উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার খ্যাত শিল্পের শহর বগুড়ায় ফেলনা কাগজের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে ছয়টি কাগজ উৎপাদন কারখানা। যেখানে হাজার কোটি টাকার ব্যবসার পাশাপাশি কর্মসংস্থান হয়েছে অন্তত ১০ হাজার মানুষের। এক সময় যে ফেলনা কাগজ পচে রাস্তা নোংরা হতো, ছড়াতো দুর্গন্ধ, দূষিত হতো পরিবেশ সেই পরিত্যক্ত কাগজই দেখাচ্ছে নতুন সম্ভাবনা। বগুড়ায় উৎপাদিত কাগজের চাহিদা এখন বেশি বেড়েছে রাজধানীতেই। এমন সম্ভাবনায় অনেকেই এই শিল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
বগুড়া জেলা শহরসহ উপজেলা পর্যায়েও সংগ্রহ করা হচ্ছে পুরোনা, পরিত্যক্ত, ফেলনা কাগজ। টোকাই আর ফেরিওয়ালাদের হাত ঘুরে যা চলে যাচ্ছে কাগজ উৎপাদন শিল্পে। সংগ্রহ করা ফেলনা কাগজ দিয়েই তৈরি হচ্ছে নিউজপ্রিন্ট, মোড়কিকরণ শিল্পে ব্যবহারযোগ্য মিডিয়াম ও বোর্ড পেপার।
আজ থেকে প্রায় দুই দশক আগে বগুড়ায় ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের পাশে ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘের (টিএমএসএস) প্রধান কার্যালয়-সংলগ্ন এলাকায় গড়ে ওঠে বিসিএল পেপার মিলস। কাগজ প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিসিএলের সাফল্য দেখে আরও উদ্যোক্তা কারখানা স্থাপন করেন। এরপর পুরতান কাগজ থেকে একে একে বগুড়ায় ছয়টি কাগজ উৎপাদনের কারখানা গড়ে ওঠে।
বিসিএল ছাড়া অন্য কারখানাগুলো শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের ফাঁসিতলায় রাজা পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস লিমিটেড, সদরের এরুলিয়ায় হাসান পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলস্, দুপচাঁচিয়ার তালোড়া বাজারে গড়ে সূচি পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলস এবং কাহালুতে কিবরিয়া পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলস ও আজাদ পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলস। প্রতি কারখানায় গড়ে ৫শ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৪০ শতাংশ নারী রয়েছেন।
কাগজ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতরা জানান, ফেলনা কাগজ এক সময় পচে রাস্ত নোংরা হতো। দুর্গন্ধ ছড়ানোর কারণে রাস্ত দিয়ে হেঁটে যাওয়া দায় ছিল। এখন এসব কাগজই প্রক্রিয়াজাতকরণের ফলে নতুন কাগজ তৈরি হচ্ছে। এতে বিভিন্ন উপজেলার গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকাতেও অর্থনীতির চাকা সচল হয়েছে।
বগুড়া থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে জোগারপড়া এলাকা। নওগাঁ-বগুড়া আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে ২০০৭ সালে আজাদ পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলস গড়ে ওঠে। ৫০ শতাংশ নারী নিয়ে সচল থাকা এই প্রতিষ্ঠানে অন্তত ১ হাজা শ্রমিক কাজ করেন। তাদের মধ্যে নিয়মিত শ্রমিক রয়েছেন ২শ জন। আর দিনমজুর রয়েছেন ৭শ থেকে ৮শ জন।
এই প্রতিষ্ঠানে গত এক যুগ ধরে মহাব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করছেন মোস্তক আহমেদ। তিনি দৈনিক আনন্দবাজারকে জানান, প্রতি মাসে গড়ে ১ হাজার টন কাগজ উৎপাদন হয় আজাদ পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলে। এর মধ্যে নিউজপ্রিন্ট ও মিডিয়াম (মলাট) পেপার রয়েছে। বর্তমানে প্রতি কেজি নিউজপ্রিন্ট কাগজ গড়ে ৫৪, আর মিডিয়াম কাগজ ৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। এই হিসাবে প্রতিটন কাগজের দাম গড়ে ৫০ হাজার টাকা। এই কারখানায় মাসে ৫ কোটি টাকার কাগজ উৎপাদন করা হয়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বগুড়ার ছয়টি কারখানায় বছরে অন্তত এক লাখ ২৫ হাজার টন কাগজ কাগজ উৎপাদন করা হয়। গড়ে প্রতি কেজি মূল্য ৫০ টাকা হলে এই কাগজের দাম হয় ৬২৫ কোটি টাকা। বগুড়ায় কারখানা হলেও এসব কাগজের চাহিদা ঢাকাতেই বেশি। বিশেষ করে মিডিয়াম কাগজ গার্মেন্টসে খুব দরকারি। উত্তরবঙ্গে শ্রমিকের দাম কম হওয়ার কারণে বেশি কারখানায় গড়ে উঠছে। মানুষও এখন গ্রামের দিকে আসছেন।
তবে বর্তমানে এসব কারখানা সচল রাখতে মালিক পক্ষকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে বলে জানান আজাদ পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলসের ব্যবস্থাপক আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, বগুড়ার ছয়টি কাগজের কারখানার মধ্যে দুটি গ্যাসে চলে। অন্যগুলোর জ্বালানি কয়লা আর তুষ। কিন্তু এখন তুষের আগুন চুলার চেয়ে মালিকের পকেটে বেশি জ্বলছে।
কারণ হিসেবে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এক বছর আগে আগে যে কয়লা ১০ থেকে ১২ টাকার টাকা টন ছিল এখন তার দাম বেড়ে ২৩ হাজার টাকা হয়েছে। তুষের দামও বেড়ে ৭ থেকে ১৩ টাকা কেজি হয়েছে। প্রতিটন কাগজ উৎপাদন করতে ৪শ কেজি কয়লা লাগে। তুষ লাগে ৮শ কেজি। কারখানা চলে বিদ্যুতে। সরকার কোনো কারণে বিদ্যুতের ওপর ভর্তুকি তুলে নিলে কারখানা বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না বলে জানান আব্দুর রাজ্জাক।
এর পাশাপাশি ভালো নিউজপ্রিন্ট উৎপাদন খরচ বাড়ার আরও কারণ আছে বলে মনে করেন দুপচাঁচিয়ার সূচি পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলের মালিক সুভাষ প্রসাদ কানু। তিনি বলেন, আগে দেশের কর্ণফুলী কাগজ কারখানায় কাগজ তৈরির কাঁচামাল পাল্প উৎপাদন হলেও এখন বন্ধ রয়েছে। এ কারণে কাগজ তৈরির এ কাঁচামাল বিদেশ থেকে রপ্তারি করা হতো। কিন্তু এখন জাহাজ ভাড়া দেড়গুণ বেড়ে যাওয়ার পাল্প রপ্তানি বাধ্যতামূলকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। এ কারণে দেশীয় এই শিল্পের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ভালো মানের কাগজও তৈরি হচ্ছে না।
গ্যাস সংযোগ না থাকায় কাগজের কারখানাগুলো উঠে দাঁড়াতে পারছে না উল্লেখ করে সুভাষ প্রসাদ কানু আরও বলেন, এক সময় সরকারি বই বিদেশ থেকে ছাপানো হতো। তখন শিক্ষার্থীদের সময়মতো বই দেওয়া সম্ভব হতো না। কিন্তু এখন দেশীয় প্রকাশনাকে উন্নত করা হয়েছে। দেশেই বই ছাপানো হচ্ছে, সময়মতো শিক্ষার্থীরা বই পাচ্ছে। এই বিষয়টি উদাহরণ হিসেবে নিয়ে কাগজ শিল্পকে উন্নয়ন করা হলে বিদেশ থেকে কাগজ রপ্তানি করতে হবে না।
বিগত ২০১৬ সালে বগুড়ার কাহালুতে কিবরিয়া পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলস স্থাপন করা হয়। কাগজ তৈরিতে এই প্রতিষ্ঠান দক্ষ দাবি করে ব্যবস্থাপক নূর হোসেন জানান, ঢাকায় গার্মেন্টসে আমাদের উৎপাদিত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা। কিন্তু সম্ভবনাময় এই শিল্পে এখন অনেক খরচ বেড়েছে। তুলনামূলকভাবে কাগজের দাম বাড়েনি। শ্রমিকদের মজুরিও বেড়েছে।
তবে শ্রমিকেরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে তাদের বেতন একই রয়েছে। আজাদ পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলে শ্রমিক হিসেবে রয়েছেন দুপচাঁচিয়ার বাসিন্দা আঙ্গুরী আক্তার। তিনি জানান, এখানে ১২ ঘণ্টা কাজ করলে ২০০ টাকা পাওয়া যায়। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে এই টাকা দিয়ে কী হয়? নূরজাহান বেগম বলেন, এখানে কাজ করে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এখন তার সংসার কোনোমতে চলে। আর কোনো মেয়ে থাকলে বিয়ে দেওয়ার সামর্থ ছিল না। এখন সংসার চলাই দায়। তবে নারীদের মজুরি ২শ হলেও পুরুষ শ্রমিকরা এখানে ৩শ থেকে সাড়ে ৩শ টাকা পান। পাঁচ বছর আগেও শ্রমিকরা একই বেতন পেতেন বলে জানান।
কাগজ উৎপাদনের কারখানা ছাড়াও বগুড়ায় ছোট আকারে ফেলনা আর টোকানো কাগজ থেকে তৈরি হচ্ছে বোর্ড পেপার। এগুলোকে বোর্ড কাগজ দিয়ে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের মোড়ক, বই বাইন্ডিং, প্যাকিং, মিষ্টির প্যাকেট, বই খাতার কাভারসহ আরও বিভিন্ন পণ্যের মোড়ক।
শহরের নিশিন্দারা, কারবালা, মাটিডালি, কাহালু, তাড়োলা, জয়বাংলা, জয়পুরপাড়া পুরোনা কিংবা টোকানো কাগজ দিয়ে পেপার বোর্ড তৈরির অন্তত ১৮ টি কারখানা গড়ে উঠেছে। এ কাজে অন্তত ৭ হাজার শ্রমিক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন। এ খাতে উদ্যোক্তা সৃষ্টি হচ্ছে। একই সঙ্গে কর্মসংস্থান হচ্ছে নারী-পুরুষের।
ঢাকার একটি কারখানায় শ্রমিককের কাজ করতেন বগুড়ার হাজী আব্দুল আউয়াল। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ১৯৮৩ সালে শহরের কারবালা মোড়ে বোর্ড তৈরির মেশিন স্থাপন করেন। এখন আউয়াল তিনটি কারখানার মালিক। এখানেই কর্মসংস্থান হয়েছে কয়েকশ শ্রমিকের।
সরকারিভাবে কম সুদে ঋণ পাওয়া গেলে এই শিল্প আরও বিকশিত হবে জানিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, বগুড়া শহরে ছোট ছোট আকারে গড়ে ওঠা ১৮টি কারখানায় বছরে গড়ে ৮০ হাজার টন বোর্ড কাগজ তৈরি হয়। প্রতিটন বোর্ড বর্তমান বাজারে বিক্রি হয় ৫০ হাজার টাকায়। এই হিসাবে প্রতিবছর বগুড়ার ছোট ছোট কারখানা থেকে ৪শ কোটি টাকার বোর্ড পেপার বিক্রি হয়।
বগুড়া চেস্বার অব কমার্সের সহসভাপিত মাহফুজুল ইসলাম রাজ বলেন, বগুড়া উত্তরাঞ্চলের প্রধান শিল্পশহর হিসেবে পরিচিত। কিন্তু গ্যাসভিত্তিক কারখানার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অনেকে টিকতে পারছে না। এই বিষয়টি মাথায় নিয়ে কাগজের মতো গুরুত্বপূর্ণ কারখানায় গ্যাস সংযোগ দেওয়া জরুরি।
ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণদান সম্পর্কে জানতে চাইলে বগুড়ার বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) উপমহাস্থাপক একেএম মাহফুজুর রহমান জানান, কাগজ শিল্পের উন্নয়নে উদ্যোক্তা তৈরিতে কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হবে। প্রয়োজনে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা যাবে।
আনন্দবাজার/শহক