বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে ৮০ শতাংশের বেশি অবদান তৈরি পোশাক খাতের। এ খাতের ওপর নির্ভর করে দেশে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ৩৭ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। চলতি বছর রপ্তানি আয় পৌঁছে যাচ্ছে ৪১ বিলিয়ন ডলার বা ৩ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকায়। গত অর্থ বছরে এ খাতের আয় ছিল ৩১ বিলিয়ন ডলার বা ২ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে যা ৪৫ বিলিয়ন ডলার বা ৪ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক ক্রয়ক্ষমতা কমতে থাকায় পোশাকে চলমান প্রবৃদ্ধি কমবে বলে আশঙ্কা করছেন তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) নেতারা।
সংগঠনের সভাপতি ফারুক হাসান বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে একদিকে জ্বালানি তেলসহ খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে ইউরোপসহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কাও বাড়ছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি তীব্র আকার ধারণ করেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশগুলো সুদের হার বাড়াচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের পণ্যের চাহিদা ও ক্রয় ক্ষমতা কমেছে। সামনে আরও কমে আসার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এদিকে গত ৭ জুন বিশ্ব ব্যাংক তাদের সর্বশেষ গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্ট প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দিয়ে বলছে, বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব এবং স্থবির চাহিদার কারণে অর্থনৈতিক মন্দা তীব্র হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, যেখানে ২০২১ সালে বিশ্ব বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০.৩ শতাংশ, সেটি ২০২২ সালে ৪ শতাংশে নেমে আসছে। একই সঙ্গে শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ, কনটেইনার ভাড়া বৃদ্ধি, ডিজেলে মূল্য বৃদ্ধিসহ সামগ্রিক উৎপাদন খরচ বিগত ৫ বছরে গড়ে প্রায় ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বলছে বিজিএমইএ। সম্প্রতি গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
আবার বিশ্বব্যাপী ডলার শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে। ডলারের বিপরীতে ইউরো যেভাবে মান হারাচ্ছে, তাতে চলতি বছরের শেষ নাগাদ ইউরো ও ডলারের মূল্য সমান পর্যায়ে চলে আসতে পারে। অর্থাৎ এক ইউরো দিয়ে এক ডলার পাওয়া যাবে। ফলে ইউরোপের বাজারে পোশাক পণ্যের মূল্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। সাম্প্রতিক রেমিট্যান্সে মন্দাভাব ও আমদানির উচ্চগতির কারণে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে চাপ তৈরি হয়েছে। আর ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দার যে পূর্বাভাস, সেটি মোকাবেলায়ও প্রস্তুত থাকতে হবে। এ পরিস্থিতিতে সর্ববৃহৎ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত, পোশাক শিল্পের অগ্রযাত্রা যেকোনোভাবেই হোক মসৃণ রাখা জরুরি বলছেন ফারুক হাসান।
এমন পরিস্থিতির আলোকে বিজেএমইএ সভাপতি বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে পোশাক রপ্তানির ওপর উৎসে কর ০.৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। যা বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শিল্পের জন্য অত্যন্ত দুরূহ হবে। যখন শিল্প মহামারি থেকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, আমরা মনে করি কর বাড়ানোর জন্য এটি সঠিক সময় নয়। বর্তমানে অস্থিরতাময় বিশ্ববাণিজ্য পরিস্থিতি আমাদের পোশাক শিল্পের জন্যও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তাই আমরা মনে করি, বর্তমান পরিস্থিতিতে এই উৎসে কর বৃদ্ধির প্রস্তাব পোশাক শিল্পের টিকে থাকার সংগ্রামটি আরও কঠিন করে তুলবে।
এদিকে, গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি ও সানেমের পক্ষ থেকে তৈরি পোশাকখাতে প্রণোদনা হ্রাস করার কথা বলা হচ্ছে। তাছাড়া এক শতাংশ উৎস করকেও তারা ইতিবাচক ভাবেই দেখছে। ফলে সরকারের পক্ষ থকে নগদ সহায়তাসহ বিভিন্ন সুবিধা পাওয়ার পরও কেন মাত্র ০.৫ শতাংশ উৎস করের বিরোধিতা করা হচ্ছে, এমন প্রশ্ন করা হয়। জবাবে ফারুক হাসান বলেন, প্রতিযোগিতার সক্ষমতা না থাকলে বিদেশ থেকে ব্যবসা আনা যাবে না। গতবছরও একইভাবে ১ শতাংশ উৎসে করের প্রস্তাব করা হলেও পরে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে পিছিয়ে আসে সরকার।
এবারও তা হবে বলে উল্লেখ করে ম্যানমেড ফাইবারে কর হ্রাসে কী প্রভাব পড়বে, এমন প্রশ্ন করা হয়। ফারুক হাসান বলেন, প্রতি কেজিতে ৬ টাকার পরিবর্তে ৩ টাকা নির্ধারণ দীর্ঘদিনের দাবির প্রতিফলন। এতে ব্যবসা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকার ৬ টাকা করের সময় যত টাকা পেত তার চেয়ে বেশি রেভিনিউ পাবে বলে আশ্বস্ত করেন তিনি। তাছাড়া নন-কটন পোশাক রপ্তানিতে ১০ শতাংশ হারে বিশেষ প্রণোদনা প্রদানের দাবি জানান। সরকারের পক্ষ থেকে প্রদান করা নগদ সহয়তার ওপর ১০ শতাংশ আয়করও প্রত্যাহারের দাবি জানান। সোলার প্যানেলেও ওপর ১ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
বাজেটে বিদেশ থেকে পাচার করা টাকা ফেরত আনার সুযোগ রাখার প্রস্তাব নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। এ বিষয়ে বিজিএমইএর অবস্থান জানতে চাইলে সরকারের যেটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটার সাথে একমত বলে জানায় দেশের শীর্ষ রপ্তানীকারক এ সংগঠনটি। ডলারের চাহিদা মেটাতে এ সিদ্ধান্তকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। আমদানি-রপ্তানি কারসাজির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করা হয়, এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়ে বিভিন্নভাবে বিদেশে টাকা যায় বলে জানান ফারুক হাসান। মেগা প্রকল্পের জন্য ইকুপমেন্ট আনতে গিয়েও আমদানি ব্যয় বাড়ছে বলে যোগ করেন তিনি।
গতকাল সোমবার গুলশানের একটি হোটেলে বাজেট পর্যালোচনার সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন বিজিএমইএ-এর সভাপতি ফারুক হাসান। এসময় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে শ্রমিক বিক্ষোভের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি অনেক কারখানায় ‘ফেয়ার প্রাইস শপ’ হচ্ছে বলে জানান। যেখানে কম দামে পণ্য পাওয়া যাবে। মজুরি বৃদ্ধির প্রসঙ্গে তিনি সরকারের বেতন বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে বলেও জানান। তবে প্রতিবছর নূন্যতম ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয় বলে যোগ করেন ফারুক হাসান।
চট্টগ্রামের বিএম ডিপোতে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় অধিকাংশ রপ্তানি পোশাক খাতের কনটেইনার ছিল বলে জানান তিনি। তবে আর্থিক ক্ষতির তুলনায় দেশের ভাবমূর্তির ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করছে বিজিএমইএ। অনুষ্ঠানের শুরুতে দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনের ব্যানারে পদ্মাসেতুর ছবি সংবলিত এ আয়োজনে বিজিএমইএ সভাপতি পদ্মা সেতুর কারণে সবাই লাভবান হবে বলেও জানান। বেলাপোল ও মংলাবন্দর আরো ভালো করে ব্যবহার করা হবে বলেও জানান তিনি। বিভিন্ন মহল থেকে প্রস্তাবিত বাজেট ব্যবসায়ী হয়েছে বলা হচ্ছে, এ বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করলে সেখানে গরিব মানুষদেরই কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে।
সম্প্রতি বিজিএমইএর পক্ষ থেকে ইউরোপ সফরের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে। তবে বিজিএমইএ সভাপতির শারীরিক অসুস্থতার জন্য সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন কম নেয়া হয়। জেনেভোয় বিশ্ব শ্রম সংস্থার সাথে নতুন একটি জেনেভা ডিক্লরেশনে স্বাক্ষর করা হয়। ফলে পোশাকখাতে ইনজুরি ইস্যুরেন্স স্কিম চালু করা হবে।
উল্লেখ্য, জেনেভায় চলমান বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার কনফারেন্সে বিজিএমইএ প্রতিনিধি দলের অংশ নেয়ার কথা থাকলেও ডিপো দুর্ঘটনা ও বাজেটের জন্য সফর সংক্ষিপ্ত করা হয়।
আনন্দবাজার/শহক