ঢাকা | শুক্রবার
৬ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২১শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দুগ্ধশিল্পে বড় সম্ভাবনা

দুগ্ধশিল্পে বড় সম্ভাবনা

রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডিতে বাস করেন রেদওয়ান আহমেদ। দুধের প্রতি তার ছোট থেকেই দুর্বলতা রয়েছে। এখনো প্রতিনিয়ত দুধ পান করেন। তিনি জানান, এখন প্রায় তিন মাস যাবত ৯০ টাকা কেজিতে প্যাকেট দুধ কিনেন। রেদওয়ানের ভাষ্যমতে, দুধ খেলে শরীরটা ভালো লাগে। কাজে গতি পাওয়া যায়। তিনি অন্যদেরও অন্যান্য খাবার কম খেয়ে দুধ পানে উৎসাহিত করে থাকেন।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের পঙক্তি ছিল ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ অর্থাৎ সন্তানের কল্যাণ, নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মায়ের এক চিরন্তনী ভাষ্য। বাংলার ঘরে ঘরে ছিল দুধেল গাভি। প্রাচীন বাংলায় সকলেই কম বেশি দুধ পান করতে পারতেন। নিজেরা গরু লালন-পালন করতেন। ছিল বিপুল পরিমাণ ফাঁকা জমি। সেখানে চড়ে বেড়াত গরু। এখন সেটি চলে গেছে খামারিদের দখলে। মাঝখানে সেই দুগ্ধ উৎপাদনে ভাটা পড়ে। তবে আবার সুদিন ফিরছে দুগ্ধশিল্পে। গত এক যুগে দেশে প্রায় ৫ গুণ বেড়েছে দুগ্ধ উৎপাদন।

ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার শাহিন আহমেদ দীর্ঘদিন যাবত গরু পালন করেন। প্রতিদিন ১৫-২০ কেজি দুধ পান তিনি। শাহিন জানায়, একটি গরু পালনে প্রতিদিন এক থেকে তিনশ টাকা ব্যয় হয়। খড়, ভুসি, অন্যান্য খাবার মিলে এই ব্যয়। সেখানে ১৫ কেজি দুধ পেলে সাড়ে সাতশ টাকা বিক্রি করা সম্ভব হয়। সে হিসেবে গ্রাম ও শহরে কেজিতে প্রায় ৪০টাকা দামে পার্থক্য।

দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি হারের কারণে দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভবপর হয়নি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আয় স্বল্পতায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত বেশির ভাগ পরিবারই দুধের স্বাদ নিতে পারে না। দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে এ মুহূর্তে গো-খাদ্যের দাম বৃদ্ধিসহ নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে প্রাণিখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খামারিদের সহযোগিতার মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে দুগ্ধ উৎপাদন কার্যক্রম চলমান রাখতে পারলে বাংলাদেশ অচিরেই দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে দুগ্ধশিল্প উন্নয়নে চার হাজার ২৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে চলমান ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন (এলডিডিপি) প্রকল্প’ দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ দুধ উৎপাদন হয় এশিয়াতে। দুধ উৎপাদনে বিশ্বের একনম্বরে রয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। বাংলাদেশের অবস্থান (গরু, ছাগল ও মহিষের দুধ) বিশ্বের ২৩ নম্বরে। খামারিদের ভাষ্যমতে, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের অভাব, মানসম্পন্ন দুধ সরবরাহ না করা, ভেটেরিনারি চিকিৎসক সংকট, দুধ প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণ করতে না পারা, ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এবং বিদ্যুতের মূল্য কৃষিভিত্তিক শিল্পের চেয়ে অনেক বেশি হওয়াও উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। উৎপাদন খরচের সঙ্গে সমন্বয় করে দুধের দাম নির্ধারণের দাবিও উঠেছে খামারিদের পক্ষ থেকে। গত ২৯ জুন ‘পরিবেশ, পুষ্টি ও আর্থসামাজিক ক্ষমতায়নে টেকসই ডেইরি সেক্টর’ শিরোনামে ২০২২ সালের বিশ্ব দুগ্ধ দিবসটি পালিত হয়েছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে দুধের মূল উৎস গরু। ৯০ শতাংশ দুধ আসে গরু থেকে, আট শতাংশ আসে ছাগল থেকে এবং দুই শতাংশ আসে মহিষ থেকে। ১৯৮৯-৯০ থেকে ২০০১-০২ অর্থবছর পর্যন্ত দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির হার ২.৪ শতাংশ, ২০০৯-১০ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির হার ১৬.৪৪ শতাংশ। ২০১০-১১ অর্থবছরে দুধের উৎপাদন ছিল ৩৪.৬০ লাখ মেট্রিক টন, যা বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে হয়েছে এক কোটি ১৯ লাখ ৮৫ হাজার লাখ টন।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা) ড. হোসেন মো. সেলিম জানান, ২০২০-২১ অর্থবছর দুধের চাহিদা এক কোটি ৫৪ লাখ ৯৪ হাজার টন চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি ১৯ লাখ ৮৫ হাজার টন। অর্থাৎ প্রায় ৩৫ লাখ টন দুধ ঘাটতি ছিল। সদ্য সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে দুধ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২.৮৫ মিলিয়ন টন বা এক কোটি ২৮ লাখ ৫০ হাজার টন। দেশের সম্ভাব্য জনসংখ্যা ১৭ কোটি ১৬ লাখ ৮০ হাজার ধরলে দুধের চাহিদা এক কোটি ৫৬ লাখ ৬৫ হাজার টনে দাঁড়ায়। অর্থাৎ দুধ উৎপাদন গত বছরের এক কোটি ১৯ লাখ ৮৫ হাজার টন থেকে বেড়ে যদি এক কোটি ২৮ লাখ ৫০ হাজার টনেও দাঁড়ায় তা হলে ২৮ লাখ টনেরও বেশি দুধের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।

দুগ্ধখাত-সংশ্লিষ্টদের হিসেবে দেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার গুঁড়া দুধ আমদানি করা হয়, যা মোট দুধের চাহিদার ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা মতে, দেশে বর্তমানে যে পরিমাণ দুধ উৎপাদন হয়, তার মাত্র সাত শতাংশ বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত হয়ে বাজারে আসে।

দুধের বিপণন ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪০০টি ভিলেজ মিল্ক কালেকশন সেন্টার (ভিএমসিসি) স্থাপন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রব্বানী। দুগ্ধশিল্প উন্নয়নে সরকার চার হাজার ২৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

মিল্কভিটার সাবেক পরিচালক আবদুস সামাদ ফকির জানান, আগের চেয়ে খুব খারাপ অবস্থায় আছে দেশের খামারিরা। গত কয়েক বছরে গো-খাদ্যের দাম প্রায় ডাবল হলেও দুধের দাম বাড়েনি। এখনো ৩৮ থেকে ৪০ টাকা লিটারে বিক্রি করতে হয় আমাদের।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ডা. মনজুর মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা বলেন, এলডিডিপি প্রকল্পের আওতায় আমরা সারা দেশে পাঁচ হাজার ৫০০ দুধ প্রডিউসার গ্রুপ তৈরি করতেছি। এ ছাড়া আরেক প্রকেল্পর আওতায় ফার্মার্স গ্রুপ আছে। ওখান থেকে আবার আমরা প্রডিউসার গ্রুপ তৈরি করেছি ১২০টি। এলডিডিপি প্রকল্পের মাধ্যমে দুধের স্বল্পতা আছে তার পূরণ করা হবে। তাছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন