৮ জন। শহরের ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়েছেন ২৭৬ হাজার ৩১০ জন। আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এক হাজার ৩০৯ জন। এখানে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে মোট ঋণ গ্রহীতার সংখ্যা ২ লাখ ৭৭ হাজার ৬১৯ জন। এর আগে ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত করা ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, তখন ঋণ বিতরণ করা হয়ছিলো ৩৩ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। পেয়েছিলেন ১১ লাখ ২৫ হাজার ২৪ জন। তবে সেই তালিকাতেও নেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ।
পদ্মপুরি হিজড়া সংঘের সহ-সভাপতি মিতু আপা দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আমাদের মাঝে যে ঋণ বিতরণের কথা বলা হচ্ছে তা অনেক জটিল। অনেকেই ঋণ নেয়ার জন্য ব্যাংকে গিয়েছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিতে পারেননি। ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণের বিপরীতে নানা ধরনের কাগজ চায়। তারা জমির দলিল চায়। এমনকি এলাকা থেকে একজন জামানতদারও চায়। সমাজে আমরা এমনিতেই বৈষম্যের শিকার, আমাদের জামানতদার কে হবেন? এত এত নিয়মের বেড়াজালে আমাদের আটকে দেয়া হচ্ছে। সরকার যদি ঋণের সিস্টেম সহজ করে দেয় তাহলে আমাদের জন্য ভালো হয়।
প্রচারণার অভাব, নাকি আগ্রহ দেখাচ্ছে না? এমন প্রশ্নের জবাবে বেসরকারি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, প্রচারণা নেই বললে ভুল হবে। তবে খুব বেশি যে প্রচারণা হচ্ছে তাও কিন্তু না। আমরা প্রচারণা চালাচ্ছি। উদ্যোক্তা তৈরিরও চেষ্টা চালাচ্ছি। কিন্তু তাদের কাছ থেকে সাড়া পাচ্ছি না। এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে এই জনগোষ্ঠি থেকে একজনও ঋণ নিতে আসেনি। তাছাড়া দক্ষতা দেখে ঋণ বিতরণ করা হয়। কিন্তু এই জনগোষ্ঠি ঋণ নিয়ে কাজে লাগানোর মতো দক্ষ না। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এদের দক্ষ করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় তাহলে আমরা সে উদ্যোগ বাস্তবায়নে কাজ করে যাবো।
হিজড়াদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করা দাওয়াতুল কোরআন মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আবদুর রহমান আজাদ বলেন, আমার এ জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করছি। বোর্ডের মধ্যমে তাদের পরীক্ষা দেয়ানো হচ্ছে। সরকার কিংবা ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাদের স্বাবলম্বী করার জন্য ঋণ বিতরণে আগ্রহ দেখিয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমন কেউই যোগাযোগ করেনি। সারাদেশে আমাদের ৩৮টি শাখা রয়েছে কোনোটাতেই কেউ অর্থায়ন করার আগ্রহ দেখায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, দেশের প্রতিটি ব্যাংকে নির্দেশনা দেয়া আছে নারী এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে ঋণ বিতরণের জন্য। প্রতিমাসে অন্তত একজন নারী উদ্যেক্তার পাশাপাশি যেন তৃতীয় লিঙ্গ থেকেও উদ্যোক্তা তৈরির চেষ্টা করার নির্দেশনা দেয়া আছে। তবে বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে যাদের উদ্যোক্তা বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, তারা আসছে না। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি পিছিয়ে পড়া এই মানুষগুলোকে এগিয়ে নেয়ার। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো সভা কিংবা সেমিনারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।
আনন্দবাজার/শহক