ঢাকা | রবিবার
২৫শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আমদানি চাপে ডলার

আমদানি চাপে ডলার

আমদানীর তুলনায় রপ্তানি কম। রেমিট্যান্সও কমছে আশঙ্কাজনকভাবে। সব মিলিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে ডলারের। পরিস্থিতি সামাল দিতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবুও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না ডলারের দাম। রেকর্ডের পর রেকর্ডে টাকার মান হারাচ্ছে ডলারের কাছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশে তৈরি হয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতি। কয়েকটি দেশে মন্দার পদধ্বনিও শোনা যাচ্ছে। এতে একদিকে যেমন কমছে রপ্তানি আদেশ, অন্যদিকে বাড়ছে উৎপাদন খরচ। আবার দেশে জ্বালানি সংকটও তীব্র হয়েছে। সেই সংকট মোকাবিলায় শুরু হয়েছে বিদ্যুতের পরিকল্পিত লোডশেডিং। আবার প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎসংকটে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শিল্পকারখানার উৎপাদন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সবই সাময়িক। দীর্ঘ মেয়াদে সংকট নিরসনে সাহসী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়ে এখন ডলারের চাহিদা কমাতে হবে। রপ্তানি আয় বাড়াতে হলে ডলারের দাম বাড়াতে হবে। সুদহারের সীমা তুলে দিতে হবে, যাতে ব্যবসায়ীদের টাকা ধার করে ডলার কেনার খরচ বাড়ে। আর তেল ও গ্যাসের দাম বাড়িয়ে পণ্য দুটির চাহিদা কমাতে হবে। অপ্রয়োজনীয় আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় আর আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাজারে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। আমদানির লাগাম টেনে ধরা ছাড়া ডলারের বাজার স্বাভাবিক হবে না বলেও মন্তব্য তাদের।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যামতে, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি প্রায় ৯ শতাংশ। প্রকৃতপক্ষে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে প্রায় ১০ শতাংশ। এই মূল্যস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দিনগুলোতে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ আরো বাড়বে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক মঞ্জুর হোসেন বলেন, আমদানি বাড়ায় বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। স্বাভাবিক নিয়মেই বেড়েছে দর। কিন্তু এখন আমদানির লাগাম টেনে ধরতে হবে; যে করেই হোক আমদানি কমাতে হবে। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটা ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য সব পণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন ৭৫ শতাংশ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। এটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। একই সঙ্গে পণ্য আমদানির আড়ালে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমানোর বিকল্প নেই। পাশের দেশ ভারতসহ পৃথিবীর সব দেশই মুদ্রার অবমূল্যায়ন করছে। এখন আমরা যদি না করি, তাহলে প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে পড়বো। এতে হয়তো আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। কিন্তু একই সঙ্গে ডলারের দাম বেশি হওয়ায় আমদানি কিছুটা নিরুৎসাহিত হবে।

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বলেন, ডলারের সংকট শুধু বাংলাদেশে নয়, অনেক দেশেই চলছে। আমাদের দেশে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার প্রভাব পড়তে সময় লাগবে। বিলাসপণ্যের ঋণপত্র খোলা কমছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমছে, এর প্রভাব পড়তে শুরু করবে। যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে আমদানির চাপ কিছুটা কমবে। তবে খুব বেশি না। এখন প্রবাসী আয়ে নজর বাড়াতে হবে। এ জন্য প্রণোদনা আরও বাড়ানো যেতে পারে।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান খান চৌধুরী বলেন, দেশীয় মুদ্রা অর্থাৎ টাকার এ অবনমন ঠেকাতে রপ্তানি বাড়ানোর ওপর জোর দিতেই হবে। বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটিই একমাত্র উপায়। আহসান খান চৌধুরী বলেন, টাকার মান ধরে রাখার একমাত্র উপায় হলো রপ্তানি বাড়ানো। রপ্তানি বাড়ার বিপরীতে আমদানি কমে এবং রেমিট্যান্স যদি ঠিকমতো আসে তাহলে টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকানো সম্ভব।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে কিছুটা হলেও আমদানি কমবে। তবে যেভাবে আমদানি খরচ বেড়েছে, তাতে এসব উদ্যোগে বড় কিছু না। ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের দামের পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে, তাতে বৈধ পথে আয় বাড়বে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে উদ্যোগ নিতে হবে।

ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, আমরা আমদানিনির্ভর দেশ। এ জন্য এখন অতিসতর্ক হওয়ার বিকল্প নেই। বিশেষ করে ডলার খরচের বিষয়ে। যেহেতু এটা বৈশ্বিক সমস্যা সেহেতু শক্তভাবেই তা মোকাবিলা করতে হবে। দেশ যাতে মন্দা ও অতি মূল্যস্ফীতির মধ্যে পড়ে না যায়, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, করোনা থেকে সবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশ। কর্মসংস্থানের বড় অংশ বেসরকারি খাতে। তাই নীতিনির্ধারকদের জেনেবুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (সিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, সাম্প্রতিক ডলারের মূল্য অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ডলারের দাম ৯৪ টাকা। তবে অনেক ব্যাংক পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম ১০২ টাকা পর্যন্ত আদায় করছে। আর খোলাবাজারে তা দাঁড়িয়েছে ১০৫ টাকার উপরে। এই অবস্থা উত্তরণে ব্যাংকগুলোর ডলার বিনিময় বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিংয়ের আওতায় আনা প্রয়োজন। তা না হলে শিল্পের কাঁচামাল, নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য, চিকিৎসা সামগ্রী ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে ব্যয় আরো বাড়বে। যার দায়ভার শেষ পর্যন্ত ভোক্তাকেই বহন করতে হবে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন