রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পতন ঠেকাতে ফ্লোর প্রাইস

পতন ঠেকাতে ফ্লোর প্রাইস

ফের দর পতনের সর্বনিম্ন সীমা বেঁধে দিল বিএসইসি কমিশন

  • বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে প্রতিটি পতন গভীরভাবে অনুসন্ধান

বিভিন্ন সমস্যায় ঈদের (ঈদুল আযহা) পর থেকেই পুঁজিবাজার নিম্নমুখী। বিষয়টি চরমভাবে ভাবিয়ে তুলেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি)। পুঁজিবাজারের অস্বাভাবিক পতন থেকে বিনিয়োগকারীদের রক্ষা করতে তাদের (বিএসইসি) নানান পরিকল্পনাও একে একে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে দিনদিন পুঁজিবাজার তলানিতে চলে আসছে। এ থেকে বাঁচাতে ফের দর পতনের সর্বনিম্ন সীমা (ফ্লোর প্রাইস) বেঁধে দিল বিএসইসি।

এদিকে ঈদের পরে টানা ৯ কার্যদিবস ধরে পতন। সেই পতন হঠাৎ করেই দুই কার্যদিবস সামান্য উত্থানে ফিরেছিল। কিন্তু সেই উত্থান ধরে রাখতে পারলো না। ফের নেমে এলো পুঁজিবাজারে পতন। দীর্ঘ পতন পর হঠাৎ উত্থানে আসায় শান্তি পেল বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু শেষ দুই কার্যদিবসে (বুধবার ও বৃহস্পতিবার) বড় ধরনের পতনে তাদের সেই শান্তিতে বড় ধরনের ছেদ পড়লো, এমনটিই জানালেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টারা।

গত বৃহস্পতিবার পুঁজিবাজারের চলমান পতন ও বিভিন্ন সংকট রোধে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে দর পতনের সর্বনিম্ন সীমা বেঁধে দিল বিএসইসি কমিশন। বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম সাক্ষরিত এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করা হয়। যা আগামি রবিবার থেকেই কার্যকর হবে।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টারা বলেন, নানা সমস্যার কারণে শত চেষ্টা করেও রেগুলেটররা পুঁজিবাজার উত্থান আনতে হিমশিম খাচ্ছে। পুঁজিবাজার সঠিক পথে আনতে সবার সম্মিলিত উদ্যোগও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। কোনো ইতিবাচক উন্নয়নই কাজেই লাগছিল না পুঁজিবাজারের পতন ঠেকাতে। কিন্তু হঠাৎ করেই গত দুই কার্যদিবস (সোমবার ও মঙ্গলবার) উল্টো দিকে ফিরে আসছিলো পুঁজিবাজার। উত্থানে ফিরে আসার কারণ হিসেবে সকলের বিশেষ নজরদারির বিষয়টি ওঠে আসছিলো।

বিশেষ করে পুঁজিবাজারে অর্থ প্রবাহ বাড়াতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), মার্চেন্ট ব্যাংক ও স্টক ডিলারের ক্যাপিটালে নজরদারি করার সিদ্ধান্তের বিষয়টি এই উত্থানের মূল কারন ছিল। কিন্তু সেই উত্থান ধরে রাখতে পারেনি। উত্থানের দুইদিন পরে পুঁজিবাজারে ফের দুইদিন ধরে বড় ধরনের পতন। এটাতে কিছুটা বিচলিত বিনিয়োগকারীরা। এ ধরনের পতন কারন জানতে মরিয়া হয়ে আছেন তারা।

আরও পড়ুনঃ  রাজধানীতে ব্যাপক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা

বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটের ধাক্কা সহ এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং ঘোষণার পর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে উল্লেখ্য করে বিএসইসির এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান পুঁজিবাজারে কিছুটা অর্থ সংকট রয়েছে। তবে এ সংকট খুব একটা বড় সমস্যা না। এটা সমধানের লক্ষে সংশ্লিষ্ট সবার সাথে আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে কিছু অর্থ সংস্থান হয়ে গেছে। এখন পুঁজিবাজারে ঢোকার পথে রয়েছে। অবশ্য নানা উদ্যোগে টানা পতন পর গত দুইদিন (সোমবার ও মঙ্গলবার) ঘুরে দাঁড়ায় পুঁজিবাজার। কিন্তু সেই উত্থান গত দুই কার্যদিবস ফের পতনে নেমে এসেছে।

পুঁজিবাজারের পতন রোধে কমিশন সক্রিয় কাজ করছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রতিটি পতন খুব গভীরভাবে অনুসন্ধান চলছে বিএসইসির কমিশন। পতনের প্রকৃত কারণ বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমার দেখছি, পতনে কারো যোগসূত্র রয়েছে কিনা। থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তবে পুঁজিবাজারের স্বাভাবিক গতির স্বার্থে এসব ব্যবস্থা খবর বাহিরে আসে না বলেন ওই কর্মকর্তা।

পতন বেড়ে যাওয়ার হঠাৎ করেই তড়িগড়ি করে গতকাল বৃহস্পতিবার বিএসইসির এক আদেশে বলা হয়, বৃহস্পতিবারসহ বিগত ৫ দিনের ক্লোজিং প্রাইসের গড় দর হবে প্রতিটি সিকিউরিটিজের ফ্লোর প্রাইস। আগামি রবিবার থেকে এর ওপরে সিকিউরিটিজের দর স্বাভাবিক হারে উঠানামা করতে পারবে। তবে ফ্লোর প্রাইসের নিচে নামতে পারবে না। তবে কোম্পানির বোনাস শেয়ার বা রাইট শেয়ারের কারণে ফ্লোর প্রাইসে থাকা সিকিউরিটিজের দর সমন্বয় হবে। এদিকে নতুন শেয়ারের ক্ষেত্রে প্রথম দিনের লেনদেনের ক্লোজিং প্রাইসকে ফ্লোর প্রাইস হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

অবশ্য এর আগে ২০২০ সালে দেশে মহামারি করোনা ভাইরাসের (কোভিড ১৯) প্রকোপ শুরু হলো পুঁজিবাজারে ধস ঠেকাতে ওই বছরের ১৯ মার্চ সে সময়ের বিএসইসি প্রতিটি কোম্পানির শেয়ারের সর্বনিম্ন দাম বেঁধে দিয়ে ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করে দিয়েছিল। করোনায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশের পুঁজিবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। তবে সেটা ভয়াবহ রূপ ধারন করে ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা ভাইরাসে রোগী শনাক্ত হওয়ার পরে। এরপরই বিনিয়োগকারীরা যার যার অবস্থান থেকে শুধু বিক্রি করার চেষ্টাই করে গেছেন। পুঁজিবাজারে দেখা দেয় ক্রেতার ভয়াবহ সংকট। তবে এখন করোনাভাইরাস নিয়ে সেই আতঙ্ক নেই।

আরও পড়ুনঃ  করোনায় বিশ্বে মৃত্যু ছাড়িয়েছে ১৭ লাখ

এদিকে, ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি লেনদেন শেষে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৪ হাজার ৭৬৮ পয়েন্টে ছিল। যেটা কমতে কমতে ওই বছরের ৮ মার্চ এসে দাড়াঁয় ৪ হাজার ২৮৭ পয়েন্ট। ওইদিন দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পরে ৯ মার্চ একদিনেই কমে যায় ২৭৯ পয়েন্ট। ওই বছরের ১৮ মার্চ করোনা ভাইরাসে বাংলাদেশে ১ম রোগী মারা যাওয়ার দিন নেমে যায় ৩ হাজার ৬০৪ পয়েন্টে।

আতঙ্কিত পুঁজিবাজারের এমন পতন ঠেকাতে ১৯ মার্চ চালু করা হয় ফ্লোর প্রাইস। এরপরে ৩ ধাপে বর্তমান কমিশন ফ্লোর প্রাইস তুলে নিয়েছিল। প্রথম দফায় ২০২১ সালের ৭ এপ্রিল ৬৬টি কোম্পানি থেকে ফ্লোর প্রাইসের নির্দেশনা প্রত্যাহার করে নেয় কমিশন। এরপর ওই বছরের ৩ জুন ফ্লোর প্রাইসে থাকা বাকি ৩০ কোম্পানি থেকে নির্দেশনাটি তুলে নেয় বিএসইসি। তৃতীয় ধাপে এসে ১৭ জুন পুঁজিবাজার থেকে পুরোপুরি ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়।

স্টক এক্সচেঞ্জ সূত্রে জানা যায়, ঈদের পর টানা ৯ কার্যদিবস পুঁজিবাজার পতন। সেই পতনে থেকে উত্থানে ফিরেছিল পরের দুই কার্যদিবস (সোমবার ও মঙ্গলবার)। সেই উত্থানে ফের বাঁধা। ফিরে আসলো পতন পুঁজিবাজারে। গত বুধবারের মতো বৃহস্পতিবারেও দেশের প্রধার পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সব ধরনের সূচক পতন হয়। আগের কার্যদিবস থেকে এদিন (বৃহস্পতিবার) দুই স্টকে লেনদেন কমেছে। ডিএসইতে এদিন (বৃহস্পতিবার) লেনদেন হয় ৪৪১ কোটি ৭৭ লাখ টাকার শেয়ার। আগের কার্যদিবস বুধবার লেনদেন হয়েছিল ৭৭৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।

এদিন ডিএসইতে লেনদেন হওয়া ৩৮০টি কোম্পানির মধ্যে শেয়ার ও ইউনিটের দর বেড়েছে ২৫টির, কমেছে ৩৩৩টির এবং পরিবর্তন হয়নি ২২টির। এদিন ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫৭ দশমিক ৪৯ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৯৮০ পয়েন্টে। এছাড়া ডিএসই-৩০ সূচক ১৭ দশমিক ৬০ পয়েন্ট এবং ডিএসইএস সূচক ১১ দশমিক ৬৪ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ২ হাজার ১৪৫ দশমিক ২৫ পয়েন্ট এবং ১ হাজার ৩০৮ দশমিক ২০ পয়েন্টে।

আরও পড়ুনঃ  অবৈধ ড্রেজার বাণিজ্যে জ্বীনের বাদশাচক্র

এদিকে দুই স্টকের ৮৮ শতাংশ কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট দর কমেছে। এর মধ্যে ডিএসইর ৮৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ এবং সিএসইর ৮৮ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট দর কমেছে। অপরদিকে দুই স্টকের ৬ দশমিক ৪২ শতাংশ কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট দর বেড়েছে। এর মধ্যে ডিএসইর ৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং সিএসইর ৬ দশমিক ৪২ শতাংশ কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট দর বেড়েছে।

ডিএসইতে ছয় খাতের শতভাগ কোম্পানির শেয়ার দর পতন হয়েছে। শতভাগ পতন হওয়া এই খাতগুলো হলো- সিরামিক, পাট, বিবিধ, পেপার, সেবা আবাসন এবং চামড়া। এদিন নন ব্যাংকিং আর্থিক ৯৬ শতাংশ, জ্বালানি শক্তি ৯৬ শতাংশ, খাদ্য আনুষঙ্গিক ৯৫ শতাংশ, আইটি ৯১ শতাংশ, বস্ত্র ৯১ শতাংশ, ওষুধ রসায়ন ৯০ শতাংশ, ইঞ্জিনিয়ারিং ৮৬ শতাংশ, সিমেন্ট ৮৬ শতাংশ, বিমা ৮৫ শতাংশ, ভ্রমণ অবসর ৭৫ শতাংশ, টেলিকম ৬৭ শতাংশ এবং ব্যাংক খাতের ৬৭ শতাংশ কোম্পানির শেয়ার দর কমেছে। খাতগুলোর শেয়ার দর পতনের একই চিত্র ছিল পুঁজিবাজার সিএসইতে।

সিএসইতে গতকাল বৃহস্পতিবার লেনদেন হয় ১১ কোটি ১১ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবস বুধবার লেনদেন হয়েছিল ১৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এদিন সিএসইতে লেনদেন হওয়া ২৭১টি কোম্পানির মধ্যে শেয়ার ও ইউনিট দর বেড়েছে ২৪০টির, কমেছে ২৪০টির এবং পরিবর্তন হয়নি ১৪টির। এদিন সিএসইর প্রধান সূচক সিএএসপিআই ২০৪ দশমিক শূন্য ৪ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৫৯৭ দশমিক ৫৬ পয়েন্টে।

এছাড়া সিএসই-৫০ সূচক ১৫ দশমিক ২৩ পয়েন্ট, সিএসই-৩০ সূচক ১৪৫ দশমিক ১৩ পয়েন্ট, সিএসসিএক্স সূচক ১২২ দশমিক ৫৬ পয়েন্ট এবং সিএসআই সূচক ১৩ দশমিক ৪২ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১ হাজার ২৯৩ দশমিক ২৭ পয়েন্টে, ১২ হাজার ৯৬৬ দশমিক ৭৫ পয়েন্টে, ১০ হাজার ৫৪২ দশমিক ৬৯ পয়েন্ট এবং ১ হাজার ১০৮ দশমিক ১২ পয়েন্টে।

সংবাদটি শেয়ার করুন