শরিফুল ইসলাম অনার্সে অধ্যায়ন অবস্থায় একটি এমপিওভুক্ত হাই স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেন। প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ তাকে পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে চাকরি দেয়ার আশ্বাসে প্রায় ৫ বছর শিক্ষকতা করিয়েছে। দিয়েছে সামান্য হাত খরচ। শুধু আশ্বাস দিয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটিতে নিয়োগের। তবে সেই কথা তারা রাখেননি। শরিফুল ইসলাম পারিবারিক ও সামাজিকভাবে কয়েকটি দেন-দরবারও করেছেন কিন্তু ফলাফল শুন্য। এখন তিনি সরকারি চাকরির জন্য পরীক্ষা দিয়ে বেড়াচ্ছেন।
আরিফা আক্তার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ময়মনসিংহের মুমিনুন্নেসা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে বাংলায় মাস্টার্স করেছেন। পেয়েছেন প্রথম শ্রেণি। অনার্সেও ছিলেন প্রথম। দুটি ফার্স্ট ডিভিশন সার্টিফিকেট নিয়ে চার বছর ধরে চাকরির পেছনে ছুটছেন কিন্তু পাচ্ছেন না।
রায়হানুল ইসলাম নামের এক তরুণ এইচএসসি পাস করে দাঁড়িয়েছিলেন পুলিশের লাইনে, হয়নি চাকরি। সেনাবাহিনীর চাকরির জন্য লাইনে থাকলেও সৌভাগ্যের শিকে ছিড়েনি তার। শফিউল আজম সোহাগ ইলেক্ট্রিক্যালে ডিপলোমা করে ঘরে বসে আছেন। চাকরির কোন আভাস নেই। শরিফুল, আরিফা, রায়হান ও সোহাগ প্রত্যেকেই গ্রামের মানুষ। অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে পড়ালেখা করেছেন, করছেন কিন্তু চাকরির সোনার হরিণ পাচ্ছেন না হাতে। এসব গেল শিক্ষিত তরুণদের অবস্থা।
তবে অশিক্ষিত তরুণদেরও নেই কোন চাকরি, কৃষি কাজ বা অন্যকোন কাজ। এক সময় কৃষির যে মূল্যায়ন ছিল গ্রামে তা এখন নেই। কেননা কৃষি কাজ করলে ব্যয়ের অর্থই উঠে আসে না। ফলে তরুণপ্রজন্ম কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অথচ যথোপযুক্ত কাজ পেলে তারুণরা একটি পরিবার, সমাজ বা দেশের চরিত্রকে পাল্টাতে পারে। সেজন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারণগত মহাপরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসর জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ এর প্রকল্প পরিচালক মো. দিলদার হোসেন বলেন, আমাদের প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের সংখ্যা ৩ কোটি ১৫ লাখ ৬১ হাজার ৮১১; যা মোট জনসংখ্যার ১৯ দশমিক ১১ শতাংশ। ২০১১ সালে তরুণদের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ১৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।
\তিনি বলেন, দেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী জনসংখ্যা ১০ কোটি ৮১ লাখ ৪৬ হাজার ৫৬৯ জন। তাদের মধ্যে শহরে ৩ কোটি ৫৭ লাখ ১২ হাজার ৪২৩ ও পল্লিতে ৭ কোটি ২৪ লাখ ৩৪ হাজার ১৪৬ জন। জনসংখ্যার হার সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে। এখানে ৩ কোটি ১ লাখ ৯৮ হাজার ২২৫ জন। সবচেয়ে কম বরিশাল বিভাগে। সেখানে এ বয়সী মানুষের সংখ্যা ৫৭ লাখ ৬৭ হাজার ৪ জন।
দেশের প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনার কাজে ৯০ শতাংশই তরুণদের ব্যবহার করা হয়েছে। তারা কাজে খুব আগ্রহী ও উদ্দীপক। দিন-রাত তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে। তারুণ্যের এই শক্তিকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি তারা কাজ পাগল। যেকোন ভালো কাজ তাদের দিয়ে করা সম্ভব। আমার বিশ^াস, তাদেরকে যথাযথভাবে কর্মসংস্থান দিলে তারা দেশের উন্নয়নে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখবে। দেশ উন্নতির দিকে যাবে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, দেশের প্রাথমিক ডিজিটাল জনশুমারির প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রায় সোয়া তিন কোটি জনশক্তির একটি হিসেব পাওয়া গেছে যাদের বয়স ১৫ হতে ২৪ বছরের মধ্যে। এই জনশক্তিকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে না পারলে দেশের বড় ধরনের ক্ষতি হবে। কেননা ২০৩০ সাল পর্যন্ত এই জনশক্তিকে মূল কর্মসংস্থানে ঢুকবে। এক্ষেত্রে তাদেরকে ডিজিটালভাবে দক্ষ করতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতি তথা কৃষি যদিও পিছিয়ে গেছে তবে এগ্রিবেইজড ইন্ড্রাস্ট্রি করে তাদের কাজে লাগানো যায়। সরকারের করা ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে তাদের জন্য প্লট ও অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। যাতে তাদেরকে স্বাবলম্বী করা যায়।
২০২২ এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। তার মধ্যে শূন্য থেকে ১৪ বছর বয়সীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ২৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, মোট জনসংখ্যার ৬৫ দশমিক ৫১ শতাশ। আর ৬৫ বছরের বেশি বয়সীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, তরুণ জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ভারতে ৩৫ কোটি ৬০ লাখ, চীনে ২৬ কোটি ৯০ লাখ, ইন্দোনেশিয়ায় ৬ কোটি ৭০ লাখ, যুক্তরাষ্ট্র ৬ কোটি ৫০ লাখ, পাকিস্তানে ৫ কোটি ৯০ লাখ এবং বাংলাদেশে রয়েছে ৪ কোটি ৭৬ লাখ। এই তরুণরাই বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে চলেছে।
২০১৬ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ৪৯ শতাংশ মানুষের বয়স ২৪ বছর বা তার নিচে। আর কর্মক্ষম মানুষ আছে ১০ কোটি ৫৬ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ। জনসংখ্যাতাত্ত্বিক এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বড় সুযোগ এনে দিয়েছে।
প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা (১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী) ১০ কোটি ৫৬ লাখ। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশই কর্মক্ষম। আগামী ১৫ বছরে, অর্থাৎ ২০৩০ সালে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১২ কোটি ৯৮ লাখে, যা মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ। দেশে বয়স্ক বা ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষ ৭ শতাংশ। ২০৩০ ও ২০৫০ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ১২ ও ২২ শতাংশে।
ইউরোপীয় ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)এর ২০১৬ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে শতকরা ৪৭ ভাগ গ্র্যাজুয়েট হয় বেকার, না হয় তিনি যে কর্মে নিযুক্ত এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট হওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। প্রতিবছর বাংলাদেশে ২২ লাখ কর্মক্ষম মানুষ চাকরি বা কাজের বাজারে প্রবেশ করছেন। এই বিশালসংখ্যক কর্মক্ষম মানুষের মাত্র সাত শতাংশ কাজ পাবেন। এর অর্থ হচ্ছে, দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বেকারের তালিকায় নাম লেখাচ্ছেন।
পল্লি কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে টেকসইভাবে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান। যুবশক্তিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ও প্রবীণ অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ দৈনিক আনন্দবাজারের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, তরুণশক্তিই মূল কর্মশক্তি। আমাদের প্রয়োজন তাদেরকে নীতি, নৈতিকতা ও দক্ষতা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। পিকেএসএফ এই কয়েক বছরে আড়াই লাখের বেশি তরুণ-তরুণীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশকে ঋণ দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, তরুণশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে আমাদের দেশের চিত্রই পাল্টে যাবে। তারা প্রণোজ্জ্বল ও কর্ম চঞ্চল।
আনন্দবাজার/শহক