ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মাইক্রোপ্লাস্টিকের বিপদে বিশ্ব

মাইক্রোপ্লাস্টিকের বিপদে বিশ্ব

পরিবেশ দূষণের জন্য মূলত দায়ী প্লাস্টিক এবং প্লাস্টিকজাত বর্জ্য। সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাবার আগ পর্যন্ত মানুষের জীবনে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার ব্যাপক। এমনকি তিমির মতো গভীর পানিতে বসবাসকারী সামুদ্রিক প্রাণীদের অন্ত্রেও প্রচুর পরিমাণে মাইক্রো প্লাস্টিক খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

প্লাস্টিক যেহেতু পচনশীল নয়, তাই ব্যবহারের পর যেসব প্লাস্টিক পণ্য ফেলে দেয়া হয়, তার অধিকাংশই যুগের পর যুগ একই ভাবে পরিবেশে টিকে থাকে। চা, কফি, জুস কিংবা কোমল পানীয়ের জন্য যেসব প্লাস্টিকের কাপ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো ৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। আর ডায়াপার এবং প্লাস্টিক বোতল ৪৫০ বছর পর্যন্ত পচে না।

প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে শুরু করে দুধের প্যাকেট – এই সবই সাধারণত শুধুমাত্র এক বার ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়া হয়। তাই একে সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিক বলা হয়। যা ধীরে ধীরে নিষিদ্ধ হতে চলেছে বিভিন্ন দেশে।

সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহারের ওপর সবার প্রথমে নিষেধাজ্ঞাটা জারি করেছিল বাংলাদেশ। সেই ২০০২ সালেই এই ধরনের প্লাস্টিকের ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরিবেশ, জীবজগৎ, বন্যপ্রাণী এবং মানুষের জীবন রক্ষায় পরবর্তী কালে বিশ্বের অন্যান্য দেশও বাংলাদেশের পথে হেঁটে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। সর্বশেষ শুক্রবার (১ জুলাই) থেকে দেশে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে ভারত। দেশটিতে বছরে প্রায় ১৪ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়।

জাতিসংঘের মতে, বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশ সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক রূপে নিষিদ্ধ করেছে। যার মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশের ৩০টি দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ।

পরিবেশ বাঁচাতে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ হতে পারে বলে বহুদিন ধরেই নানা রকম জল্পনা চলে আসছে ভারতে। অবশেষে সেই নিষেধাজ্ঞাই এবার কার্যকর হল দেশটিতে। সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিক বা একক ব্যবহারের প্লাাস্টিকের উপর নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিটা আগেই এসে গিয়েছিল। সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয়েছে যে, সারা দেশে শুক্রবার থেকে আর সিঙ্গল-ইউজ প্লাস্টিক বা এক বার ব্যবহার করা যাবে এমন প্লাস্টিক ব্যবহার করা যাবে না। তার পরিবর্তে বিকল্প উপায় অবলম্বন করতে হবে।

সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিকজাত পণ্যর নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি ১৯ ধরনের সামগ্রীও। ক্যারি ব্যাগের পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছে প্লাস্টিকের চামচ, কাঁটা-চামচ, প্লাস্টিকের কাপ, প্লাস্টিকের পতাকা, প্লাস্টিকের ইয়ার-বাডস, প্লাস্টিকের ছুরি, ট্রে প্রভৃতি। আর এই নিষেধাজ্ঞা না-মানলে কঠোর শাস্তি স্বরূপ জরিমানা করা হতে পারে। এমনকী জেল পর্যন্ত হতে পারে। আসলে এক বার ব্যবহারের যোগ্য প্লাস্টিক এবং প্লাস্টিকজাত পণ্য পরিবেশের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক। আর পরিবেশ রক্ষার্থে গোটা বিশ্বের বহু দেশই এই নিষেধাজ্ঞা জারি করার পথে হেঁটে কঠোর ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে।

তার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ১ জুলাই থেকেই ভারতে এই জাতীয় প্লাস্টিকের তৈরি ১৯টি দ্রব্যের ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে। ফলে শুক্রবার থেকে আর সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিক এবং প্লাস্টিকজাত দ্রব্য ব্যবহার করতে পারবেন না দেশবাসী। শুধু তা-ই নয়, কোনও সংস্থাই এই প্লাস্টিক কিংবা প্লাস্টিকজাত দ্রব্য ব্যবহার করতে পারবে না। অর্থাৎ এইগুলো সাধারণ মানুষের কাছেও পৌঁছতে পারবে না। তবে প্লাস্টিক এবং প্লাস্টিকজাত সামগ্রী কোনও সংস্থার কাছে পাওয়া গেলে কিংবা সাধারণ মানুষও এই সব সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার করলে তাদের কড়া শাস্তি দেওয়া হবে।

গত বছর প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা প্লাস্টিক ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত আইন সংশোধন করে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনের অধীনে সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার করলে শাস্তি হিসেবে এক বছরের কারাদণ্ড অথবা এক লক্ষ টাকা জরিমানা ধার্য করা হবে।

আসলে একক-ব্যবহারের প্লাস্টিক খোলা অবস্থায় থাকলে তা থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক নির্গত হয়। আর পরিসংখ্যান বলছে, গোটা বিশ্ব জুড়ে প্রতি মিনিটে প্রায় দশ লক্ষ প্লাস্টিকের বোতল বা ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিক বা প্লাস্টিকজাত পণ্য বিশ্বব্যাপী বিপদ ডেকে আনছে। কারণ এর জেরে আমাদের পারিপার্শ্বিক এলাকা অপরিচ্ছন্ন হয়ে ওঠে।

যা গোটা জীবজগতের জন্যই অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। এমনকী ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত পণ্য নালা-নর্দমায় গিয়ে পড়ে এবং তা জমতে শুরু করে। ফলে নালা-নর্দমার মুখ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর জল মাটির তলায় প্রবেশ করতেও বাধা পায়। শুধু তা-ই নয়, প্লাস্টিকজাত বর্জ্য নদী এবং সাগরের তলদেশেও পৌঁছে যাচ্ছে। যার ফলে সামুদ্রিক জীবজন্তুর জীবনও বিপন্ন হয়ে উঠছে।

সেখানে আবার ইউরোপ মহাদেশে প্লাস্টিকের ব্যাগের ব্যবহারের উপর আলাদা করে কর কিংবা চার্জ ধার্য করা হয়। অন্য দিকে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আবার প্লাস্টিক ব্যাগের তৈরি কিছু সামগ্রী নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চেষ্টা করে চলেছে। তবে বলা ভালো যে, প্লাস্টিকের ব্যবহারের উপর সবচেয়ে কার্যকর নিষেধাজ্ঞা শুধুমাত্র আফ্রিকার দেশগুলোতেই জারি করা হয়েছে।

সম্ভবত সেখানে প্লাস্টিক প্রস্তুতকারীদের একটি শক্তিশালী লবি রয়েছে, আর এখানে প্লাস্টিকের ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞার এটাও একটা বড় কারণ হতে পারে। যদিও বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিকের ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তবে কয়েকটি জায়গা রয়েছে, যেখানে সমস্ত ধরনের প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ। আবার বহু জায়গায় প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর স্বার্থে গ্রাহকদের থেকে আলাদা ভাবে মূল্য নেওয়া হয়।

সেই ২০০৮ সাল থেকেই পাতলা প্লাস্টিকের ফয়েল ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছে চীন। কিন্তু মজবুত প্লাস্টিকের ব্যাগ টাকা দিয়ে কিনে ব্যবহার করা যায়। ২০২০ সালে চীন ঘোষণা করেছিল যে, তারা ধীরে ধীরে প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহারে রাশ টানবে। বর্তমানে চীনের প্রধান শহরগুলোতে পচনশীল নয়, এমন প্লাস্টিকের ব্যাগের ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এই বছর তা গোটা দেশেই কার্যকর করা হবে বলে সূত্রের খবর।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়া সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে তেমন কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে সেখানে এমন কিছু কিছু জায়গা রয়েছে, যেখানে এই সংক্রান্ত আইন প্রযোজ্য। নিউইয়র্ক আমেরিকার দ্বিতীয় জায়গা, যেখানে এই ধরনের প্লাস্টিকের ব্যবহার ২০২০ সালের অক্টোবর মাস থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর আগে ২০১৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত নিয়ম কার্যকর হয়েছে। যদিও এই নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে অবশ্য কিছু ছাড়ও রয়েছে।

২০১৭ সালে কেনিয়া প্লাস্টিকের ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিল। বলা হয় যে, বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর পদ্ধতিতে কেনিয়াতেই এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আর নিষেধাজ্ঞার কারণে এই দেশে প্লাস্টিকের উৎপাদন, আমদানি, এমনকী বিক্রিও সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ। আর এই নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করলে তাকে চার বছরের কারাদণ্ড অথবা ৪০০০০ ডলার জরিমানার সাজা দেওয়া হতে পারে।

ভারতে প্রতিদিন ১.৫ লক্ষ মেট্রিক টন আবর্জনা তৈরি হয়, যার মধ্যে প্লাস্টিকজাত বর্জ্যের পরিমাণ প্রায় ৯৫৮৯ মেট্রিক টন। আর এই প্লাস্টিকজাত বর্জ্য পাদর্থের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ পরিমাণ বর্জ্য পুনর্ব্যবহার যোগ্য। প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থাৎ বেশির ভাগ পরিমাণ প্লাস্টিকজাত বর্জ্য পদার্থ পুনর্ব্যবহার করা যায় না। ফলে তা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

দূষণ বোর্ডের কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরেই সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার প্রস্তুতি নিয়েছেন। আর প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধের জন্য সমস্ত প্লাস্টিক প্রস্তুতকারক সংস্থা, ই-কমার্স সংস্থা, সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিক ব্যাগের সরবরাহকারীদের কাছেও নির্দেশ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি গুটখা, পান মশলা প্রস্তুতকারক সংস্থা এবং রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কাছেও সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করার নিয়ম কার্যকর করার নির্দেশ পাঠানো হয়েছে। আমাদের দেশের বহু রাজ্য ইতিমধ্যেই এমন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এখনও পর্যন্ত আইন মানার ক্ষেত্রে বহু জায়গায় বেশ ঢিলেমিই দেখা যাচ্ছে।

এর স্পষ্ট উত্তর হচ্ছে না। কারণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, এই নিষেধাজ্ঞার ফলে সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার পুরোপুরি ভাবে বন্ধ করা যাবে না। আসলে আমাদের দেশে দূষণের বেশির ভাগটার জন্যই দায়ী প্লাস্টিকজাত বর্জ্য। আর এই ধরনের প্লাস্টিকজাত বর্জ্য পদার্থের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই প্লাস্টিকের বোতল, খাবারের প্যাকেট, প্রসাধনী এবং টয়লেট সামগ্রী।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন