ঢাকা | বৃহস্পতিবার
২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মিরসরাই ট্রাজেডির ১১ বছর

  • ১১ বছরেও থামেনি স্বজনদের আহাজারি
  • দিনটিকে মিরসরাই ট্রাজেডি দিবস ও রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণার দাবি পরিবারের

মায়ের চাপা কান্নাকে উস্কে দিতে বছরঘুরে আবারো বেদনা হয়ে ফিরেছে ১১ জুলাই। ১১ বছর আগের ১১ জুলাইর কথা মনে পড়তেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সন্তান হারানো মায়েরা। এ কান্নার শেষ কোথায় জানেননা কেউই। সারাবছর হারানো ছেলেকে ভুলে থাকতে পারলেও নিষ্পাপ কোমলমতি সন্তানদের এ দিনে ভুলে থাকতে পারেন না কোন মা।

শোকাবহ মিরসরাই ট্র্যাজেডির আজ ১১ বছর। এ ১১ বছরকে ১১ দিনের চেয়েও কম মনে হয় সন্তান হারানো মা কহিনুর বেগমের। তিনি মিরসরাই ট্রাজেডিতে নিহত রায়হান উদ্দিনের মা। তিনি বলেন, আমার এখনো বিশ্বাস হয়না আমার ছেলে নেই। এইতো সেদিন রায়হান খেলা দেখতে বের হয়েছিলো, সে ফিরে আসবে।

তাঁর সন্তান মারা যাওয়ার ১১ বছর পার হয়েছে শুনতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তিনি জানান, ২০১১ সালে তার ছেলে ৭ম শ্রেণীতে পড়তো। সে হিসেবে এতো দিনে তার ছেলের ডিগ্রি পাস করার কথা।

রায়হান উদ্দিন শুভর সাথে সে ভয়াল দিনের মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নেয় এক অভিভাবক সহ ৪৫ শিক্ষার্থীর তরতাজা প্রাণ। খেলা দেখে আবুতোরাব ফেরা হয়নি তাদের কারোরই।

প্রতিবছর ১১ জুলাই এলে শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন নিহতদের পরিবার, স্বজন, স্কুল শিক্ষক তথা সমগ্র মিরসরাই। হারানো সন্তানদের ছবি বুকে আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে বাবা-মায়েদের কাঁদতে দেখা যায় প্রতিবছরই। কারো বা চোখের পানি ঝরতে ঝরতে এখন হয়ে গেছেন মরা পাথর। চাইলেও কাঁদতে পারেন না এখন তারা।

কথা হয় জুলাই ট্রাজেডি থেকে বেঁচে ফেরা তৎকালীন ৯ম শ্রেণী পড়–য়া সৌরাভ হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, আমারা খেলায় জেতার খুশিতে এতোটাই বিমোহিত ছিলাম যে কখন আমরা খাদের পানিতে পড়ে ট্রাক চাপা পড়েছি কিছুই বলতে পারব না। শুধু দেখছিলাম চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো। আমি বুঝতে পারছিলাম আমি হয়তো মারা যাচ্চি। বের হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে হাত পা ছুঁড়তে থাকি। আমার মতো অন্যরাও চেষ্টা করেছে। একটা সময় আমি বের হতে পারি। অন্যরা পানির ভেতর থেকে টানাটানি করে আমার হাত পা নখ দিয়ে কেটে ফেলেছিলো।

তিনি আরো বলেন, যখন আমি পানি থেকে উঠে উপরে আসি, তখনও বিশ্বাস হচ্ছিলো না আমি বেঁচে আছি। আমার হাত পা নিথর হয়ে যায়। সে মুহুর্তের পর আর কিছুই আমার মনে নেই। আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এরপরই আমি অসুস্থ হয়ে যাই। বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থাকার পর সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরি। আমি বেঁচে ফিরেছি, অন্যরা মারা গেছে এটা মনে হতেই আমার খুব কষ্ট হয়।

বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্ণামেন্ট এর খেলা দেখে ফেরার পথে নিহত হওয়া ছাত্রদের স্বজনদের সমবেদনা জানাতে সেসময় ছুটে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম এইচএম এরশাদ, বিকল্পধারা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দৌজা চৌধুরীসহ দেশের বিশিষ্টজনরা।

ভয়াল মিরসরাই ট্রাজেডিতে নিহত হওয়া ৮ম শ্রেনীর মেধাবী ছাত্র আমিন শরীফের বাবা শাহজাহান বলেন, আমার ছেলে যখন মারা যায় আমি তখন বিদেশে ছিলাম। শেষ সময়ে ছেলেটাকে আমি দেখিনি। এর চেয়ে কষ্টের আমার কাছে আর কিছুই নেই।

তিনি আরো বলেন, আমার ছেলে সহ ৪৫ জন যেখানে নিহত হয়েছে সেখানে পরবর্তীতে অন্তিম নামের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। যখনই ইকোনোমিক জোনের রোড দিয়ে যাতায়াত করি, সে অন্তিমটা নজরে পড়ে। কষ্টে তখন বুকটা ফেটে যেতে চায়।

নিহত ছাত্রদের স্মরণে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে স্থাপন করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’। যার নির্মাতা নিজাম মেস্ত্রি। তার ছেলেও নিহত হয় মিরসরাই ট্রাজেডিতে। বুকের কষ্ট বুকে চেপে পরম ভালোবাসায় নির্মাণ করেছেন স্মৃতিস্তম্ভ আবেগ। নির্মানের পর আবেগে সাঁটানো নিহত ছেলের ছবিতে হাত বুলিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলেন নিজাম মেস্ত্রি। তিনি বলেন, আমার ছেলে মারা যায়নি। সে হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকবে মানুষের আবেগ হয়ে।

কথা হয় নিহত ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম মেধাবী ছাত্র ধ্রুব নাথ জয়ের মা আবুতোরাব ভূঁইয়া একাডেমির শিক্ষিকা সুপ্রীতি রানীর সাথে। তিনিও জানান, এই ১১ বছরে ১ দিনের জন্যও ভুলে থাকতে পারেননি তার ¯েœহের ধ্রুবকে। প্রতিদিনই আশায় থাকেন তার ছেলে ফিরে আসবে কোন না কোন দিন।
আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি বলেন, প্রথম প্রথম কয়েক বছর নিহতদের স্বরণে আনুষ্ঠানিক শোক যথাযথ ভাবে পালন করা হতো। এখন সেখানে ভাঁটা পড়ছে দিনদিন। গেলো দু বছর করোনার জন্য হয়নি আনুষ্ঠানিকতা। এবারও কি কি কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ, তা নিয়ে আমরা এখনো কিছুই জানিনা।

এসময় ১১ জুলাইকে মিরসরাই ট্রাজেডি দিবস ও দিনটিতে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণার জোরালো দাবি জানান সুপ্রীতি রানি।

আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মর্জিনা আক্তার জানান, গত দু বছর করোনা মহামারীর কারণে বড় কোনো কর্মসূচি হয়নি। তবে এবছর সার্বিক পরিস্থিতি অনুকূলে থাকায় আমরা কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। সকালে নিহতদের স্মরণে আবেগ ও দুর্ঘটনাস্থল অন্তিমে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। এরপর স্কুল প্রাঙ্গণে আলোচনা ও শোক সভা এবং র‌্যালি কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। এছাড়াও নিহত স্কুলশিক্ষার্থীদের স্মরণে মসজিদ, মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হবে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন