ঢাকা | মঙ্গলবার
২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দূষণের মহাবিপদে সমুদ্র

দূষণের মহাবিপদে সমুদ্র

পৃথিবী ধ্বংসে মানবসৃষ্ট যত কারণ নিয়ে আমরা আলোচনা করি তার মধ্যে অন্যতম সমুদ্র দূষণ। বিশ্বের নদীগুলো যে হারে দূষিত হচ্ছে তারই বড় প্রভাব হিসেবে গত কয়েক দশক ধরে সমুদ্র দূষণ ভয়াবহ হয়ে উঠছে। অথচ বিজ্ঞানীরা বলে আসছিলেন, জনসংখ্যাভারে নুয়ে পড়া পৃথিবীর খাদ্য চাহিদা পূরণে সমুদ্রই হয়ে উঠতে পারে আগামীর বড় ভাণ্ডার। বিজ্ঞানীদের সেই আশা একেবারেই নিরাশায় পরিণত হচ্ছে দিন দিন সাগর যেভাবে দূষণে মরতে শুরু করেছে।

বিগত ২০১৫ সালের একটি গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, সমুদ্রে জমে উঠেছে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক। বিপুল পরিমাণ এই প্লাস্টিকের ৮০ শতাংশই সাগরে এসেছে স্থলভাগের বিভিন্ন উৎস বিশেষ করে শহরগুলো থেকে নদীনালার মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে। দূষণের এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে প্লাস্টিকের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ৬০০ মিলিয়ন টনে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাগর মূলত দিন দিন প্লাস্টিকের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে।

অথচ অতল রহস্যের সাগর নিয়ে আমরা কতটা গবেষণা করেছি। মহাসাগরে প্রতিটি কোণায় কোণায় আমাদের দৃষ্টি পড়েছে। সমুদ্রকে সীমাহীন সম্পদের ক্ষেত্র হিসেবে মনে করছি। আগামীর নীল অর্থনীতির নানা স্বপ্ন দেখছি এই সাগরকে নিয়েই। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে, সমুদ্র দূষণ প্রতিরোধে মানবজাতি একেবারেই উদাসীন। আর উদাসীনতার কারণেই গত কয়েক দশক ধরে সাগর দূষণের মাত্রা জ্যামিতিক হারে বাড়ছেই। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য দাবি করছেন, মানুষ যে ইচ্ছাকৃতভাবে সমুদ্র দূষণ করছে তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। বরং সভ্যতার উৎকর্ষতার পেছনে ছুটতে গিয়ে চরম খামখেয়ালিপনাও দায়ি এর জন্য।

বিশ্বব্যাপী সমুদ্র দূষণের বিপদের বাইরে নয়, আমাদের বঙ্গোপসাগর। আমাদের স্থলভাগের চেয়েও বড় বঙ্গোপসাগরের ওপর নির্ভরশীল দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ। তবে যে হারে দূষণ ঘটছে তাতে খুব বেশিদিন লাগবে না এই নীল অর্থনীতির সম্ভাবনার ক্ষেত্রটি ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে উঠতে। গবেষকরা বলছেন, গেল কয়েক বছর ধরে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে তিমি, ডলফিনের মৃতদেহ যে হারে ভেসে আসছে তাতে সমুদ্র যে ইতোমধ্যে মহাবিপদের বার্তা দিচ্ছে তা সহজেই বোঝা যায়। এমন পরিস্থিতি ঠেকাতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সমুদ্র নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সমুদ্র সংক্রান্ত জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে হবে সবার মধ্যে। পাঠ্যপুস্তকেও বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, উপকূল এলাকায় কয়েক বছর ধরে মাঝে মাঝেই ভেসে আসছে বৃহদাকার মৃত তিমি ও ডলফিন। যা নয়ে রিতিমতো তৈরি হচ্ছে উদ্বেগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে প্লাস্টিক দূষণ অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। যে কারণে মারা যাচ্ছে তিমি-ডলফিনসহ নানা ধরনের সামদ্রিক প্রাণী। নিউইয়র্কভিত্তিক ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটি বলছে, গত দুই বছরে দেশের বিভিন্ন সাগর উপকূল ও নদীপথে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে ৬১টি ডলফিন ও ৬টি তিমি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম বিভাগে।

সমুদ্র বিজ্ঞানীরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরে প্রতিনিয়ত দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মাছের পেটে মিলছে প্লাস্টিক পণ্য। যে কারণে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে কমে আসছে মাছের প্রজাতি। এমনকি বিলুপ্তির পথে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য। দেশি-বিদেশি সমুদ্র বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বঙ্গোপসাগরে প্লাস্টিক বর্জ্য দূষণ বন্ধ না হলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যেই গতকাল শনিবার কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে ভেসে এসেছে বিশালাকৃতির একটি মৃত তিমি ও ডলফিন। বেলিন প্রজাতির তিমির দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট ও প্রস্থ ৬ ফুট। সকালে জোয়ারের পানিতে সৈকতের ঝাউবাগান পয়েন্টে মাছটি ভেসে আসে। তিমিটি অর্ধগলিত অবস্থায় রয়েছে। বর্তমানে সৈকত এলাকায় পঁচা দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

মৃত তিমি নিয়ে কৌতুহল আর আলোচনার মধ্যেই গতকাল দুপুরের দিকে সৈকতে পাঁচ ফুট দৈর্ঘ্যের অর্ধগলিত মৃত একটি ডলফিন ভেসে আসে। ডলফিনটি দেখতে পান স্থানীয় এক যুবক। স্থানীয়রা জানান, ডলফিনটির শরীরের চামড়া অনেকটা উঠে গেছে। মাংস অনেকটা ক্ষয়ে গেছে। বন বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে এটির নমুনা সংগ্রহ করে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে।

ডলফিন রক্ষা কমিটির সদস্য রুমান ইমতিয়াজ তুষার জানান, এটি দেখতে অনেকটা দৈত্যাকৃতির। এর আগে ২০১৮ সালে সৈকতে বড় আরও একটি তিমি ভেসে এসেছিলো। তবে ঠিক কী কারণে এসব তিমি মারা যাচ্ছে সেটা বলা যাচ্ছে না।

এর আগে গত আগস্টের শুরুতে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ভেসে এসেছিল অসংখ্য বড় বড় মরা জেলিফিশ। একেকটি জেলিফিশের ওজন ছিলো ১০ থেকে ১৫ কেজি। সপ্তাহখানেক পর তা আর দেখা যায়নি। কিন্ত তার ঠিক এক মাস যেতে না যেতেই কক্সবাজার সৈকতের উপকূলে ফের ভেসে এসেছিলো অসংখ্য বড় বড় মরা জেলিফিশ। জেলিফিশগুলো আটকে পড়ে সৈকতের বালিয়াড়িতে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের নদীগুলোর দূষণ ভয়াবহ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে নদী আর জলাশয়গুলো এখন প্লাস্টিক আর পলিথিনের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এসব কারণে কম মাত্রার বন্যাও ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। মূলত বন্যার পানিতে ভেসে সব প্লাস্টিক আর পলিথিন গিয়ে পড়ছে সাগরে। দূষণ ঘটাচ্ছেন সাগরের পানির। মারা যাচ্ছে অসংখ্য জলজপ্রাণি। সমুদ্রের বাস্তুসংস্থান ধ্বংস হচ্ছে।

হিসাব বলছে, নদীপথে বঙ্গোপসাগরে ঢুকছে ৩০০ ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য। আর সমুদ্রগামী জাহাজের তেল দূষণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন নদ-নদী দিয়ে ভেসে যাওয়া টনকে টন প্লাস্টিক বর্জ্য হজম করছে বঙ্গোপসাগর। যে হারে দূষণ বাড়ছে তাতে সাগরের বিশাল এলাকা অর্থনৈতিকভাবে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, এখনই এ ব্যাপারে সচেতন না হলে হুমকিতে পড়বে সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা।

গত দুবছর আগে বঙ্গোপসাগরের ওপর ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একদল গবেষক নানা অনুসন্ধান চালায়। এ সংস্থাটির জীববৈচিত্র্য-বিষয়ক গবেষক জেনা জ্যামবেক ও হিথার কোল্ডে তাদের দল নিয়ে পদ্মা নদী থেকে সাগরের প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার এলাকায় নানা জরিপ চালায়। বঙ্গোপসাগর থেকে হিমালয় পর্যন্ত চালানো জরিপে সাগরের প্লাস্টিক বর্জ্যরে ভয়াবহ চিত্র তারা তুলে ধরেন।

জরিপ শেষে গবেষক দলের উপনেতা হিথার কোল্ডেওয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কাছে উল্লেখ করেন, বঙ্গোপসাগরের দূষণে প্রধান ভূমিকা রাখছে প্লাস্টিক বর্জ্য। প্রতি বছর প্রায় ৯০ লাখ টন প্লাস্টিক পণ্য নদীতে গিয়ে পড়ে। এসব পণ্য ভেসে ভেসে সাগরে গিয়ে পড়ছে

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান বলেন, বঙ্গোপসাগরের দূষণ যে পর্যায়ে গেছে তাতে আর স্বচ্ছ পানি নজরে পড়ে না। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকায় জাহাজ ভাঙার বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের দূষণ, কর্ণফুলীর মোহনা ও বহির্নোঙর জুড়ে তেল দূষণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বঙ্গোপসাগরের বড় অংশই বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। অথচ আমরা বিষয়টির গুরুত্ব দিচ্ছি না। এখন থেকে সচেতন না হলে এই সাগরের দূষণ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছাবে, যখন আর সামাল দেওয়া যাবে না।

জাতিসংঘ পরিবেশবিষয়ক প্রোগামের সমন্বয়ক ড. গোলাম মাহাবুব সরওয়ার বলেন, সামুদ্রিক দূষণ হলো বিষ, যান্ত্রিক অ্যাসিফিক্সিয়া বা অন্যদের দ্বারা বিপুলসংখ্যক সামুদ্রিক জীবের মৃত্যুর প্রত্যক্ষ কারণ। শক্তবর্জ্য এবং ইউট্রোফিকেশন দ্বারা সমুদ্রের উপকূলে দূষিত হওয়ার ফলে বিভিন্ন প্রজাতির অপসারণ বা মৃত্যু ঘটে। দূষিত পানির কারণে সামুদ্রিক মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দূষিত বর্জ্য মাছের পেটে যাচ্ছে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন