চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কদমরসূল এলাকায় বিএম কনটেইনার ডিপোর ভয়াবহ বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ডের পর শিপিং কোম্পানিগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে কেমিক্যাল পরিবহন বন্ধ করে দেয়ায় সংকটের মুখে পড়েছে দেশের শিল্পোৎপাদন। সারাদেশে কেমিক্যাল-নির্ভর কারখানাগুলোতে কাঁচামাল সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। বহু কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে কেমিক্যাল বোঝাই কনটেইনার হ্যান্ডলিং বন্ধ থাকায় সংকট আরো প্রকট হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে।
সূত্রমতে, বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের পর কেমিক্যাল হ্যান্ডলিংয়ে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা গ্রহণ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দরের সতর্কাবস্থার জের ধরে বিভিন্ন শিপিং কোম্পানি কেমিক্যাল পরিবহন বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশের শত শত কেমিক্যাল-নির্ভর কারখানা চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কেমিক্যাল আমদানি করে। দেশের গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, ওষুধ খাতসহ কৃষি ও শিল্পের প্রায় প্রতিটি খাতেই রয়েছে বিভিন্ন কেমিক্যালের ব্যবহার। এসব কেমিক্যালের সিংহভাগ আমদানি করা হয়। নানা দেশ থেকে আনা কেমিক্যালের চালান জাহাজে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা কলম্বো বন্দর হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। মূলত এসব কেমিক্যাল ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট হয়ে চট্টগ্রামে পৌঁছায়। এখান থেকে খালাস করে বিভিন্ন শিল্প কারখানায় ব্যবহার করা হয়। চলে উৎপাদন কার্যক্রম।
বিএম কনটেইনার ডিপোর ঘটনার পর বিশ্বের নানা দেশ থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে কেমিক্যাল পরিবহন বন্ধ করে দেয় সংশ্লিষ্ট শিপিং এজেন্সিগুলো। তারা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দোহাই দিয়ে কেমিক্যাল বোঝাই কনটেইনার গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। এর মধ্যে ফায়ার এক্সটিংগুইসার, ফ্রিজের গ্যাস, এথেলিন অক্সাইড, সালফার ড্রাই অক্সাইড, সিলিন্ডার, সালফার হেক্সাফ্লোরাইড, সকল ধরনের গ্যাস সিলিন্ডার কার্গো, অর্গানিক পারঅক্সইড, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, এমুনিয়াম নাইট্রেট, পটাসিয়াম নাইট্রেট, পটাসিয়াম ক্লোরাইড, রেড ফরফরাসসহ সব ধরনের কেমিক্যাল পণ্য গ্রহণ করছে না মেইন লাইন অপারেটররা।
একাধিক মেইন লাইন অপারেটরের (এমএলও) প্রতিনিধির সাথে কথা হলে তারা জানান, বিএম কনটেইনার ডিপোর দুর্ঘটনার পর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কেমিক্যাল হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে বাড়তি কড়াকড়ি আরোপ করে। এই অবস্থায় তারা কেমিক্যাল বোঝাই কনটেইনার পরিবহন করছে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর কেমিক্যাল আমদানি হয় উল্লেখ করে তারা বলেন, ঝুঁকি না নেয়ার জন্যই কার্যত বন্দর কর্তৃপক্ষ কেমিক্যাল পরিবহন এবং হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করেছে। আর এই কড়াকড়িতে মেইন লাইন অপারেটররা কেমিক্যাল পণ্য পরিবহন বন্ধ করে দেয়। এর ফলে সারা দেশে কেমিক্যাল-নির্ভর কারখানাগুলোতে কাঁচামাল সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। বহু কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে।
জাপান-বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত জেএমআই গ্রুপ গত ২৬ জুন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বরাবরে লিখিত এক পত্রে বলেছে, কেমিক্যাল হ্যান্ডলিং বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের কারখানায় উৎপাদন হুমকির মুখে পড়েছে। জেএমআই গ্রুপ দেশের মেডিকেল ডিভাইস ডিসইনফেক্টেট করার কেমিক্যাল উৎপাদন করে। তারা এথেলিন অক্সাইডের সাথে কার্বন ড্রাইক্সাইডের মিশ্রণ করে মেডিকেল ইকুইপমেন্ট জীবাণুমুক্ত করার কেমিক্যাল উৎপাদন করে। এই ধরনের কেমিক্যাল উৎপাদনকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান জেএমআই। বিদেশ থেকে কেমিক্যাল আমদানি করতে না পারায় এই কোম্পানির উৎপাদন হুমকির মুখে বলে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক স্বাক্ষরিত পত্রে বন্দর কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নেতা মাহফুজুল হক শাহ বলেন, কেমিক্যাল হ্যান্ডলিং বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। বিভিন্ন কারখানা ভয়াবহ রকমের সংকটে পড়তে যাচ্ছে। তিনি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি নিয়ে মেইন লাইন অপারেটর এবং আমদানিকারকদের সাথে বৈঠক করে একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
মাহফুজুল হক শাহ আরও বলেন, কেমিক্যাল বাদ দিয়ে বর্তমান সময়টা কল্পনাও করা যায় না। গার্মেন্টস থেকে শুরু করে সব কারখানায় কম-বেশি কেমিক্যাল লাগে। এখন এই কেমিক্যাল যদি হ্যান্ডলিং না হয়, দেশে না আসে, তাহলে বড় বিপদে পড়তে হবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে এই ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা তো নতুন কোনো নিয়ম চালু করিনি। ডিজি কার্গো বা কেমিক্যাল হ্যান্ডলিংয়ের একটি নীতিমালা রয়েছে। রয়েছে কিছু নিয়ম-কানুন। আমরা শুধু সেই নিয়ম-কানুন অনুসরণ করতে বলছি। কেমিক্যাল বোঝাই কনটেইনার বন্দরের ইয়ার্ডে না রেখে অনচেসিস ডেলিভারির কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর প্রণীত নীতিমালা অনুযায়ী এই ধরনের পণ্য জাহাজের হুক পয়েন্ট থেকে ডেলিভারি নিতে হবে। কিন্তু তা না করে কেউ যদি বন্দরকে ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যালের গুদাম বানাতে চায় তাহলে তো আমাদের কিছু করার নেই। আমরা তো বন্দরকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারি না। মেইন লাইন অপারেটরদের বিদেশে কনটেইনার গ্রহণ না করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিদেশি জাহাজ মালিকেরা কোন কনটেইনার নেবে না নেবে সেটি তাদের ব্যাপার। তবু আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সর্বশেষ সার্কুলার মূলে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানিযোগ্য বিপজ্জনক/ হ্যাজার্ডাস কার্গো/ কনটেইনার বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী পরিবাহিত হয়। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নির্দেশনা অনুসরণ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এ ধরনের পণ্য হ্যান্ডলিং করে। বিপজ্জনক পণ্য হ্যান্ডলিং সম্পর্কে বন্দর কর্তৃপক্ষ কোনো পরিবর্তন, আদেশ কিংবা নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি। প্রচলিত নিয়মেই চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে এ ধরনের পণ্য এবং কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হচ্ছে।
অথচ সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম বন্দরকে উদ্ধৃত করে বিপজ্জনক/ হ্যাজার্ডাস কার্গো/ কনটেইনার হ্যান্ডলিং সংক্রান্ত স্ব-প্রণোদিত বিজ্ঞপ্তি/তথ্য জারি করা হচ্ছে, যার সাথে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এরূপ বিজ্ঞপ্তি/ তথ্য জারি করার ফলে বন্দর ব্যবহারকারী তথা আমদানি-রপ্তানিকারকদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে।
বন্দরের ট্রাফিক ম্যানেজার স্বাক্ষরিত পত্রটির পরও মেইন লাইন অপারেটররা কেমিক্যাল ভর্তি কন্টেনার গ্রহণ করছে না। গত ২৬ জুন চীন থেকে কেমিক্যাল আনার চেষ্টা করে জাহাজিকরণে রাজি করানো সম্ভব হয়নি জানিয়ে মাহফুজুল হক শাহ বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষের স্পষ্ট অবস্থানের পরও শিপিং কোম্পানিগুলোর এই ধরনের আচরণ দুঃখজনক। এতে করে শিল্প কারখানাগুলোর সংকট ক্রমাগত বাড়ছে।
আনন্দবাজার/শহক