রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছিলো বিশ্ববাজারে। এতে বেড়ে যায় জ্বালানি তেলের দাম। বাড়তে বাড়তে ব্যারেল প্রতি তেলের দাম দাঁড়ায় ১৩৯ ডলারে। যার প্রভাব পড়ে দেশের খুচরা বাজারে। আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করতে দেশেও দাম বাড়ায় সরকার। এতে ভাড়া বাড়ে গণপরিবহন থেকে শুরু করে সব ধরণের পন্য পরিবহনে। বেড়ে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পন্যের দাম। তবে গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই বিশ্ববাজারে কমছে জ্বালানি তেলের মূল্য।
গতকাল শনিবার তেলের দাম নেমে দাঁড়ায় ৯০ ডলারেরও নিচে। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন তেলের এমন সুখবর মিলছে দেশের বাজারে তড়িগড়ি করেই দাম বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। দাম ৪২ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়ার পর সকাল থেকে ঢাকার বহু পেট্রোল পাম্প বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তেলের অভাবে প্রায় ৭০ শতাংশ কম গণপরিবহন শহরের রাস্তায় নেমেছে।
এদিকে রেকর্ড পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের মূল্য। এর আগে জ্বালানি তেলের এমন মূল্যবৃদ্ধি দেখেনি বাংলাদেশ। নতুন নিয়মে, ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে লিটার প্রতি ৩৪ টাকা, অকটেন ৪৬ টাকা এবং পেট্রল ৪৪ টাকা।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, গত শুক্রবার অপরিশোধিত তেলের বেঞ্চমার্ক ব্রেন্ট ক্রুডের দাম প্রতি ব্যারেলে ৮০ সেন্ট বেড়েছে। এতে দাম দাঁড়িয়েছে ৯৪ দশমিক ৯২ মার্কিন ডলার। যা আগের শুক্রবারের তুলনায় ১১ শতাংশ কম। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) দাম ব্যারেল প্রতি ৪৭ সেন্ট বেড়েছে। এতে দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৯ দশমিক শূন্য ১ ডলার। যা আগের সপ্তাহের তুলনায় আট শতাংশ কম। এর আগে গত বৃহস্পতিবার ব্রেন্টের দাম ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ কমেছিলো। তখন দাম দাঁড়িয়েছিল ব্যারেল প্রতি ৯৪ দশমিক ১২ ডলার। যা ২১ ফেব্রয়ারির পর থেকে সর্বনিম্ন। আর ডব্লিউটিআইয়ের দাম ২ দশমিক ৩ শতাংশ কমে হয়েছিল ৮৮ দশমিক ৫৪ ডলার। যা ৩ ফেব্রুয়ারির পর থেকে সর্বনিম্ন। অয়েল প্রাইস ডটকম বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দুই ধরনের অপরিশোধিত তেলই এখন ১০০ ডলারের কমে বিক্রি হচ্ছে। ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট অপরিশোধিত তেল ব্যারেল প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৮৮ ডলার ৪৩ সেন্টে। অপরদিকে ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেল বিক্রি হয়েছে ৯৩ ডলার ৯৫ সেন্টে।
ব্লুমবার্গের বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী, গত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের পর এবারই সব থেকে দ্রুত তেলের দাম কমছে। ধারণা করা হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে কোভিড লকডাউনের কারণে তেলের চাহিদা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। ফলে গত ছয় মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসছে জ্বালানি তেলের দাম। ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের দাম এক সপ্তাহেই কমেছে ১০ শতাংশ।
তবে বিপরীত চিত্র বাংলাদেশে। এখানে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে দাম বাড়িয়েছে। কোনো প্রকার আইনের তোয়াক্কা করেনি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, পেট্রোল-অকটেন আমদানী করতে হয় না, তাহলে দাম বাড়ানো হলো কেনো প্রশ্ন জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, সাধারণ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। মুল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ এখন দিশেহারা। এই সময়ে এ দাম বৃদ্ধি কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। জ্বালানি তেলের এই দাম বৃদ্ধি বেআইনি। সরকার কোনো ধরণের আইন মানেনি। এই পরিমাণ মূল্যবৃদ্ধি অন্যায্য, অগ্রণযোগ্য।
শামসুল আলম বলেন, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন অনুযায়ী তেলের দাম বৃদ্ধি করবে কমিশন। কিন্তু কমিশনকে পাশ কাটিয়ে এভাবে দাম বাড়ানো ফৌজদারি অপরাধের শামিল। বিপিসি যদি গণশুনানিতে আসতো তাহলে তাদের হিসেব দিতে হতো। এই পরিমাণ দাম বাড়াতে পারতো না। এটা জনগনের প্রতি জুলুম। হতদরিদ্র মানুষগুলো নিঃস্ব হয়ে যাবে। সরকারের এমন কাণ্ডে আমরা বিস্মিত। আমি খুবই আতংকিত। কি হচ্ছে দেশে? চিন্তা করার মতো ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছি।
বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রমেশ ঘোষ বলেন, জ্বালানির দাম বাড়ানোর এই হার অস্বাভাবিক। মূল্য বৃদ্ধির চাপ যাত্রীদের ওপর বিপুলভাবে পড়বে। দ্রব্যমূল্যের ওপরেও প্রভাব পড়বে। এর আগে এক দফায় জ্বালানি তেলের দাম এতটা বাড়ানোর নজির আছে কি না, তা মনে পড়ছে না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের মতে, জ্বালানি তেলের দাম যে পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে তাতে ভোক্তা পর্যায়ে অসহনীয় ব্যয়বৃদ্ধি ঘটবে। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতিজনিত চাপ এখনও জনগণের ওপর রয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত চাপ আরও বাড়িয়ে দেবে। ব্যয়বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাবে। পাশাপাশি ন্যুনতম জীবনমান ধরে রাখার বিষয়টি আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম. তামিম দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আমার ধারণা, সরকার আইএমএফের ঋণ নেওয়ার জন্য এই বিশাল পরিমাণ দাম বৃদ্ধি করেছে। সম্ভবত আইএমএফের শর্ত ছিল যে, জ্বালানি পণ্যে ভর্তুকি থাকলে তারা ঋণ দেবে না। কিন্তু এক ধাপে প্রায় ৫০ ভাগ দাম বৃদ্ধি কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। অন্যান্য দেশেও তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, তবে এতটা বাড়ানো হয়েছে বলে আমার জানা নেই। বুয়েটের এই অধ্যাপক বলেন, অর্থনীতিতে এর প্রতিঘাত অসহনীয় হয়ে উঠবে। করোনার কষাঘাত ও মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতে দরিদ্র মানুষ সীমাহীন কষ্টের মধ্যে আছে। এর মধ্যে অতিমাত্রায় যে দাম বাড়ানো হলো, তার প্রভাবে নিত্যপণ্যসহ পরিবহনের ভাড়া বাড়বে অনেক। যা কল্পনার বাইরে। সাধারণ মানুষের টিকে থাকা কঠিন হবে।
একই বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, জ্বালানি তেলে দাম বাড়ানো অযৌক্তিক। সরকারের পক্ষ থেকে হয়তো এখন বলা হবে বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে তাই বাধ্য হয়ে বাড়াতে হচ্ছে। তবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম উর্ধ্বমুখী না, বরং নিম্নমুখী। দ্রুত তেলের দাম কমে যাচ্ছে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী তো কয়েকদিন আগেই আমাদের জানিয়েছিলেন, অকটেন পেট্রোল আমাদের কিনতে হয় না, দেশেই উদ্বৃত্ত হয়।
আনু মোহাম্মদ বলেন, জনগণের দুর্ভোগ আর অর্থনীতির শৃঙ্খল বাড়াতেই সরকারের বেশি আগ্রহ এবং আনন্দ। আমার কাছে মনে হচ্ছে সরকার বারবার এটাই প্রমাণ করতে চায়। তা না হলে অনেক ভালো বিকল্প থাকা সত্ত্বেও কীভাবে মাত্র কয়েক মাসের মাথায় এইরকম উচ্চ হারে ডিজেল, পেট্রোল, অকটেনের দাম বাড়ায়? সরকার মনে করে, স্বৈরতন্ত্রী দাপটে তারা যা খুশি তাই করতে পারে! তাই অযৌক্তিকভাবে ডিজেল, অকটেন, পেট্রোলের দাম বাড়ানোর পেছনে সরকারের লোকজনদের লুটপাটে শতচ্ছিন্ন ছালা ভরার রাস্তা তৈরি করছে।
এর আগে বিশ্ববাজারে তেলের দাম যখন অনেক কম ছিল তখন সরকার লাভ করেছিলো ৪৭ হাজার কোটি টাকা জানিয়ে আনু মোহাম্মদ বলেন, গত কিছুদিনে যে লোকসান হয়েছে তার তুলনায় আগের লাভ কয়েকগুণ বেশি। তার মানে সরকার জনস্বার্থ ও অর্থনীতির কথা চিন্তা করলে লাভের টাকার একাংশ দিয়েই এই লোকসান ঠেকাতে পারতো। দাম বাড়ালে যে ভয়াবহ পরিণতি হয় তার কথা চিন্তা করে বহু দেশেই তেল আমদানির ওপর শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু সরকার সেটাও করে নাই।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ালেও বর্তমানে তেলের বাজার নিম্নমুখী। এই সময়ে বাজার পর্যবেক্ষণ না করে, কেবল আইএমএফের প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়নে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক ও গণবিরোধী। অনতিবিলম্বে বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহার করে, পূর্বের মূল্য বহাল রাখার দাবি জানানো হয় বিবৃতিতে।
দেশের তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, এই মুহূর্তে কারখানায় গ্যাংস সংকট চরমে। লোডশেডিংয়ের কারণে জেনারেটর ব্যবহার করতে হয়। জেনারেটরের ব্যবহার বাড়ায় বেশি জ্বালানি তেল ব্যবহার করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পোশাক খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ আমাদের হাতে প্রচুর অর্ডার রয়েছে। বড় অংকের লস দিয়ে এসব অর্ডারের পণ্য উৎপাদন করতে হবে। দেশে পরিবহন ভাড়া বাড়বে, ট্রাক ভাড়া বাড়বে, জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, বাড়বে মুদ্রাস্ফীতি। এসবের সাথে শ্রমিকদের বেতনও বাড়াতে হবে। লস থেকে বেঁচে থাকতে হলে অনেক কারখানা বন্ধ করা ছাড়া কেনো উপায় থাকবে না।
তেলের দাম বৃদ্ধির প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, যতদিন সম্ভব ছিল সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির চিন্তা করেনি। অবস্থার প্রেক্ষিতে অনেকটা নিরুপায় হয়েই কিছুটা সমন্বয়ে যেতে হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সে অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্য পুনঃবিবেচনা করা হবে।
নসরুল হামিদ বলেন, বাংলাদেশে কলকাতার তুলনায় ডিজেলের মূল্য লিটার প্রতি ৩৪ দশমিক শূন্য ৯ টাকা এবং পেট্রোল লিটার প্রতি ৪৪ দশমিক ৪২ টাকা কমে বিক্রয় হচ্ছে। মূল্য কম থাকায় তেল পাচার হওয়ার আশঙ্কা থেকেও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া সময়ের দাবি।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন গত ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই) জ্বালানি তেল বিক্রয়ে (সকল পণ্য) ৮ হাজার ১৪ দশমিক ৫১ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক তেলের বাজার পরিস্থিতির কারণে বিপিসির আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখাতে যৌক্তিক মূল্য সমন্বয় অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
আনন্দবাজার/শহক