দেশে চলছে অর্থনীতির নানামুখী সমস্যা। সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে রিজার্ভ সংকট। দফায় দফায় ডলারের দাম বাড়িয়েও সংকট কাটানো যাচ্ছে না। বরং তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে ডলার সংকট। কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না বাজার। খোলাবাজার আর ব্যাংক, সবখানেই দাম এক। তবুও মিলছে না ডলার। অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা পরবর্তীতে হঠাৎ করে চাহিদা বেড়ে গেছে। তবে চাহিদার যোগানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যার প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এর ফলে আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে।
তবে যে হারে আমদানি ব্যয় বেড়েছে সে হারে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়েনি। এছাড়া করোনার সময়ের বৈদেশিক ঋণ ও এলসির ঋণ এখন শোধ করতে হচ্ছে- যে কারণে ডলারের চাহিদা অনেক বেশি। এতে সংকায় দিন কাটছে আমদানীকারকদের। থমকে আছে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম। এভাবে চলতে থাকলে বন্ধ হয়ে যেতে পারে অনেক আমদানীকারক প্রতিষ্ঠান। অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
ডলারের দাম আনুষ্ঠানিক ৯৪ টাকা ৪৫ পয়সা হলেও খোলাবাজারে এখন বিক্রি হচ্ছে ১১২ টাকা। সরেজমিনে দেখা গেছে, খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১২ টাকা করে। তবুও চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাচ্ছে না গ্রাহক। ব্যাংকের চিত্রও একই রকম। ব্যাংকগুলোতেও ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১২ টাকায়। এতে কার্ব মার্কেট ও ব্যাংকে ডলারের দর সমানে সমান। এমন আকাশচুম্বী দামেও ডলারের চাহিদা অনেক।
গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক এক দিনের ব্যবধানে ৭ টাকা বাড়িয়ে গতকাল বুধবার প্রতি ডলার ১০৮ টাকায় বিক্রি করেছে। আগের দিন মঙ্গলবার এই ব্যাংকে ডলারের দাম ছিল ১০১ টাকা। আইএফআইসি ও সিটি ব্যাংক থেকে এক ডলার কিনতে গতকাল বুধবার গুনতে হয়েছে ১০৭ টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক ১০৩ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে। অন্য তিন সরকারি ব্যাংক সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক বিক্রি করেছে ১০২ টাকায়।
আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এসকে ট্রেডিং। প্রতিষ্ঠানটি বিদেশ থেকে ফেব্রিকস আইটেম আমদানি করে। শীতকে সামনে রেখে কম্ভল ও জায়নামাজ আমদানীর শুরুতে দেখা দেয় ডলার সংকট। এতে বন্ধ হয়ে যায় আমদানী কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এসকে তাওহীদ সাগর দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, এখন দেশঝুড়ে চলছে প্রচণ্ড গরম। তবে এই গরম শেষেই আসছে শীত। শীতকে সামনে রেখে কম্বলের চাহিদা বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। এসব পন্য আমদানির এখনই মোক্ষম সময়। যখনই আমদানির জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি তখনই ডলার সংকটে পড়েছি। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে গিয়েছিলাম ডলারের জন্য। ব্যাংক থেকে আমাকে বলা হয়েছিলো ডলারের দাম বলতে পারবে তবে ডলার দিতে পারবে না। দাম জানতে চাইলে তারা বলেন ১১২ টাকা। পরে দাম জেনে খালি হাতে অফিসে ফিরে এসেছি। এখন অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে এখন ডলারের চাহিদা যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দর বেড়েছে। সংকটও তৈরি হয়েছে। যেসব ব্যাংকের রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় ভালো, তারা অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় আছে। কিন্তু যাদের রেমিট্যান্স কম, তারা এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর কাছ থেকে বেশি দামে ডলার কিনছে।
খোলাবাজারে ডলার ব্যবসায়ী নরুল আলম বলেন, খোলাবাজারে ডলার নেই, ব্যাংকেও সংকট। বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় ডলার কম পাওয়ায় বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তেই দামের ওঠানামা করছে।
অর্থনীতির বিশ্লেষক গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছে যে পরিমাণ ডলার বিক্রি করে তা দিয়ে ব্যাংকগুলোর কিছুই হয় না। সব ব্যাংক পায় না। যেসব ব্যাংক জ্বালানি তেলসহ সরকারের অন্য পণ্য আমদানির এলসি খোলে, তারাই পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বাজারে ডলারের চরম সংকট চলছে। পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার প্রয়োজনীয় ডলার নেই ব্যাংকগুলোর কাছে।
বেশি দামে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেও চাহিদা মিটছে না। সে কারণে বেশি দামে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে। বাধ্য হয়ে তাকে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। আহসান এইচ মনসুর বলেন, দাম আরও বাড়বে-এমন গুজবে সাধারণ মানুষ এখন শেয়ারবাজারে লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে ডলার কিনছে। অনেকে আবার তিন-চার মাস পর দেশের বাইরে যাবেন, তাই প্রয়োজনীয় ডলার এখনই কিনে রাখছেন। সব মিলিয়ে মুদ্রাবাজারে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ অবস্থা থাকলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপদ দেখা দিতে পারে।
তবে সব সংকটকে উড়িয়ে দিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আমাদের এক্সপোর্ট ও রেমিট্যান্স থেকেও ডলার আসবে। গতবছর রেমিট্যান্স থেকে ২৫ বিলিয়ন ডলার এসেছে। এবার আরও বেশি আসবে। এক্সপোর্ট ও রেমিট্যান্স থেকে আমরা যে ডলার পাবো তা দিয়ে বাৎসরিক ডালারের চাহিদা মেটানো সম্ভব।
আনন্দবাজার/শহক