সবজি-কাঁচাপণ্যের দাম দিনদিন বাড়বে, সেটাই এখন স্বাভাবিক। এটাই যেন দেশের অলিখিত নিয়ম। এবারেও যে ব্যতিক্রম হবে না তা সবার জানা। তবে সবজি ও কাঁচা পণ্যের দাম যে আকাশে উড়ার পর আর মাটিতে নামবে না এমন ভাবনা আগে ভাবা হয়নি। যেমনটা হয়েছে এবারের শিম আর কাঁচা মরিচের বেলায়। সপ্তাহের শুরুতেই চড়া দামের তালিকার শীর্ষে জায়গা করে নিয়েছে এই সবজি ও কাঁচা পণ্য। সেই চড়া দামের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে মুরগিসহ ডিমও।
সেই দামে হেরফের হওয়ার আলামত মিলছে না। সপ্তাহের শুরু থেকেই ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে শিম ও কাঁচা মরিচ। সপ্তাহের শেষে এসেও দাপট কমেনি। বরং বাড়ার পাঁয়তারায় এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। অপরদিকে হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে খোলা সয়াবিন ও পামঅয়েল। সপ্তাহ ঘুরতেই খোলা সয়াবিন তেল ও পামঅয়েল কেজিতে ২৫ টাকা এবং ডিমের ডজন প্রায় ৩৫ টাকা বেড়েছে।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়। মূলত, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই চড়া সবজির বাজার। প্রায় সব সবজির দামই কমবেশি বেড়েছে। গত ৫ আগস্ট রাতে দেশে চার ধরনের জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ৪২ থেকে ৫২ ভাগ পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। তার দুই-এক দিন পর থেকেই তার প্রভাব পড়ে রাজধানীর কাঁচাবাজারে।
পাইকারী ব্যবসায়ীরা বলছেন, তেলের নতুন দাম কার্যকরের পর ট্রাকভাড়া বেড়ে যাওয়ায় সবজির কেজিতে প্রায় ২ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। তবে খুচরা বাজারে যেভাবে বেড়েছে এটা রীতিমতো অন্যায়। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, পাইকারি বাজারের তুলনায় খুচরা বাজারের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। প্রতি কেজিতে ৩০ টাকা। বেশকিছু সবজিতে পার্থক্য আরো দ্বিগুন।
আরো তথ্য পাওয়া যায়, শিম ও কাঁচামরিচের সঙ্গে দামের জোট বেঁধেছিল ঢেঁড়শ ও শসা। বাজারে নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে থাকার চেষ্টা করছে। মাঝখানে অবশ্য হঠাৎ দামের লাগাম ঢিলে হয়ে পড়ে। তবে সেটা ছিল সাময়িক। সেই ফাঁকে দামের দাপট কিছুটা কমতে দেখা যায় রঙিন চোখ ধাঁধানো সবজি গাজর।
ব্যবসায়ীরা যুক্তি দিচ্ছেন, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়েছে। সামনে দাম আরো বেড়ে যাবে এমন আভাস দিচ্ছেন বিক্রেতারা। তবে রাজধানীর ব্যবসায়ীদের যুক্তির সঙ্গে কোনোভাবেই মেলে না মফস্বলের ব্যাখ্যা। কৃষি পর্যায়ে যে পণ্য ২০ টাকা কেজি রাজধানীতে এলেই তা বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
সরকারের বিভিন্ন কঠোর তদারকিও নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। এদিকে প্রায় সবজির বাজার আগের সপ্তাহ থেকে গেল সপ্তাহের চড়া দামের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অন্যদিকে মুরগি দাম রয়েছে চড়া। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে শিম ও কাঁচা মরিচ প্রতি কেজিতে বিক্রি হয়েছে আড়াইশ টাকা ওপরে। চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে অন্য সব সবজিও। সেই সময় ৪০ টাকার নিচে মিলছে না কোনো ভালো সবজি।
রাজধানীর কাওরান বাজার, কাপ্তান বাজার, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রায় সব সবজিই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। স্থান ভেদে প্রতি কেজি দামে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। শিমের চড়া দাম প্রসঙ্গে কাপ্তান বাজারের সবজি ব্যবসায়ী মুকুল গাজী বলেন, শিমের মৌসুম না। কিন্তু বাজারে চাহিদা রয়েছে। চাহিদা থাকায় শিমের দাম চড়া। সামনে ২৫০ টাকার ওপরেও প্রতি কেজি কিনে খেতে হতে পারে। তবে মৌসুম বাজারে এই সবজির দাম কমে যাবে।
আরেক ব্যবসায়ী আলী আকবর বলেন, চাহিদার তুলনায় কম কাঁচা মরিচ বাজারে রয়েছে। যেহেতু বাজারে সরবরাহ কম, সেহেতু দাম বেশি এটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে বাজারে কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা। কাঁচা মরিচ প্রসঙ্গে যাত্রাবাড়ী বাজার করতে আসা ক্রেতা সাফিন বলেন, মরিচের দাম অনেক বেশি। গতকাল শুক্রবার প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে প্রায় ২৮০ টাকার ওপরে টাকায়। ঢেঁড়শ ও শসার দাম কমার প্রসঙ্গে কাওরান বাজারের ব্যবসায়ী মোমেন বলেন, কাঁচা বাজারে ঢেঁড়শ ও শসার চাহিদার বেশি। কিন্তু সরবরাহ কম। তাই ঢেঁড়শ ও শসার দাম কিছু বাড়তি। তবে সরবরাহ বাড়লে দাম কমবে।
ক্রেতা জাবির হোসেন তিনটি বাজার ঘুরে একটি মুরগি কিনেছেন। তাতে দামে পার্থক্য পেয়েছেন ৭০ টাকা। তিনি কাঁটাবন বাজারে সোনালী মুরগি কিনতে গেলে বিক্রেতা দাম হাঁকান ৩১০ টাকা কেজি। পাশ্ববর্তী আরেকটি বাজারে ৩৩০ টাকা ও কাঁঠালবাগান বাজারে গিয়ে কিনেন ২৬০ টাকা করে। মাছ কিনেছেন ২৩০ টাকা, পটল ৫০ ও ঢেঁড়স ৫০ টাকায়। আরও বলেন, সব ব্যবসায়ী এখন দুর্নীতিগ্রস্ত। এরা আকাশ-পাতাল দাম হাঁকায় ক্রেতাদের কাছে। আমি তিনটি বাজারে এমন পার্থক্য দেখলাম। সরকারের দাম নির্ধারণ করে দেয়া দরকার।
কাঁটাবন বাজারের মাংস ব্যবসায়ী সাজ্জাদ। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় গরুর মাংস কেজিতে কত বাড়লো? তিনি জানান, বাড়েনি। কেননা কোরবানির ঈদ থেকেই ৭৫০ টাকা করে বিক্রি করছি। এখনো সেই দামই রেখেছি। তাহলে তেলের দাম বাড়ায় ব্যবসা করছেন কী করে জানতে চাইলে বলেন, বিক্রি কমে গেছে। মানুষ মাংসের দিকে বেশি আসতে চায় না। খাসির মাংস বিক্রি করেন ইব্রাহিম। তিনি জানান, খাসির মাংস এক হাজার টাকা কেজি। দাম বাড়েনি। বিক্রিও গেছে কমে।
সেগুন বাগিচা কাঁচা বাজারে রিয়াজ হোসেন বলেন, মুরগির ডিম ডজনে বেড়েছে প্রায় ৪০ টাকা। তাদেরও বিক্রি কম। একই বাজারে গরুর মাংস বিক্রি করেন কামাল। তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার গরু জবাই করেও বিক্রি করতে পারিনি। শুক্রবার কাস্টমার বেশি হবে। সেজন্য দেড় লাখ টাকার গরু কিনে জবাই করেছি। দেখুন, এখনো বেশির ভাগ রয়ে গেছে। কামাল বলেন, মানুষ কোন মতে জীবন পার করতে পারলেই বাঁচে। মাছ-মাংস কেনা পারলে ছেড়েই দিবে। বাজারের যে অবস্থা মানুষের আয়-ব্যয় অনেক পার্থক্য।
শফিকুল ইসলাম পড়ালেখা করেন তিতুমীর সরকারি কলেজে। থাকেন ধানমন্ডিতে। তিনি বলেন, আমি মেসের বন্ধুদের বলি সকালের খাবারটা আরও কম খরচে চালানোর জন্য। কেননা সব বিষয়েই খরচ বেড়ে গেছে। জীবন চালানো হিমশিম খেতে হচ্ছে।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন খোলাবাজার সূত্রে জানা যায়, সয়াবিন তেলের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকায়। বোতলজাত সরিষার তেলের লিটার বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকায়। খোলা সয়াবিন তেল শুক্রবার বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকায়। এছাড়া খোলা সরিষার দাম আগের মতোই ২৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বেড়েছে পাম অয়েলের দামও। গত সপ্তাহে ১৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। শুক্রবার বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকায়। বিভিন্ন বাজার তুলনায় তেলের দামের ভিন্নতা পাওয়া যায়।
কাপ্তান বাজারের ব্যবসায়ী আহসান টিটু বলেন, সরবরাহ কমেছে। বোতলজাত তেল অর্ডার দিয়ে পাচ্ছি না। আরেক ব্যবসায়ী আবদুল মতিন বলেন, বোতলজাত তেল কম সরবরাহ হচ্ছে। সেজন্য ৫ লিটারের বোতল প্রায় ১৫ টাকা বেশিতে বিক্রি করছেন অনেকেই।
খুচরা বাজারে সিমের প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২১০ টাকায়। কাঁচা মরিচের কেজি ২৮০ টাকা। গাজর বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা। ঢেড়শের দাম বেড়েছে কেজিতে ১৫ টাকা। ঢেঁড়শের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। শসা ৭০ টাকা কেজি। শনিরআখড়া সবজি বিক্রেতা জব্বার বলেন, বাজারে সবজির দাম ওঠানামা করছে। তবে আগের তুলনায় দাম বেড়েছে। তেলের দাম বাড়ায় কারণে এ ধরনের বৃদ্ধি বলেও জানান তিনি।
প্রতি কেজি চায়না আদা বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা, রসুন ১২০ টাকা, পেঁয়াজ ৫০ টাকা, আলু ৩০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৪০ টাকা, পেঁপের ২৫ টাকা, করলা ৭০ টাকা, ঢ্যাঁড়শ ৫০ টাকা, ঝিঙা ৪০ টাকা,পটল ৪৫ টাকা, বেগুন ৫০ টাকা, বরবটি ৭০ টাকা, চিচিঙ্গা ৪০ টাকা এবং টমেটোর ১০০ টাকায়।
রুই মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা। তেলাপিয়া, পাঙাশ মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকা। শিং মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা। কৈ মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা। পাবদা মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা। দাম বাড়ার তালিকায় রয়েছে ইলিশও। এক কেজি ওজনের ইলিশের কেজি বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৭০০ টাকা।