পানি নিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চলে সংকট দিনে দিনে চরমে উঠছে। পাতালের পানি নেমে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টির পানি করছে। উভয় সমস্যায় ভূ-পৃষ্ঠের পানি ভরসাম্যতা হারাচ্ছে। এ ভারসাম্যহীনতার কারণে চাষবাদ নিয়ে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। এরমধ্যেই বরেন্দ্রে নতুন সংকট। পাতালের পানি তোলা হচ্ছে পুকুরের মাছ করার জন্য।
বরেন্দ্র অঞ্চলের খাল, বিল-পুকুরে পানি থাকে না বছরের বেশিরভাগ সময়। তারপরও একের পর এক পুকুর খনন চলছে। হচ্ছে মাছ চাষও। আর মাছ চাষের জন্য পুকুরে পানি ভরা হচ্ছে পাতাল থেকে তুলেই। এ কারণে নানামুখী সংকট দেখা দিয়েছে বরেন্দ্র অঞ্চলে।
অনেক আগে থেকেই সমস্যায় পড়ে আছে বরেন্দ্র ভূমি। পানি সমন্বয় নিয়ে। ১৯৮৫ সাল থেকে বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) বরেন্দ্র অঞ্চলে এসব গভীর নলকূপ বসাতে শুরু করে। এক পর্যায়ে সমগ্র বরেন্দ্র এলাকায় ১৫ হাজার ১০০টি গভীর নলকূপ বসানো হয়। তবে ভূ-গর্ভস্থ পানি সংকট যখন তীব্র হতে শুরু করে সেই সময় থেকে বিএমডিএ। ২০১২ সালের দিকে সরকার কৃষিকাজের জন্য আর ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেই থেকে বিএমডিএ গভীর নলকূপ বসানো বন্ধ করে দিয়েছে। তবে, ব্যক্তি মালিকানাধীন পাম্প বসানো হচ্ছে প্রচুর।
বরেন্দ্র অঞ্চলে এক কেজি ধান উৎপাদনে তিন হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। এক বিঘা বোরো ধান চাষে প্রয়োজন হচ্ছে ২৪ লাখ লিটার পানি। বার্ষিক ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের পরিমাণ ১৩ হাজার ৭১০ মিলিয়ন ঘনমিটার। বরেন্দ্র অঞ্চলে বছরে যে পরিমাণ পানি ভূ-গর্ভস্থ থেকে তোলা হয় তা দিয়ে এক বিঘা আয়তনের ১৮ লাখ পুকুর দুই মিটার গভীর করে পানি দিয়ে ভরা যাবে।
তথ্য অনুযায়ি, ১৯৮০ সালেও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর মাটির মাত্র ৩৯ ফুট নিচে ছিল। বর্তমান সময়ে সেই পানির স্তর ১৫০ ফুট নিচে নেমে গেছে। কোথাও কোথাও মিলছে না পানি।
পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো) জানিয়েছে, তারা ২০২১ সালে রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৫০টি জায়গায় প্রায় দেড় হাজার ফুট গভীর পর্যন্ত করে জরিপ চালিয়েছে। কোথাও কোথাও পানি স্তরের সন্ধানই পায়নি। এলাকাগুলো হচ্ছে রাজশাহীর তানোর উপজেলা পাচন্দর ইউনিয়ন, মন্ডুমালা পৌর এলাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, নওগাঁর পোরশার ছাওড় ইউনিয়ন ও সাপাহার উপজেলার সদর ইউনিয়ন।
বৃষ্টিপাত নিয়েও চিন্তা বাড়ছে। দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় এ অঞ্চলে বৃষ্টির পরিমান অর্ধেকে নেমছে। দেশের গড় বৃষ্টিপাত ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটার। তবে, বরেন্দ্র অঞ্চলে গড় বৃষ্টিপাত মাত্র ১ হাজার ২০০ মিলিমিটার (সামান্য কমবেশি)। বৃষ্টিপাতে ভূগর্ভস্থ পানি রিচার্জ হয়। দেশের অন্য অঞ্চলে এ রিচার্জের হার ২৫ শতাংশ হলেও এ অঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ।
এতো সংকটের পরেও নতুন করে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হচ্ছে পুকুরের মাছ চাষের জন্য। মাছ চাষের জন্য মাটির নিচের পানি ব্যবহার করা এক নতুন সমস্যার।
তথ্য অনুযায়ি, ২০১৭ সালে জেলায় মোট জলাশয়ের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ২৯৪ হেক্টর। এরমধ্যে বাণিজ্যিক মাছের খামার ছিল ৩ হাজার ৪৬২ হেক্টর। ২০১৮ সালে শুধু বাণিজ্যিক খামারের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ১২ হাজার ৩০৯ হেক্টর। ২০১৮ সালের পর থেকে আরো বেশি পুকুর খনন হয়েছে। ধারনা করা হয় জেলায় বর্তমান সময়ে বাণিজ্যিক খামারের পরিমাণ ১৮ থেকে ২০ হাজার হেক্টরের মধ্যে। বৃষ্টির পানি না হওয়ায় এসব বেশির ভাগ পুকুরেই পানি দেয়া হচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ পানি উঠিয়ে।
রাজশাহী জেলার মোহনপুর উপজেলার তিলাহারি গ্রামের কৃষক সাইফুদ্দিন বলেন, দিনের পর দিন খরা চলছে। বৃষ্টির দেখা নাই। কোন জায়গায় পানিও নাই। চৈত্র মাসে গভীর নলকূপেও পানি ওঠে না। একটা হাহাকার চলছে পানির অভাবে। কিন্তু পুকুরে ঠিকই পানি আছে। এই পানি বৃষ্টির পানি না। ভূ-গর্ভস্থ পানি তুলেই পুকুরে দেয়া হচ্ছে। তা দিয়ে মাছ চাষ হচ্ছে। ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানি নিচে নামা আরও তরান্বিত হচ্ছে।
একই উপজেলার কেশরহাটের চাষি আবদুল হান্নান বলেন, আগে পুকুরের পানিতে অন্তত ঘর-গৃহস্থলির কাজ করা যেত। গোসল হতো। সেই পানি খাওয়াও যেত। কিন্তু এখন সব পুকুরে মাছ চাষ। পানিতে দেওয়া হচ্ছে গোবর ও রাসায়নিক সার। এই পানি ব্যবহারের সুযোগ নেই। এতই খারাপ পানি যে তা গবাদিপশুও খায় না। বরেন্দ্র অঞ্চলে যখন পানির জন্য হাহাকার তখন সরকারি পুকুরগুলোও পাওয়া যায় না ব্যবহারের জন্য। এসব পুকুর প্রভাবশালী গোষ্ঠির কব্জায়। তারা ইচ্ছেমত ভূ-গর্ভস্থ পানি তুলে মাছ চাষ করছে।
পানি বিশেষজ্ঞ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য চৌধুরী সরওয়ার জাহান সজল বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রচুর খাসপুকুর। কিন্তু সেগুলো সাধারণ মানুষের ব্যবহারের সুযোগ নেই। দলীয় নেতারা উঠেপড়ে লাগেন ইজারা নেয়ার জন্য। উপজেলা প্রশাসন ইজারা দেয়। এটাও একটা সংকট। এলাকার প্রভাবশালী মহল পুকুরগুলো ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করছে। এই এখন পাট জাগ দেয়ার জন্য কৃষক পানি পাচ্ছে না। ওই পুকুরগুলো থাকলে কৃষকের কাজে লাগত।
আনন্দবাজার/শহক