ঢাকা | শুক্রবার
১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বন্যা ভয়ঙ্কর জলবায়ুর প্রভাবে

বন্যা ভয়ঙ্কর জলবায়ুর প্রভাবে

প্রবল বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলের কারণে সিলেট বিভাগের বন্যা বাংলাদেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এমন মন্তব্য যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামের একজন দাতব্যকর্মীর। সেই কর্মীর বক্তব্য উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। যেখানে বাংলাদেশের চলমান বন্যাকে রেকর্ড ভাঙা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। গত সোমবার প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে বার্মিংহামের অ্যাস্টন-ভিত্তিক দাতব্য সংস্থা গ্লোবাল রিলিফ ট্রাস্টের কর্মী আতিকুর বলেছেন, অপ্রত্যাশিত ভারী বর্ষণ ও একইসঙ্গে ভারতীয় বাঁধ থেকে পানি ছেড়ে দেওয়ায় ব্যাপক এই বন্যার সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করেছেন বাসিন্দারা। এমনকি এই ধরনের বন্যা ‘জীবনে একবার’ (ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম) দেখা যায় বলেও জানিয়েছেন তারা।

বিবিসি বলছে, ভারত ও বাংলাদেশে প্রবল বৃষ্টিপাত ও মৌসুমী ঝড়ের ফলে সৃষ্ট বজ্রপাত ও ভূমিধসে কয়েক ডজন মানুষ মারা গেছেন বলে জানা গেছে। একইসঙ্গে ভয়াবহ এই বন্যায় লাখ লাখ মানুষ আটকা পড়েছেন। প্রতিবেদনে আতিকুর রহমান জানিয়েছেন, তিনি ৮০ বছরেরও বেশি বয়সী একজনের সঙ্গে কথা বলেছেন, যিনি তার জীবনে বন্যার এতো খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি। প্রশাসন আর স্থানীয়রাও তাকে জানিয়েছেন, গত ৮০ বা ১০০ বছরের মধ্যে বন্যা পরিস্থিতি এতটা খারাপ তৈরি করেনি।

আতিকুর জানিয়েছেন, যুক্তরাজ্যের ওয়েস্ট মিডল্যান্ডস এলাকায় বাসবাসরত বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ মূলত সিলেটের সেই ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের। তাই ওয়েস্ট মিডল্যান্ড কমিউনিটিকে বাংলাদেশের বন্যার বিষয়ে আরও মনোযোগ দিতে এবং দান করতে আহ্বান জানিয়েছেন আতিকুর রহমান।

সিলেট বিভাগের স্মরণকালের ভয়াবহ সেই বন্যা পরিস্থিতি এখনো সামাল দিতে পারছে না দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সিলেট। বন্যার পানি ধীরে ধীরে নামতে থাকলেও এখনও আশ্রয়কেন্দ্র থেকে নিজ বাড়িতে ফিরতে পারেননি অনেক বন্যার্ত। আশ্রয়কেন্দ্রে নানা সংকটে দিন কাটছে মানুষের। ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন অনেকে। তবে এমন পরিস্থিতির মধ্যেই গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে সিলেট জেলায় থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে।

স্থানীয়রা বলছেন, সকাল থেকে সিলেটের আকাশ মেঘে ঢাকা। সূর্যের দেখা মেলেনি। থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ার কারণে নগরের বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ। যারা ঘরে ফিরেছেন কিংবা যারা আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা নতুন করে শঙ্কায় পড়েছেন।

বন্যার পানি নেমে যাওয়ার কারণে যেসব এলাকায় ইতোমধ্যে বানভাসীরা গিয়ে বাসবাস শুরু করেছেন কিংবা বসবাসের প্রস্তুতি নিয়েছেন তাদের আবার নতুন দুর্যোগে পড়তে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা বলছেন, সিলেটে আগামী আরও কয়েকদিন বৃষ্টিপাত হতে পারে। তাছাড়া ভারতেও বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। তবে আসাম মেঘালয়ে আগের মতো ভারী বৃষ্টি হলে উজানের ঢলে সিলেটে নতুন করে বন্যা দেখা দিতে পারে।

সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, চলতি বছর ভারতের চেরাপুঞ্জিতে যে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে তা ১২২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সেই পানিই ভাটিতে নেমে এসে সিলেট, সুনামগঞ্জ ছাড়াও উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামে অসময়ে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই স্থানীয় আবহাওয়া বিরূপ আচরণ করছে। কখনও অতিবৃষ্টি বা বর্ষণ কখনও আবার বৃষ্টিহীনতা বা দীর্ঘ খরা দেখা দিচ্ছে। একই কারণে উজানে বৃষ্টির ধরন যেমন বদলে গেছে, তেমনি বাংলাদেশেও বদল ঘটেছে। আগে যে সময়ে মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশে আসতো গত কয়েক বছরে সেই সময়ে অনেকটা এগিয়ে এসেছে। আবার বিদায় নেয়ার সময়ও পেছনে চলে গেছে।

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, আগের মতো আর ছয় ঋতুর দেখা মিলছে না। গ্রীষ্মকালে অনেক সময় কুয়াশা পড়ছে। আবার বর্ষকাল হয়ে যাচ্ছে পুরোপুরি গ্রীষ্মকালের মতো। অন্যদিকে শীতের যেমন হঠাৎ তীব্রতা দেখা যাচ্ছে, তেমনি বড় শহরগুলোতে শীতকাল ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে বৃষ্টি কিংবা খরায় প্রভাব পড়ছে। আর ফলশ্রুতিতে শুধু বন্যাতেই নয়, পুরো ইকোসিস্টেমের ওপরও বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে।

নদী ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাতের মতে, বাংলাদেশের উজানে বিশেষ করে চেরাপুঞ্জিতে প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণেই এবার বন্যা হয়েছে। দেশের ভেতরের বৃষ্টিপাতে বন্যা হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামীতে উজানে বৃষ্টি আরও বাড়বে। উজানে বৃষ্টি বাড়লে দেশের মধ্যে অল্প বৃষ্টিতেই বন্যা হতে পারে। ড. আইনুন নিশাতের পরামর্শ হচ্ছে, শুধু বৃষ্টি নয়, বন্যা ঠেকাতে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে হবে। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে কীভাবে বাঁধ দিয়ে শহর রক্ষা করা যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে।

ড. আইনুন নিশাত মনে করছেন, বর্ষায় নদী কানায় কানায় ভরবে সেটা স্বাভাবিক, তবে সেই পানি শহরে ঢুকে পড়লে তা ঠেকানোর দায় প্রকৃতির নয়, মানুষের। সেজন্য বৃষ্টির পূর্বাভাস আর বন্যার বিষয় মাথায় রেখেই পরিকল্পনা করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশ প্রকৃতির আচরণ পরিবর্তনের বিষয় উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলছেন, গত একশ বছরের বৃষ্টির ধরণ দেখলে বোঝা যায় কী পরিমাণ পরিবর্তন ঘটেছে। তার মতে এই পরিবর্তনটাই আমাদের জীবনে বড় শঙ্কার কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে।

জলবায়ুর পরিবর্তন জনিত কারণে বন্যার ভয়াবহতা বাংলাদেশে বেড়েই চলেছে। একই সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রতিবছর আগের বছরের রেকর্ড ভাঙছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে বলা হয়েছে, বিগত ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল অবধি বন্যায় দেশে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর আর্থিক পরিমাণ এক লাখ এক হাজার ৮৮ কোটি টাকা। যে টাকা দিয়ে তিনটির বেশি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত।

বিবিএসের সেই জরিপের ফলাফল ‘বাংলাদেশ ডিজাস্টার রিলেটেড স্ট্যাটিসটিকস (বিডিআরএস) ২০২১: ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ন্যাচারাল ডিজাস্টার পারসপেক্টিভস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়, দেশে আঘাত হানা নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বন্যাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল অবধি ছয় বছরে দেশে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে এক লাখ ৭৯ হাজার ১৯৮ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যার মধ্যে বন্যাতেই ক্ষতির ৫৬.৪১ শতাংশ।

বিবিএস জানায়, এই জরিপ দেশের ৬৪ জেলার ১১টি প্রধান দুর্যোগের বিপরীতে দুর্যোগপ্রবণ এলাকা থেকে খানা ধরে ধরে ডিজিটাল পদ্ধতিতে দীর্ঘ প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে করা হয়েছে। যে জরিপের মূল ভিত্তি ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের অনুঘটক তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, কার্বন নিঃসরণ, গ্রিন হাউজ গ্যাস প্রভৃতি।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের উজানে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় আগামীতে বর্ষণ আরও বাড়তে পারে। যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়াবহ বন্যা হতে পারে। আর এসব বিষয় মাথায় রেখেই বন্যা প্রতিরোধ পরিকল্পনার নকশা তৈরি করতে হবে। তারা বলছেন, দেশের নদীগুলো উজান থেকে আসা পানি ধরে রাখার মতো অবস্থায় আর নেই। তাই নদ-নদীর পানি ধারন ক্ষমতা বাড়ানো ছাড়াও খনন আবার বাধ নির্মাণে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। এসব বড় পরিকল্পনা নেয়ার সময় আবাসিক এলাকা আর ফসলি জমি আলাদাভাবে দেখার ওপর জোর দিতে হবে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন