ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ওরা দল বেঁধেছে একা

ইন্টারনেটের ভয়ঙ্কর ছোবল

গতিময় পৃথিবীতে প্রযুক্তি ছাড়া সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এ প্রযুক্তি অন্যভাবে আমাদের সম্পর্কগুলোকে শেষ করে চলেছে। কমেছে মানুষের কাছে মানুষের গুরুত্ব। সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে এখন মানুষ তার নিজের পকেটে থাকা ফোনটাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বিশেষ করে যুব সমাজের মধ্যে এ সমস্যা প্রকট। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকাটা যুব সমাজের কাছে এক ধরনের নেশায় পরিণত হয়েছে।

এক সঙ্গে ৮ থেকে ১০ জন বন্ধু আছে কিন্তু কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছেন না। সবাই নিজ নিজ ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন চিত্র এখন শহর বা গ্রামের সবখানেরই চোখে পড়ে। তারা রাতদিন ব্যস্ত ইন্টারনেটে নানানমুখি বিনোদন খুঁজতে। ইন্টারনেট আসক্তি এমন শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরেও নেতিবাচক পড়ে। হচ্ছে বিপদগামী।

কংক্রিটে ঘেরা শহরের জীবনে অনেক আগে থেকেই ইন্টারনেট আসক্তিতে পড়েছে মানুষ। এখন ইন্টারনেট আসক্তির নেতিবাচক প্রভাব গ্রামেও বিস্তার লাভ করেছে। গ্রামের যুবকরাও মাঠ ছেড়েছে। হাতে তুলে নিয়েছে মোবাইল। আঙুলের ছোঁয়ায় পেয়ে যাচ্ছে সারাবিশ্ব। বিকেল হলেই গ্রামের অনেক জায়গায় যুবকদের জটলা চোখে পড়ে। এক সঙ্গে সবাই আছে কিন্তু কারো সঙ্গে কারো কথা নেই। সবাই ব্যস্ত নিজের হাতে থাকা মোবাইল ফোন নিয়ে।

দিনে দিনে খেলাধূলার কথা ভুলেই যাচ্ছে যুবকরা। মোবাইলে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগের সাইট নিয়ে পড়ে থাকছে সব সময়। ভারতের এইচওডি সাইক্রিয়াট্রি অ্যান্ড চিফ ন্যাশনাল ড্রাগ ডিপেনডেন্স ট্রিটমেন্ট সেন্টার (এনডিডিটিসি)। সেখানকার বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, কিশোর ও যুবকদের মোবাইল ফোন ও কম্পিউটারে আসক্তি বাড়ছে। তা থেকে তারা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে। শিশুরাও এ সমস্যার মধ্যে পড়েছে।

ইন্দো-এশিয়ান নিউজ সার্ভিস আইএএনএসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মানসিক সমস্যার প্রাথমিক উপসর্গ হচ্ছে অন্য শিশুদের সঙ্গে মেলামেশা ও কথাবার্তা বন্ধ করে দেয়া ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করা।

রাজশাহীর পবা উপজেলার ভালাম ভবানীপুর এলাকার শিক্ষক সোহেল রানা জানান, সমস্যাটি দিনে দিনে বাড়ছে। এখন গ্রামের ছেলেদের মধ্যেও এ আসক্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগে যুবকরা আড্ডা-হাসিতে মেতে থাকতো। কিন্তু এখন আর তা দেখা যায় না। এখন যুবকরা এক সঙ্গে হয় ঠিকই কিন্তু কেউ কারো সঙ্গে কথা বলেন না। মেতে থাকেন হাতের মোবাইল নিয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়ে দিচ্ছে তারা মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে।

শিক্ষক সোহেল রানা জানান, বিদ্যালয়গুলোতেও এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। ক্লাসে শিক্ষার্থীরা মনোযোগ হারাচ্ছে। পাঠদানে মন থাকে না শিক্ষার্থীদের। ক্লাসের ফাঁকে যখনই সুযোগ পায় শিক্ষার্থীরা তখনই মোবাইলের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এই ইন্টারনেন্ট আসক্তি কিশোর ও যুব সমাজকে ক্ষতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

শুরু কিশোর ও যুবারা নয়। শিশুদের মধ্যেও মোবাইল আসক্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাজশাহী মহানগরীর বালিয়াপুকুর এলাকার ৬ বছরের শিশু নুহা। শিশু নুহার মোবাইল আসক্তি আড়াই বছর বয়স থেকেই। মোবাইল না হলে খাওয়া ছেড়ে দেয় শিশু নুহা। এমনভাবেই কয়েক বছর পার হয়। সম্প্রতি সময়ে নুহার চোখের সমস্যা দেখা দিয়েছে।

নুহার পিতা বাবুল হোসেন জানান, শহরে খেলাধূলার জায়গা কম। সেই সঙ্গে করোনাকালিন সময়ে শিশুদের বাহিরে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। শিশুরা ঘরে থাকতে থাকতে অনেকেই মোবাইলের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে ইন্টানেটের প্রয়োজন আছে। কিন্তু প্রয়োজনের চাইতে অতিরিক্ত সময় ইন্টারনেটে সময় কাটানো বিপদজনক। কিশোর-যুবারা মোবাইলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পড়ে থাকতে পছন্দ করছে বেশ।

ভার্চুয়াল দুনিয়ায় অতিরিক্ত সময় কাটানোর ফলে কিশোরেরা বাস্তব থেকে দূরে থাকতে শুরু করে। তারা একটি কাল্পনিক জগতে ঘুরে বেড়ায়। নতুন প্রজন্ম এ নিয়ে নানান সমস্যার মুখে পড়ছে। ইন্টারনেন্ট আসক্তির কারণে তাদের মধ্যে সৃজনশীলতার ঘাটতি দেখা দিয়েছে, শারীরিক অক্ষমতা দেখা দিচ্ছে, রাতে ঘুম না হওয়া, ঘাড়ের ব্যথাসহ নানান সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছে।

এদিকে দেশের কিশোর ও যুবকরা উগ্রবাদে জড়িত হওয়ার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, ইন্টারনেট তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি অত্যাধিক ঝোঁক। সম্প্রতি রাজশাহী মহানগরীতে সহিংস চরমপন্থা প্রতিরোধে (পিভিই) নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে আয়োজিত কর্মশালায় এ তথ্য জানানো হয়।

কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র-১ ও ১২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সরিফুল ইসলাম বাবু জানান, যুব সমাজ ভুল পথে পরিচালিত হলে নাগরিক স্বাধীনতা ও জননিরাপত্তা বিনষ্ট হয়, সমাজে সম্প্রীতি নষ্ট হয়, দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পর্যটন শিল্প, বিদেশি বিনিয়োগ, শিক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতি বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ বিদেশে নিজ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সর্বোপরি মানব জীবন ধ্বংস হয়। আমাদের সবাইকে এ বিষয়ে সর্তক থাকতে হবে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন