ঢাকা | শুক্রবার
৭ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
২২শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মোবাইল ব্যাংকিংয়ে বিস্ময়

মোবাইল ব্যাংকিংয়ে বিস্ময়

এপ্রিলেই ৯৩ হাজার কোটি টাকার রেকর্ড লেনদেন

  • মাস হিসেবে এযাবত কালের সর্বোচ্চ লেনদেন

ব্যাংকে না গিয়েও আর্থিক সেবা। দুই দশক আগেও যা ছিলো কল্পনাতীত। দেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহার শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে। তবে এই ফোনই যে একসময় আর্থিক লেনদেনের একটি বড় মাধ্যম হয়ে উঠবে তা ভাবনাই আসেনি কারো। এক দশক আগে মোবাইল ব্যাংকিং শুরু হলেও এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ছিলো অনেক প্রশ্ন। তবে এক দশকের ব্যবধানে এখন হয়ে উঠেছে প্রতি মুহূর্তের আর্থিক প্রয়োজনে অপরিহার্য অংশ। বিকাশ, রকেট, নগদের মতো সেবা এখন চাহিদা মেটাচ্ছে নগদ টাকার। মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) মাধ্যমে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে লেনদেন হয়েছে ৯৩ হাজার কোটি টাকা; যা একক মাস হিসেবে সর্বোচ্চ লেনদেনের রেকর্ড।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, শহর বা গ্রাম, দেশের যে কোনো অঞ্চল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে টাকা পাঠানোর অন্যতম একটি মাধ্যম মোবাইল ব্যাংকিং। শুধু টাকা পাঠানো নয়, দৈনন্দিন কেনাকাটা, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানিসহ বিভিন্ন বিল পরিশোধও করা যাচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতনও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দিচ্ছে। ঋণসুবিধাসহ যোগ হয়েছে নতুন নতুন নানা সেবা। ফলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ওপর আগ্রহের পাশাপাশি নির্ভরশীলতা বাড়ছে। এসব কারণে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক সেবার পরিধি বাড়ছে। এর ফলে এখন দৈনিক চার হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হচ্ছে বিকাশ, রকেট, নগদের মতো সেবার মাধ্যমে। বর্তমানে বিকাশ, নগদ, রকেট, এমক্যাশসহ মোট ১৩টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিংয়ে আর্থিক সেবা দিচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, টাকা জমা-উত্তোলন, স্থানান্তর, বিল পরিশোধ মিলে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় লেনদেন হয়েছে ৯৩ হাজার ৩২ কোটি টাকা। যা গত বছরে (২০২১ সাল) একই সময়ের (এপ্রিল) চেয়ে ৪৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেশি। গতবছর এপ্রিলে এ সেবায় লেনদেন হয়েছিল ৬৩ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। চলতি বছরের এপ্রিল মাসের এ লেনদেন একক মাস হিসেবে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। তবে ডাক বিভাগের সেবা ‘নগদ’-এর তথ্য প্রতিবেদনে যুক্ত করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ, সেবাটি এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্সপ্রাপ্ত নয়। নগদের হিসাব যোগ করলে মোট লেনদেন আরও ২৭ হাজার কোটি টাকা বেড়ে যাবে। সেই হিসেবে এমএফএসে লেনদেন দাঁড়াবে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা; আর দৈনিক দেনদেনের পরিমাণ হবে ৪ হাজার কোটি টাকা।

এর আগে একক মাস হিসেবে চলতি বছরের মার্চে সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছিল ৭৭ হাজার ৩০২ কোটি টাকা। চলতি বছরের এপ্রিল শেষে এ খাতে নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ কোটি ৮ লাখ ৯৩ হাজার ৩৩০, যা ২০২১ সালের একই সময়ে ছিল ৯ কোটি ৬৪ লাখ ৭৬ হাজার ৪৭২ জন। এসব নিবন্ধিত গ্রাহকের মধ্যে পুরুষ ৬ কোটি ৪১ লাখ ৭৬ হাজার এবং নারী ৪ কোটি ৬৩ লাখ ৬৩ হাজার ২৪৮ জন। আর মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সংখ্যা ১১ লাখ ৭৭ হাজার ১৫২টি।

আলোচিত সময়ে মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় ক্যাশ ইন অর্থাৎ টাকা পাঠানো হয়েছে ২৭ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা এবং ক্যাশ আউট বা উত্তোলন হয়েছে ২৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি হিসাবে ২৬ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা লেনদেন হয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা বাবদ ৫ হাজার ৩১ কোটি টাকা, বিভিন্ন পরিষেবার বিল পরিশোধ ১ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা এবং কেনাকাটার ২ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে।

বাংলাদেশে মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক সেবার যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালের মার্চ মাসে। প্রথম এ সেবা চালু করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। পরে এটির নাম বদলে হয় রকেট। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমএফএস সেবা চালু করে বিকাশ। পরবর্তী এ সেবায় একে একে আসতে থাকে আরও অনেক ব্যাংক। বর্তমানে বিকাশ, রকেটের পাশাপাশি মাই ক্যাশ, এম ক্যাশ, উপায়, শিওর ক্যাশসহ ১৫টি ব্যাংক এ সেবা দিচ্ছে। এ বাজারের ৭০ শতাংশের বেশি বিকাশের নিয়ন্ত্রণে, এরপরই রকেটের। বাকিটা প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু লেনদেন হচ্ছে।

তবে এ সেবার মাশুল এখনো অনেক বেশি। এক হাজার টাকা তুলতে গ্রাহকদের খরচ করতে হয় সাড়ে ১৮ টাকা। এমএফএস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, যে মাশুল আদায় হয়, তার ৬০ শতাংশের বেশি এজেন্টদের দেওয়া হয়। এরপর নেটওয়ার্ক খরচ দিতে হয়। বাকিটা প্রতিষ্ঠান পরিচালনাতে খরচ হয়। দিন শেষে মুনাফা হয় খুব কম। তবে দিন শেষে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাবে প্রায় ৭ হাজার হাজার কোটি টাকার বেশি জমা থাকছে। এসব অর্থের সুদ থেকেই ব্যবসা চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে দিনে পাঁচবারে ৩০ হাজার টাকা জমা করা যায়। মাসে ২৫ বারে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা। আর এক দিনে ২৫ হাজার টাকা উত্তোলন ও ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি হিসাবে পাঠানো যায়। এখন গ্রাহকেরা ঘরে বসে এমএফএস হিসাব খুলতে পারেন। রয়েছে ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা স্থানান্তরের সুবিধাও। তাই মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব এখন সবার হাতের মুঠোয়। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সেবাটি নেওয়ার সুযোগ থাকায় করোনার মধ্যে এ সেবার চাহিদা আরও বাড়ছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন