ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উত্তরের কৃষিতে সৌরশক্তি

উত্তরের কৃষিতে সৌরশক্তি

উত্তরাঞ্চলে অস্বাভাবিকহারে বৃষ্টি কমে যাওয়া, নদী-জলাধারসহ পানির বিভিন্ন উৎসগুলোর পরিচর্চা না থাকায় কৃষিতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে এ অঞ্চলের কৃষকদের। বিদ্যুতের দাম বাড়ার পাশাপাশি সব খরচ বেড়ে যাওয়ায় এমনিতেই বেকায়দায় পড়েছে চাষিরা। আর এ কারণেই নানা ব্যবস্থায় চাষাবাদে মনোযোগি হয়েছেন তারা।

কৃষিকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে নানা ধরনের সেচযন্ত্র। যার ৯০ শতাংশই ডিজেল ও বিদ্যুৎনির্ভর। তবে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচ বেড়েছে কৃষকের। বৈশ্বিক সংকটের এই সময়ে কৃষিতে খরচ কমাতে সৌরবিদ্যুৎচালিত সেচ ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছেন কৃষকরা। ইতোমধ্যে এর সুফল পেতে শুরু করেছে উত্তরের লাখো কৃষকরা।

বোরো ধান সেচ নির্ভর হলেও এবার আমনেও জমি তৈরি থেকে শুরু করে রোপন পুরোটাই করতে হয়েছে সেচের মাধ্যমে। যদিও আমন বিনা সেচের ধান, তবে এবার বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক বৃষ্টি না থাকায় ডিজেল ও বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্র ব্যবহারে বাধ্য হয়েছেন কৃষক। আর এতেই বেড়েছে উৎপাদন খরচ। চলতি আমন মৌসুমে শুধু সেচেই উত্তরাঞ্চলে কৃষকদের বাড়তি খরচ ৮০০ কোটি টাকারও বেশি।

বর্তমানে দেশে কৃষিতে ব্যবহার হচ্ছে প্রায় ১৬ লাখ ডিজেলচালিত সেচ পাম্প। যেখানে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ টন ডিজেল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যার বাজার মূল্য প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। অপরদিকে শুষ্ক মৌসুমে শুধু ধান চাষে সাড়ে তিন লাখ বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্র দিয়ে ৫৫ লাখ হেক্টর কৃষি জমিতে সেচ দেয়ো হচ্ছে। যেখানে বিদ্যু খরচ হয় ২০০০ থেকে ২২০০ মেগাওয়াট।

সংকট মোকাবিলায় বেড়েছে ডিজেলের দাম। জ্বালানি সাশ্রয়ে চলছে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং। এতে খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। এই বাস্তবতায় উত্তরাঞ্চলের কৃষকেরা আগ্রহী হচ্ছেন সৌরবিদ্যুৎ চালিত সেচ ব্যবস্থায়।

রংপুরের বদরগঞ্চ উপজেলার লোহানী ইউনিয়নের সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে নিরবিচ্ছিন্ন সেচ সুবিধায় পাওয়ায় এখানকার আমন ধানের জমিগুলো হয়েছে সবুজ।

গত ৭ বছর ধরে এই ইউনিয়টিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নের গড়ে উঠেছে সৌরবিদ্যুৎ চালিত সেচ প্রকল্প। একেকটি সৌর প্যানেল থেকে সেচ দেয়া হচ্ছে ১০০ বিঘা জমিতে। কৃষকরা জানান, এই ব্যবস্থায় সেচের জন্য তাদেরকে বিদ্যুৎ কিংবা ডিজেলের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয় না। ফলে সেচ দেয় যার যার প্রয়োজন মতো।

সৌর বিদ্যুতের সুফলভোগী বৃষক তাহাররত আলী জানান, জমিতে যখন সেচের দরকার হয় তখন দেই। বিদ্যুতের কোনো দরকার হয় না। আমরা অনেক সুবিধা পাচ্ছি।

কৃষক রহমত আলী জানান, আমার বয়স এখন ৭৫ বছর। এই সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে গত ৫ বছর থেকে আমি আমার জমিতে সেচ দিচ্ছি। যখন জমিতে পানির দরকার হয় তখনই পানি দিচ্ছি। এতে পানির অপচয় কম হয়। আমার উৎপাদন খরচ আগে যা ছিল এখনো তাই আছে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, ডিজেল ও বিদ্যুৎনির্ভর সেচযন্ত্রের পরিবর্তে সৌরবিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্র ব্যবহার করা গেলে প্রতি বছর দেশে ১৭ হাজার টনেরও বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন কমানো সম্ভব। অন্যদিকে এই পদ্ধতি ব্যবহারে সেচে ১.৮৮ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ পর্যন্ত খরচ কমবে।

রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মহুয়া শবনম জানান, শুধু ইরিগেশনকে ফোকাস না করে আমরা যদি কৃষি ক্ষেত্রে যতো পদ্ধতি আছে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করি তা হলে দেশে বিদ্যুৎ ও ডিজেলের ব্যবহার কমে আসবে। বিদ্যুতের সমাধানে সোলার প্লান একটি ভালো উপায়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম জানান, সৌরবিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্র স্থাপনে কৃষকদের সহযোগিতা করে যাচ্ছে কৃষি বিভাগ। আমরা যদি সারাদেশে সোলার প্লান স্থাপন করতে পারি তা হলে আমরা সেচ খরচ অনেকটা কমিয়ে আনতে পারবো। সোলার একবার স্থাপন করতে পারলে আর তেমন কোন খরচ লাগবে না। এ ব্যাপারে কৃষকদের যেকোন বিষয়ে আমরা সহযোগিতা করতে পারবো।

কৃষি অর্থনীতি গতিশীল এবং জ্বালানির ব্যবহার কমাতে ২০১০ সালে সরকার সারাদেশে ৫০ হাজার সৌরবিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। তবে গত এক যুগে স্থাপন করা হয়েছে মাত্র ২ হাজার ২২৩টি সেচযন্ত্র। যা দিয়ে সেচ দেয়া হচ্ছে ২৮ লাখ হেক্টর কৃষি জমিতে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন