ঢাকা | মঙ্গলবার
২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রেকর্ড উৎপাদনেও শঙ্কা

রেকর্ড উৎপাদনেও শঙ্কা

সৌরতাপে সামুদ্রিক লবণাক্ত পানি থেকে দেশে বাণিজ্যিকভাবে লবণ উৎপাদন শুরু হয় ১৯৬০ সাল থেকে। কক্সবাজারে বাণিজ্যিক সেই চাষ পরে ছড়িয়ে পড়ে উপকূলীয় অন্যান্য জেলাতেও। তবে কক্সবাজারের মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, পেকুয়া, সদর, ঈদগাঁও ও টেকনাফে সবচেয়ে বেশি লবণ চাষ হয়। তবে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলাতেও লবণের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকায় লবণ চাষের ওপর গড়ে উঠেছে দেশের লবণশিল্প। শুধু কক্সবাজারেই লবণ উৎপাদন ও বিপণনে জড়িত ৫ লাখ মানুষ। সারাদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে আরও লাখ লাখ মানুষের। অভ্যন্তরীণ চাহিদার অনেক বেশিও উৎপাদন হয়ে আসছে লবণ।

তবে গত ৬১ বছরের রেকর্ড ভেঙে চলতি মৌসুমে বিপুল পরিমাণ লবণ উৎপাদন করেছেন ‍উপকূলীয় এলাকার চাষিরা। ভোক্তা ও শিল্পখাতে চাহিদার বিপরীতে লক্ষ্যমাত্রার অনেকটা কাছাকাছি ১৮ লাখ ৩২ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হয়েছে এবার। চাষিদের দেয়া তথ্যমতে, যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ উৎপাদন। চাষিরা আরও বলছেন, এখনো প্রচুর লবণ মজুদ রয়েছে মাঠের গর্তে ও গুদামে। তবে তাদের অভিযোগ, মজুদ এসব লবণের হিসাব উৎপাদনের মোট হিসাবের সঙ্গে যুক্ত করেনি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক)। এই ঘটনাকে রহস্যজনক দাবি করছেন চাষিরা।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা বিসিকের মতে, দেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে লবণের চাহিদা ধরা হয় ২৩ দশমিক ৩৫ লাখ টন। এবার ৬৩ হাজার ২৯১ একর জমিতে লবণ চাষ হয়েছে। উৎপাদন ১৮ লাখ ৩২ হাজার টন। মাঠ জরিপের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে লবণ চাষের জমি বৃদ্ধি পেয়েছে ৮ হাজার ৬৩৭ একর। সেই সঙ্গে লবণ চাষির সংখ্যা বেড়েছে ৯ হাজার ৫৩৪ জন। তথ্যমতে, লবণ চাষের জমি ও চাষির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।

এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ১৮ দশমিক ২৪ লাখ টন লবণ উৎপাদিত হয়েছিল। অবশ্য চলতি মৌসুমে সরকার যে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, তা গেল বছরের চাইতে ৫ লাখ টন বেশি। হঠাৎ করে বছরের ব্যবধানে এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে পেছনে রহস্য ছিল বলে লবণ চাষি ও ব্যবসায়ী অনেকের অভিমত। তবে এই ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগী লবণ মিল মালিকদের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট কারো কারসাজি রয়েছে বলেও দাবি মাঠপর্যায়ের চাষি ও ব্যবসায়ীদের।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য বলছে, দেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ লাখ ৫৮ হাজার টন, পরের ২০১৯০-২০ অর্থবছর ১১ লাখ ২১ হাজার এবং ২০২০-২১ অর্থবছর ৪ লাখ ৮৯ হাজার টন লবণ আমদানি করেছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

লবণ উৎপাদনকারী অঞ্চল কক্সবাজারের লবণ ব্যবসায়ীদের অনেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এক বছরের ব্যবধানে এক লাফে ৫ লাখ টন লবণের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পেছনে অন্য রহস্য লুকিয়ে আছে। এর পেছনে লবণ মিল মালিকদের সিন্ডিকেটের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে হাত রয়েছে। তাই চলতি বছর লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা এক লাফে ৫ লাখ টন বাড়িয়ে ২৩ দশমিক ৩৫ লাখ টন করা হয়েছে।

লবণ ব্যবসায়ীরা আরো বলেন, চলতি বছর লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে দেওয়ার পেছনে অন্যতম রহস্য হচ্ছে লবণ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি দেখিয়ে বিদেশ থেকে আমদানির চেষ্টা করা হবে। কোরবানির ঈদে চামড়াজাত শিল্পে ব্যবহারের জন্য লবণ সংকট পড়েছে দেখিয়ে বিদেশ থেকে আমদানির পাঁয়তারা শুরু করেছে সেই মধ্যস্বত্বভোগী মিল মালিক সিন্ডিকেটটি। যা মাঠপর্যায়ের বাস্তবতার সঙ্গে একেবারেই অসঙ্গতিপূর্ণ। তাই সরকারকে এই বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখার জোর দাবি জানাচ্ছেন লবণখাতের ব্যবসায়ীরা।

তবে বছরের ব্যবধানে দেশে একলাফে ৫ লাখ টন লবণের বাড়তি চাহিদা বেড়ে যাওয়া নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বিসিক কক্সবাজার আঞ্চলিক কার্যালয়ের কোনো কর্মকর্তা। তবে নাম প্রকাশ না করে এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিবছর ভোক্তা ও শিল্পখাতে লবণের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ঢাকাতেই। তাই এই বিষয়ে কক্সবাজারের কারো হস্তক্ষেপ বা সমন্বয়ের কোনো সুযোগ অবারিত নেই।

মাঠের চাষিরাও লবণ উৎপাদন নিয়ে সন্তুষ্ট। চলতি অর্থবছরে প্রতিমণ লবণ ২৮০-৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত অর্থবছরে যা ছিল ২০০-২২০ টাকা। কক্সবাজারের সদর উপজেলার চৌফলদণ্ডী ইউনিয়নের লবণ চাষি শাহজাহান মুনির বলেন, এবার যেমন দাম পাচ্ছি তাতে আমি খুশি। গত বছরের তুলনায় প্রতি মণে ৮০-১০০ টাকা বেশি পাচ্ছি। এই বছর এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ লবণ উৎপাদন হয়েছে এতে আর আমদানি প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না। তবে এরপরও যদি আমদানি করা হয় তাহলে বাজারে আমাদের লবণের চাহিদা কমে যাবে। তিনি এবার ৪ একর জমিতে লবণ চাষ করেছেন। গতবারের চেয়ে উৎপাদন প্রায় দেড় গুণ বেশি। কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলার কৈয়ারবিল ইউনিয়নের লবণ চাষি আওরঙ্গজেব মাতবর বলেন, গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত হলেও আমরা খুশি। কারণ, আগের চেয়ে বেশি দামে লবণ বিক্রি করতে পারছি।

বিসিকের কক্সবাজারের লবণ প্রকল্পের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, সরকার চলতি মৌসুমে লবণের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ২৩ দশমিক ৩৫ লাখ টন। চাহিদাও রয়েছে এর প্রায় কাছাকাছি। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদন ৫ লাখ টন কম হলেও লবণের সংকট সৃষ্টির তেমন আশঙ্কা নেই।

বাংলাদেশ লবণ চাষি সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট শহীদুল্লাহ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মৌলভী মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, চলতি বছর আবহাওয়া অনুকূলে ছিল বেশ। তাই ব্যাপকহারে লবণ উৎপাদন হয়েছে একমাত্র উৎপাদনকারী অঞ্চল কক্সবাজারে। তারা বলেন, সরকার কোন জরিপের ভিত্তিতে এইবার ভোক্তা ও শিল্পখাতে লবণের চাহিদা নিরূপণ করেছে তা আমাদের বোধগম্য নয়। মাত্র বছরের ব্যবধানে দেশে এক লাফে ৫ লাখ টন লবণের চাহিদা বেড়ে যাওয়াটা একেবারেই অস্বাভাবিক।

মূলত বিদেশ থেকে লবণ আমদানির অজুহাত খুঁজতেই মধ্যস্বত্বভোগী মিল মালিকেরা সিন্ডিকেট করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই চাহিদা বাড়িয়ে দেওয়ার এই কারসাজি করা হয়েছে বলে মনে করছেন চাষিরা। দুই লবণচাষি নেতা দাবি করেন, বর্তমানেও অনেক লবণ মাঠের গর্তে, গুদামে মজুদ রয়েছে। যা এবারের কোরবানির ঈদে চামড়াজাত করতেও ব্যবহার করা যাবে। কোনোভাবেই বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করতে হবে না। তবে ইতোমধ্যে সেই মধ্যস্বত্বভোগী মিল মালিক সিন্ডিকেট বিদেশ থেকে লবণ আমদানির জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। যাতে দেশীয় লবণ শিল্প মার খায়।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন