দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট সহসাই কাটছে না। সাময়িকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। অতিরিক্ত আমদানি দেখা গেলেও সে অনুপাতে শিল্পখাতের প্রসার ঘটছে না। ফলে আমদানি দেখিয়ে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্নে উঠছে। ব্যাকিংখাত নাজুক অবস্থায় থাকলেও পদক্ষেপ নিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাছাড়া আমদানিনির্ভরতার কারণেই বর্তমান বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিয়েছে। অর্থনীতির সার্বিক এই পরিস্থিতিতে ভালো নেই ব্যবসায়ীরা। তাই আতঙ্ক সৃষ্টি যেন না হয় এমন পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কাজ করছে একটি লৌহ ত্রিভূজ।
দেশের সার্বিক অর্থনীতি নিয়ে গতকাল রবিবার ধানমন্ডিতে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) কার্যালয়ে ‘সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ: কতটা ঝুঁকিপূর্ণ?’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এমন মতামত তুলে ধরেন বিশেষজ্ঞরা। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম তামিম, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান আলোচনায় অংশ নেন। এ ছাড়া ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী কথা বলেন।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সংকট স্বল্পমেয়াদী প্রকৃতির নয়। সহজে এ সংকট থেকে মুক্তি মিলবে না। বাংলাদেশ মাঝারি মেয়াদী সংকটে রয়েছে। বর্তমান ব্যবস্থা অপ্রতুল। তাই স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী উভয় ধরনের ব্যবস্থা হওয়া উচিত। বাস্তবে মুদ্রাস্ফীতির হার অনেক বেশি। বিশেষ করে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার প্রকাশিত সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি হারের তুলনায় অনেক বেশি।
অতিরিক্ত আমদানি দেখিয়ে টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন ড. ফাহমিদা খাতুন। বর্তমান পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্সে প্রণোদনা না দিয়ে তা অন্য কাজে লাগাতে পরামর্শ দেন। বিদ্যুৎখাতে শুধু আমদানি করা এলএনজির ওপর নির্ভর করা কঠিন হবে বলেও মনে করেন তিনি। রিজার্ভের ঘাটতি পূরণে আএমএফসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে ঋণ নেয়ার কথা বলেন তিনি। প্রয়োজন নয় এমন প্রকল্পে ব্যয় না করার পরামর্শ এ অর্থনীতিবিদের।
বেসরকারি সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দৃষ্টিভঙ্গিও একটা সমস্যা সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় একটি লৌহ ত্রিভূজ গেড়ে বসেছে। এ ত্রিভূজের প্রথম বাহু হলো একটি এককেন্দ্রিক উন্নয়ন দর্শন। যা অবিচারের মাধ্যমে নতুন দারিদ্র সৃষ্টি করছে। কোভিডের পরেও ২১ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্রসীমার নিচে গেছে বলে জানান তিনি।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে স্বার্থের দ্বন্দ্বভিত্তিক অর্থিক ব্যবস্থাপনা। যার মাধ্যমে আইন করে অনিয়ম তৈরি করা হচ্ছে। আর স্বার্থের জন্য এত প্রকল্প। এ কারণেই জ্বালানি, পরিবহন খাতের অব্যবস্থাপনা। এ কারণেই নিরাপদ সড়ক পাওয়া যাচ্ছে না কোনোভাবেই, এই কারণেই কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এখনো চলছে। বিআরটিসিকে এ কারণেই অচল করে রাখা হয়েছে। এর জন্যই ব্যাংকিংখাতের এ দশা। এসবই হচ্ছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে। তৃতীয়ত এ সব কিছুর বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে জনগণের কাঁধে। ফলে অবিচারের সৃষ্টি হচ্ছে। আর এই মুহূর্তে বাংলাদেশে অর্থনীতিতে তিনটি অবিচারের বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। প্রথমত, নতুন নতুন দারিদ্র্য; দ্বিতীয়ত, পুষ্টি ও মাধ্যমিক শিক্ষাসহ কিছু সূচকে নিম্নমুখিতা এবং তৃতীয়ত, যুব বেকারত্ব বৃদ্ধি।
তাই অর্থনীতির সামষ্টিক ভারসাম্যহীনতার মধ্যে লৈাহ ত্রিভূজ ভাঙার আলোচনাও করতে হবে বলে মন্তব্য করেন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। এটা ঠিক করতে হলে বড় ধাক্কা দরকার বলেও জানান তিনি। কর্মসংস্থানের অভাব আরো বাড়ছে। তবে এটা বর্তমান পরিস্থিতির জন্য নয়, বরং অর্থনৈতিক নীতির কারণে হচ্ছে বলেও মনে করেন করেন এ গবেষক।
দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে। ব্যাকিংখাতের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক বলেও মন্তব্য করেন। আমদানির কথা বলে টাকা প্রচার হচ্ছে কিনা তা এনবিআর বা সরকার খেয়াল করছে না বলেও অভিযোগ করেন। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়লেও তার তথ্য নেই। আয় বৈষম্য বিপদসীমায় চলে যাচ্ছে বলেও সতর্ক করেন এ অর্থনীতিবিদ।
দেশের ব্যাংকিংখাত নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নতুন গর্ভনর এসেই গণছাড় দিয়েছেন। এ খাতের সমস্যা চিহ্নিত, তবে সমাধানের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। দেখছি- দেখবো- আমরা নজর রাখছি- বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক। হোটেলে গিয়ে ব্যাংকের সিদ্ধান্ত হচ্ছে- বিশ্বে কোথাও এমন নজির আছে নাকি সে প্রশ্নও রাখেন তিনি। আমদানি বাড়ার কথা বলা হলেও ব্যবসায় তার আলমত দেখা যাচ্ছে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মানুষের অংশগ্রহণ নেই বলেও অভিযোগ সাবেক এ গর্ভনরের। সরকারি অপচয় ও অর্থ পাচার রোধের আহ্বান জানান তিনি।
দেশের আমদারি-রপ্তানির অবস্থা তুলে ধরে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রপ্তানির বড় অংশ আমদানিতে হারিয়ে যাচ্ছে। ৫২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির মধ্যে পোশাকখাতের অবদান ৪২ বিলিয়ন ডলার। তবে তাদের প্রকৃত রপ্তানি ২৮ বিলিয়ন ডলার বাকিটা আমদানিতে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে, গত ১০ বছরে ৬০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। ৮০ শতাংশ প্রচার আমদানির নামে হয়ে থাকে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। পেনিক সৃষ্টি না হয় এমন পদক্ষেপের কথা বলেন এ অর্থনীতিবিদ।
বিদ্যুতের প্রাথমিক জ্বালানি জোগান না বাড়িয়ে পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হওয়ার কারণে বর্তমানে বিদ্যুৎ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম তামিম। তিনি বলেন, সরকার বিদ্যুতের প্রাথমিক জ্বালানির জোগান দিতে না পারায় এ সমস্যা হয়েছে। দ্রুতগতিতে বিদ্যুৎ আনার জন্য এক সময় তেলভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজন ছিল। তবে সেটাকে তিন বা পাঁচ বছর পর্যন্ত রাখার পরামর্শ ছিল। কিন্তু সেটা না করে এখন পর্যন্ত চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ফলে তেলের ওপর নির্ভরতা অনেক বেড়েছে। আর তেলের ওপর এই নির্ভরতার কারণেই বর্তমান সমস্যা তৈরি হয়েছে। ২০০০ সালের পর থেকে গ্যাস অনুসন্ধানের রাজনৈতিক সাহস কোনো সরকারই নিতে পারেনি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
দেশের ব্যবসা পরিস্থিতি নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী জানান, ব্যবসায়ীরা ভালো নেই। ঢাকার চেয়েও গ্রামে ৩ গুণ লোডশেডিং হচ্ছে। ফলে ডিজেল কিনে জেনারেটর চালিয়ে বেশি খরচে শিল্পে উৎপাদন কাজ করতে হচ্ছে। এতে ব্যয় বাড়বে এবং সময়মতো ডেলিভারি না দিতে পারলে অর্ডার বাতিল হবে বলেও জানান তিনি। তাই রপ্তানি শিল্প সবসময় সচল রাখার আহ্বান জানান তিনি। শুধু বড় খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের সুবিধা দিলে হবে না বলে মনে করেন তিনি।
আনন্দবাজার/শহক