ঢাকা | বুধবার
১৫ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১লা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আবেগে ভাসছে পুঁজিবাজার

বিদায়ী সপ্তাহে পুঁজিবাজারের মূলধন পরিমাণ আগের সপ্তাহের চেয়ে কমেছে। গেল সপ্তাহে উভয় স্টকের ৭৫ দশমিক ৮৫ ভাগ কোম্পানির

বিদায়ী সপ্তাহে পুঁজিবাজারের মূলধন পরিমাণ আগের সপ্তাহের চেয়ে কমেছে। গেল সপ্তাহে উভয় স্টকের ৭৫ দশমিক ৮৫ ভাগ কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট দর পতন হয়। এসময় দুই স্টকের (ডিএসই ও সিএসই) সব ধরনের সূচক পতন হয়। সব মিলিয়ে বিদায়ী বা গেল সপ্তাহে পুঁজিবাজার নিম্নমুখী ছিল। এর আগের সপ্তাহও নিম্নমুখী ছিল।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটের ধাক্কা পড়েছে পুঁজিবাজারে। এছাড়া এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং ঘোষণার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এই পুঁজিবাজারে। এসব কারণে বড় ধরনের দরপতন হয় পুঁজিবাজারে। আরও বলেন, লোডশেডিং ঘোষণার দিন ১৮ জুলাই ডিএসইতে বড় পতন শুরু হয়। সেই পতন আরো বড় আকারে দেখা দেয় পরের দিন ১৯ জুলাই। ওই দুইদিনের তুলনায় পরে দুইদিনের (বুধবার ও বৃহস্পতিবার) পতন আকার কিছুটা ছোট হয়ে আসে। সেই পতন গেল সপ্তাহে ছিল অব্যাহত। ফলে অপ্রত্যাশিত ভাবে পুঁজিবাজার মন্দায় ডুবেছে।

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলে উত্তেজিত হওয়া যাবে না মন্তব্যে করে গত শুক্রবার এক বিনিয়োগ শিক্ষা মেলার অনুষ্ঠানে বিএসইসির কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা বিভিন্ন জায়গায় দেখছি সবাই লিখালিখি করছে দেশে তেল শেষ, জ্বালানী শেষ। এগুলো সব গুজব। আর গুজবে কান দিয়ে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা তাদের কষ্টের টাকায় কেনা শেয়ার নামমাত্র মুল্যে বিক্রি করে দিচ্ছেন। আরও বলেন, আমাদের তেল সংরক্ষণের ক্ষমতা ৪০ দিন বা তার একটু বেশি। ইতিমধ্যে ৩৬ দিনের তেল আমাদের দেশে মজুদ আছে। আগষ্ট মাসে আরও ৮ টি জাহাজে করে তেল আসছে দেশে। তাই প্যানিক হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিবেন না বলেও জানান তিনি।

তবে পুঁজিবাজার কেন পতনে হচ্ছে, তার কোন প্রকৃত ব্যাখা দেননি বিএসইসির এই কমিশনার। কিন্তু পুঁজিবাজারের পতন ব্যাখা কেন দেননি, সেই বিযয়টি নিয়ে দু:খ প্রকাশ করলেন সংশ্লিষ্টরা। আরও বলছেন, তেল বা জ্বালানি শেষ, এগুলো গুজব বলতে পারলেন। কিন্তু এটা বলতে পারলেন না, কি কারনে পুঁজিবাজার পতন হচ্ছে। সেটা কেন বলতে পারেননি। তার কাছ থেকে পতনের কিছু ধারনা জানলে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে কিছুটা সুবিধা হতো বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা।

বিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা বলেন, ঈদের পরে টানা ৯ কার্যদিবস ধরে পতন। সেই পতন পর হঠাৎ করেই দুই কার্যদিবস সামান্য উত্থানে ফিরেছিল। কিন্তু সেই উত্থান ধরে রাখতে পারলো না। ফের নেমে এলো পতন। দীর্ঘ পতন পর হঠাৎ উত্থানে ফিরায় কিছু শান্তি পেল সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু গেল সপ্তাহের শেষ দুই কার্যদিবসে (বুধবার ও বৃহস্পতিবার) বড় ধরনের পতনে তাদের সেই শান্তিতে বড় ধরনের ছেদ পড়লো।

বিভিন্ন সমস্যায় ঈদের (ঈদুল আযহা) পর থেকেই পুঁজিবাজার নিম্নমুখী। বিষয়টি চরমভাবে ভাবিয়ে তুলেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি)। পতন থেকে রক্ষায় ফের শেয়ার দর পতনের সর্বনিম্ন সীমা (ফ্লোর প্রাইস) বেঁধে দিল বিএসইসি। বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম সাক্ষরিত এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করা হয়।

ওই আদেশে বলা হয়, বৃহস্পতিবারসহ বিগত ৫ দিনের ক্লোজিং প্রাইসের গড় দর হবে প্রতিটি সিকিউরিটিজের ফ্লোর প্রাইস। আগামি রবিবার থেকে এর ওপরে সিকিউরিটিজের দর স্বাভাবিক হারে উঠানামা করতে পারবে। তবে ফ্লোর প্রাইসের নিচে নামতে পারবে না। তবে কোম্পানির বোনাস শেয়ার বা রাইট শেয়ারের কারণে ফ্লোর প্রাইসে থাকা সিকিউরিটিজের দর সমন্বয় হবে। এদিকে নতুন শেয়ারের ক্ষেত্রে প্রথম দিনের লেনদেনের ক্লোজিং প্রাইসকে ফ্লোর প্রাইস হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এর আগে ২০২০ সালে দেশে মহামারি করোনা ভাইরাসের (কোভিড ১৯) প্রকোপ শুরু হলো পুঁজিবাজারে ধস ঠেকাতে ওই বছরের ১৯ মার্চ সে সময়ের বিএসইসি প্রতিটি কোম্পানির শেয়ারের সর্বনিম্ন দাম বেঁধে দিয়ে ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করে দিয়েছিল।

চলতি বছরের শুরুর দিকের উত্থানে সবাইকে পুঁজিবাজারে প্রতি বিনিয়োগ আগ্রহী করে তুলেছিল জানিয়ে বিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা বলেন, সেই আগ্রহে অনেকে নতুন করে বিনিয়োগ শুরু করেছিল। ধারাবাহিক মন্দায় সেই নতুন বিনিয়োগ কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ঈদের আগের শেষ সপ্তাহে সবুজ সিগন্যাল থাকলে ঈদের পর তা উল্টো গতিতে। অবশ্য এর মধ্যে গেল দুই সপ্তাহে পতন আকার বড় ছিল।

মূলধন কমার প্রসঙ্গে রেগুলেটররা (বিএসইসি) বলেন, চলতি বছরের শুরুতে মূলধন, লেনদেনসহ সূচক অতি বেড়ে যায়। এই কারণে পুঁজিবাজারে শেয়ারগুলোর দর বেড়েছিল অতিরিক্ত। পরের কয়েক সপ্তাহ অতি দরের কিছুটা লাগাম পড়েছিল। তখন শেয়ার দর কমতে থাকে। পরে কয়েক সপ্তাহ বাড়া-কমার মধ্যে কেটে যায়। হঠাৎ করেই এরপর কয়েক সপ্তাহ পুঁজিবাজার মন্দা। এ ধরনের মন্দাকে কারেকশন হিসেবে দেখা হয়েছিল। ধারনা করা হচ্ছে, কারেকশন পর ঈদের আগে শেষ সপ্তাহে পুঁজিবাজার কিছুটা উত্থানে ফিরেছে। কিন্তু ঈদের পর থেকে সেই চিরচেনা পতনে ফিরেছে পুঁজিবাজার।

ডিএসই এবং সিএসই সূত্র মতে, গত বৃহস্পতিবার লেনদেন শেষে ডিএসইর পুঁজিবাজারের মূলধন দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৯২ হাজার ১১৩ কোটি টাকা। গত ২১ জুলাই মূলধন ছিল ৫ লাখ ৩ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। অপরদিকে, গত বৃহস্পতিবার লেনদেন শেষে সিএসইর পুঁজিবাজারের মূলধন দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২৪ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। গত ২১ জুলাই মূলধন ছিল ৪ লাখ ৩৪ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা। গেল সপ্তাহে ডিএসইতে মূলধন কমেছে ১১ হাজার ৬ কোটি টাকা। সিএসইতে মূলধন কমেছে ৯ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। আগের সপ্তাহে ডিএসইতে মূলধন কমেছে ১২ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। সিএসইতে মূলধন কমেছে ১৩ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা।

চলতি বছরের প্রথম তিন সপ্তাহ (১৫ কার্যদিবস) কারণ বিহীন বেড়ে উঠেছিল পুঁজিবাজার মূলধন। হঠাৎ করেই এরপরের দুই সপ্তাহ (১০ কার্যদিবস) মূলধন কমতে দেখা গেছে। তাল মিলিয়ে বছর শুরুর তিন সপ্তাহে লেনদেন উত্থানে চমক থাকলেও পরের দুই সপ্তাহে লেনদেন নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল। পরের সপ্তাহে মূলধন বৃত্ত বেড়েছিল। সেখান থেকে পরের সপ্তাহগুলোতে মূলধন বাড়া-কমার মধ্যে ছিল। কিন্তু গেল দুই সপ্তাহে মূলধন কমার গতি অনেক বেশি ছিল। শেষ দুই সপ্তাহে দুই স্টকের মিলে (ডিএসই ও সিএসই) মূলধন কমেছে ৪৭ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা। এ ধরনের কমাকে অস্বাভাবিক হিসেবে দেখছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারে মূলধন বাড়া-কমা স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে অতিরিক্ত বৃদ্ধি যেমন ভালো লক্ষ্মণ না, তেমনি কমাও নয়। সব ক্ষেত্রেই বাড়া-কমার একটা সীমা থাকে। যখন সেই সীমা অতিক্রম করে, সেই ক্ষেত্রে সবার মনে অনেকগুলোর প্রশ্ন তৈরি হয়। এসব প্রশ্নের পরিষ্কার ও যৌক্তিক জবাব জানা থাকলে, সেটা অন্য কথা। না জানা থাকলে সেই ক্ষেত্রে বিযয়টি ভালো চোখে দেখার কথা না।

এদিকে, বিদায়ী সপ্তাহে ডিএসইর পুঁজিবাজারে সব ধরনের সূচক পতনে লেনদেন শেষ হয়। এক সপ্তাহে ব্যবধানে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৯৮০ দশমিক ৫১ পয়েন্টে। এছাড়া ডিএসই৩০ সূচক ২ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস ২ দশমিক ৭৪ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ২ হাজার ১৪৫ দশমিক ২৫ পয়েন্টে এবং ১ হাজার ৩০৮ দশমিক ৫১ পয়েন্টে।

সপ্তাহের ব্যবধানে সিএসইর প্রধান সূচক সিএএসপিআই ২ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৫৯৭ দশমিক ৫৬ পয়েন্টে। এছাড়া সিএসই৫০ সূচক ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ, সিএসই৩০ সূচক ২ দশমিক ১৫ শতাংশ, সিএসসিএক্স সূচক ২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ এবং সিএসআই সূচক ২ দশমিক ২১ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১ হাজার ২৯৩ দশমিক ২৭ পয়েন্টে, ১২ হাজার ৯৬৬ দশমিক ৭৫ পয়েন্টে, ১০ হাজার ৫৪২ দশমিক ৬৯ পয়েন্টে এবং ১ হাজার ১০৮ দশমিক ১৩ পয়েন্টে।

গেল সপ্তাহে ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৩ হাজার ১৬৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে লেনদেন ছিল ২ হাজার ৭৭০ কোটি ৬ লাখ টাকা। অপরদিকে গেল সপ্তাহে সিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৭৮ কোটি ৭৮ টাকা। আগের সপ্তাহে লেনদেন ছিল ৭৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা। গেল সপ্তাহে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত ৩৯৫টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে শেয়ার দর বেড়েছে ৬৮টির, দর কমেছে ২৯৭টির বা ৭৫ দশমিক ১৮ শতাংশ ও অপরিবর্তিত রয়েছে ২৪টির কোম্পানির। লেদনের হয়নি ৬ কোম্পানির শেয়ার। সপ্তাহে সিএসইতে তালিকাভুক্ত ৩৪১টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে শেয়ার দর বেড়েছে ৬২টির, দর কমেছে ২৬১টির বা ৭৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১৮টির কোম্পানির।

সংবাদটি শেয়ার করুন