ঢাকা | বৃহস্পতিবার
৫ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মেগা প্রকল্পে রাস

মেগা প্রকল্পে রাস

দেশে চলমান ডলার সংকটে জ্বালানি আমদানিতে বেগ পেতে হচ্ছে। ব্যয় হ্রাস ও জ্বালানি সাশ্রয়ে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। আমদানির লাগাম টানার চেষ্টা চলেছে। বিগত ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যালেন্স অব পেমেন্ট স্থিতিশীল করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেয়ার বিষয়েও আলোচনা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কৃচ্ছ্রসাধন বা ব্যয় সংকোচনের অংশ হিসেবে মেগা প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন সংশোধন ও প্রয়োজনে সাময়িকভাবে স্থগিতের পরামর্শ দিচ্ছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্তিতিকে সামনে রেখে ‘বাংলাদেশর বৃহৎ বিশটি মেগা প্রকল্প’ শীর্ষক এক আলাপচারিতায় তিনি এসব কথা তুলে ধরেন। এতে মেগা প্রকল্পগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি ও প্রবণতা এবং প্রত্যাশা ওঠে আসে। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের উপস্থাপিত গবেষণাপত্রে সহযোগি গবেষক ছিলেন মমতাজুল জান্নাত ও ইফাজ কবির।

গতকাল বৃস্পতিবার অনলাইনে আয়োজিত আলোচনায় সিপিডির সাবেক প্রথম নির্বাহী পরিচালক ড. দেবপ্রিয় বলেন, যেসব মেগাপ্রকল্প এখনো শুরু হয়নি অতিপ্রয়োজনীয় না হলে বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে সেসব প্রকল্পের কাজ সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা যায়। তাছাড়া চলমান মেগা প্রকল্পগুলোতে যে প্রকাশ্য দুর্নীতি ও পণ্য ও সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মূল্য ধরা হচ্ছে সেগুলো সংশোধন করে কৃচ্ছ্রসাধনের পরামর্শ দেন তিনি। কোন কোন প্রকল্পে দুর্নীতি হচ্ছে- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকল্পের অতিরিক্ত মূল্যায়ন নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কথা বলেন।

বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট কোনো মৌসুমী সমস্যা নয় বলে উল্লেখ করে ড. দেবপ্রিয় এটাকে কাঠামোগত সমস্যা বলে অভিহিত করেন। তবে চলমান সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে নীতি প্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও কোনো ধরণের নীতি নেতৃত্ব দেখা যাচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। আংশিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক, ইআরডি, এনবিআর বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে না বলেও মনে করছেন। তাহলে কারা নীতি নেতৃত্ব দেবে? এমন প্রশ্নের জবাবে ড. দেবপ্রিয় বলেন, অবশ্যই এটা অর্থমন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। তবে সেখানে সকল অর্থিক কর্তৃপক্ষকে নিয়ে একটি কমিটি কাজ করার কথা বলেও জানান।

আইএমএফ থেকে ঋণ নেয়ার বিষয়ে যে আলোচনা হচ্ছে তাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন ড. দেবপ্রিয়। ডলার সংকট কাটাতে এবং আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য আনতে আইএমএফ থেকে দুই বা সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেশের জন্য দরকার বলেও মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। শ্রীলঙ্কা অনেক দেরিতে আইএমএফের সরণাপন্ন হয়েছিল বলে তাদের সংকট আরো প্রকট হয়েছিল বলেও মনে করছেন তিনি।

২০ মেগা প্রকল্প
মূলপ্রবন্ধে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সরকারের ২০টি মেগাপ্রকল্পের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। চলমান ২০ প্রকল্পে সরকারের ব্যয় হচ্ছে সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা বা ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যেখানে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ২৭ বিলিয়ন ডলার আর বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে ৪২ দশমিক ৮৬ বিলয়ন ডলার। যার মধ্যে ১৪টি প্রকল্পে ৫০ শতাংশের বেশি বিদেশি ঋণ রয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে যোগাযোগ খাতের প্রকল্প। এ খাতের ১১টি প্রকল্পের বিপরীতে জ্বালানি খাতের ৪টি এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে রয়েছে মাত্র ২টি করে প্রকল্প। অর্থাৎ প্রায় ৫০ শতাংশ বরাদ্দ পেয়েছে যোগাযোগখাত। এখাতে মাত্র ৫-৭ বছরের মধ্যে ৩৫-৪০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের সক্ষমতা নেই বলেও মন্তব্য করেন ড. দেবপ্রিয়।

নির্বাচনী প্রকল্প
মেগা প্রকল্পেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে নির্বাচনের আগে আগে বেশি করে এসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে এ সরকার মেগা প্রকল্পে বেশি গুরুত্ব দেয় বলেও তুলে ধরা হয়। ২০১৪ সাল পর্যন্ত মাত্র দুটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও ২০১৪-১৮ সালের মধ্যে ১৩টি মেগা প্রকল্প গহণ করা হয়। আর ২০১৮ সালের পর নেয়া হয় আরো ৫টি মেগা প্রকল্প। এসব প্রকল্প ২০২৮ সালের মধ্যে শেষ হওয়া কথা থাকলেও এই দশকে তা শেষ হবে না বলেও মনে করেন ড. ভট্টাচার্য। ২০১৮ সালের পর গ্রহণ করা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের হার খুবই দুর্বল বলেও জানান তিনি। যথাযথ প্রাক্কলন না করায় প্রকল্প সংশোধনের মাধ্যমে ব্যয়ও বাড়ছে। ২০টির মধ্যে ৭টি মেগাপ্রকল্প সংশোধন করা হয়েছে।

আসছে ঋণের চাপ
২০টি মেগা প্রকল্পে ৪০টি লোন প্যাকেজ নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ৫টি সহায়তা প্যাকেজও পাওয়া গেছে। তবে মেগা প্রকল্পে অর্থসংগ্রহ বা লোন নেয়ার কাজটি ইআরডি ভালোভাবে করেছে বলেও মন্তব্য করা হয়। বিদেশি ঋণের মধ্যে ৮৪ শতাংশই সহায়তা ও রেয়াতি ঋণ। ১৫ শতাংশ ঋণ নন রেয়াতি বা স্বল্প সময়ের। প্রায় রেয়াতি দুটি ঋণ প্যাকেজ দিয়েছে রাশিয়া। আর চীন স্বল্প সময়ের বা কঠিন ঋণ দিয়েছে ৫টি প্যাকেজের। ফলে ২০২৪ সাল থেকে ১৩টি লোন প্যাকেজ শোধ করা শুরু হবে। যার পরিমাণ দাঁড়াবে ৩২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। প্রকল্পগুলোতে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে রাশিয়া।

ঋণের বড় অংশ যাবে রাশিয়ার কাছে ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ, দ্বিতীয় যাবে জাপানের কাছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। তবে ২১ শতাংশ ঋণ দিয়ে তৃতীয় অবস্থানে থাকা চীন সবার আগে স্বল্প মেয়াদের ঋণের টাকা ফেরত নিতে আসবে। তাই বিদেশি ঋণের পুনঃতফসিল বা মেয়াদ বাড়াতে এখন কাজ করতে বলছেন এ অর্থনীতিবিদ। নয় তো সামনে ২০২৩-২৪ সালে দেশ ব্যাপক চাপে পড়বে বলেও মনে করে তিনি।

বঞ্চিত শিক্ষা-স্বাস্থ্য
পদ্মাসেতু নিজস্ব অর্থায়নে করায় অন্যান্য খাতের বরাদ্দ সেখানে চলে গেছে বলে জনান ড. দেবপ্রিয়। মেগা প্রকল্পের ১৫টি প্রকল্পই ভৌত অবকাঠামো ধাঁচের। এসব মেগা প্রকল্পের কারণে সামাজিক নিরাপত্তা ও শিক্ষা-স্বাস্থ্যখাত বঞ্চিত হয়েছে। ২০১৮ সালে মোট জিডিপির ১ দশমিক ৫২ শতাংশ বরাদ্দ দেয় হয়েছে ২০ প্রকল্পে। যেখানে স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ ছিল তার অর্ধেক বা মাত্র শূন্য দশমিক ৬৪ শতাংশ। আর শিক্ষায় ছিল ১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ২০২১ সালে এসে ২০ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল মোট জিডপির ১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। অন্যদিকে শিক্ষায় ছিল এর চেয়ে কম বা ১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। আর স্বাস্থ্যে তার অর্ধেক বা শূন্য দশমিক ৬১ শতাংশ। পরিকল্পনা কমিশন শুধু মাত্র যোগাযোগ খাতে মেগা প্রকল্পের ৫০ শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে বৈষম্য করেছে বলেও মনে করেন তিনি।

মেগা প্রকল্পে ডুবেছে যারা
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে বেশ এগিয়ে যাওয়ার উদাহরণ রয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক, নাইজেরিয়া ও কেনিয়া মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। তবে সঠিক অর্থায়ন ও অযথা প্রকল্প নিয়ে অনেক দেশে অনেক ঝামেলায় পড়েছে। শ্রীলঙ্কা যার জলন্ত উদাহরণ। একই পরিণতি হয়েছে চাদ, লিথুয়ানিয়া, মায়ানমার ও পাকিস্তানের। মালয়েশিয়াও ধরা খেয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলারের ফরেস্ট সিটি করতে গিয়ে। তাই সঠিক মাপঝোপ করে পথ আগানোর পরামর্শ এ অর্থনীতিবিদের।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন