পেঁয়াজ মসলা জাতীয় পণ্য হলেও দেশে অনেকেই এটিকে সবজির মতোই ব্যবহার করছেন। পাঁচজন মানুষের জন্য রান্না করা তরকারিতে যেখানে একশ গ্রাম পেঁয়াজ হলেই চলে সেখানে সবজি হিসেবে প্রয়োজন হয় তিনশ থেকে চারশ গ্রাম। এর সঙ্গে অন্যান্য সবজিতে তো আছেই। এতে মসলা জাতীয় পণ্য পেঁয়াজ রূপান্তরিত হচ্ছে শাকসবজিতে। এসব কারণে দেশে চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত উৎপাদন হলেও আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে পেঁয়াজ।
এক কেজি পেঁয়াজ উৎপাদনে চাষিদের খরচ যেখানে ২০-২৫ টাকা, মৌসুমে তা বিক্রি হয় মাত্র ৭-৮ টাকা কেজিতে। এমন পরিস্থিতিতে এবার পেঁয়াজের আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে সরকার। তবে তাতে পেঁয়াজের সুব্যবহার নিশ্চিত না হয়ে বরং উল্টোপথে ঘুরে গেছেন ব্যবসায়ীরা।
ক্রেতা বিক্রেতাদের হিসাবে, গত ২১ দিনে প্রতি কেজি পেঁয়াজে দাম বেড়েছে ২০ টাকা করে। কোথাও কোথাও আবার সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে কেজিতে ৫-২০ টাকা করে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষদিন গত ৭ জুন শফিকুল ইসলাম নামে এক ক্রেতা রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে পেঁয়াজ কিনেছিলেন মাত্র ৩৫ টাকা কেজি দরে। অথচ সেই একই বাসার জাকির হোসেন গতকাল সোমবার কিনেছেন ৫০ টাকা কেজি দরে।
রাজধানীর কাঁঠালবাগান এলাকার মুদি দোকানী সাঈদ জানান, সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ১০ টাকা। কাঁটাবন বাজারের বিক্রেতা ইয়াকুব জানান, বর্তমানে ৫৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ। সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ১০ টাকা। তবে দেশের বৃহৎ পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে কেজিতে ২০ টাকা।
গত রবিবার প্রতিকেজি বড় আকারের দেশি পেঁয়াজ ৫২-৫৫ টাকা ও ছোট আকারের পেঁয়াজ ৪০-৪২ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। অথচ গত সপ্তাহের শুরুর দিকে বাজারে বড় পেঁয়াজ ৩৫-৩৭ টাকা ও ছোট পেঁয়াজ ২৫-৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। দেশি পেঁয়াজ ছাড়া বাজারে আমদানি করা কোনো পেঁয়াজের সরবরাহ নেই বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
মেসার্স গ্রামীণ বাণিজ্যালয়ের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ রাজু বলেন, গত ৫ মের পর থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন (আইপি) পায়নি আমদানিকারকরা। এর দুই সপ্তাহের মধ্যে আমদানি করা পেঁয়াজের সরবরাহ শেষ হয়ে যায়। ফলে মের মাঝামাঝি থেকেবাজারে শুধু দেশীয় পেঁয়াজের সরবরাহ রয়েছে। চাষিরা যাতে ভালো লাভ করতে পারে সরকার সেজন্য আমদানি বন্ধ রাখে। তবে গত দেড় মাসে দেশীয় পেঁয়াজের সরবরাহ অনেকটা কমেছে। এর ওপর সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলায় সাম্প্রতিক বন্যায় কৃষকের অনেক পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। এতে বাজারে সরবরাহও কমেছে। এতে অস্বাভাবিকহারে বেড়ছে পেঁয়াজের দাম।
হিলি স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন-উর রশিদ বলেন, ইমপোর্ট পারমিট (আইপি) মেয়াদ শেষ হওয়ায় হিলি স্থলবন্দর দিয়ে গত ৫ মে ঈদুল ফিতরের পর ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি শুরু হলে সরবরাহ বাড়বে। তখন দামও কমে আসবে। হিলি স্থলবন্দর ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির জন্য সব সময় প্রস্তুত রয়েছে।
দেশীয় কৃষকের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে গত ৬ মে থেকে ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে ইমপোর্ট পারমিট (আইপি) দেয়নি সরকার। তখন থেকে দেশের সব বন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরে পেঁয়াজের চাহিদা ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টনের বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ৩৬ লাখ ৪১ হাজার টন। তবে ক্ষেত থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছতে (সংগ্রহোত্তর ক্ষতি, নষ্ট হওয়া ও রান্নার সময় ফেলে দেয়া অংশ) ২৫ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। সে হিসেবে, দেশে নষ্ট হওয়া পেঁয়াজের পরিমাণ প্রায় ৯ লাখ টন। এছাড়া আবাদ করা পেঁয়াজের প্রায় ২ শতাংশ পরবর্তী বছরের বীজের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। অর্থাৎ দেশে প্রায় ৮ লাখ টন পেঁয়াজের ঘাটতি রয়েছে। গত অর্থবছরে পেঁয়াজের চাহিদা ছিল ৩৫ লাখ টন। ওই বছর উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণ ছিল ৩৩ লাখ ৬২ হাজার টন।
কৃষিবিভাগের তথ্যমতে, মাথাপিছু দৈনিক ৩৫ গ্রাম করে ব্যবহার ধরে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে ২৪ লাখ টন। দেশে উৎপাদিত ১৮ লাখ টনের বেশি পেঁয়াজের মধ্যে সংরক্ষণের অভাবে পচে নষ্ট হয় ৫ থেকে ৭ লাখ টন। এই ঘাটতি পোষাতে প্রতিবছর ভারত, মিয়ানমার, চীন, মিসর, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ১০ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। কৃষিবিদরা বলছেন, দেশে পেঁয়াজ সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা থাকলে বড় জোর ৪ লাখ টন আমদানি করতে হতো। শুধু সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকার কারণে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে প্রতিবছর বড় ধরনের লোকসান গুনতে হচ্ছে চাষিদের।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবের বরাত দিয়ে ১৭ মে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী বলেন, প্রতি কেজি পেঁয়াজ উৎপাদনে কৃষক-পর্যায়ে খরচ হয় ২০ থেকে ২১ টাকা। স্থানভেদে এ খরচ বেশিও হয়। সব মিলিয়ে কৃষক-পর্যায়ে ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজি দাম হলে খুচরা পর্যায়ে তা বিক্রি হয় ৪০ থেকে ৪৫ টাকার মধ্যে। এই দামে পেঁয়াজ খাওয়ার ক্ষমতা ভোক্তাদের আছে। তিনি আশা করে বলেন, ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) অধীন মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র ফরিদপুরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মুশফিকুর রহমান দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, পেঁয়াজ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় হয়েও বছরে ১০ লাখ টনের মতো আমদানি করতে হয়। শুধু সংরক্ষণের অভাবের কারণেই এই আমদানি নির্ভরতাসহ লোকসান বেড়েছে। দেশে পেঁয়াজ সংরক্ষণে রয়েছে মাত্র একটি হিমাগার।
বারির অধীন বগুড়ার শিবগঞ্জে মসলা গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মাজহারুল আনোয়ার দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, দেশে আলু সংরক্ষণের মতো পেঁয়াজের জন্য কোনো সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। স্থানীয়ভাবে স্বল্প পরিমাণে যে ব্যবস্থা রয়েছে তাতে ৬ মাস সংরক্ষণ করা যায়। সংরক্ষণাগার আরো বাড়াতে হবে।
পেঁয়াজের আমদানি নির্ভরতা কমাতে রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে বলে জানান ড. মো. মাজহারুল আনোয়ার। তিনি বলেন, সেই রোডম্যাপে প্রাধান্য পাবে বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ। সরকারি পর্যায়ে এখন অবধি দেড় হাজার থেকে এক হাজার ৮শ কেজি বীজ উৎপাদন করা হয়। তবে আমাদের লক্ষ্য কৃষকরাই বীজ উৎপাদন ও আবাদ করবেন। বছরে পেঁয়াজের প্রায় ৫-৬ লাখ টন ঘাটতি পূরণে বারি-৪ গ্রীষ্মকালে চাষে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
আনন্দবাজার/শহক