ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বদলাতে হবে রাজস্ব কাঠামো

বদলাতে হবে রাজস্ব কাঠামো

সদ্য প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। যা জিডিপির প্রায় ৫.৫ শতাংশ। আর এ বিশাল ঘাটতি মেটাতে সরকার দেশীয় বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করছে। তবে এতে বেসরকারি ঋণ প্রভাবে বাধার সৃষ্টি হতে পারে আশঙ্কা করে সরকারবে বিদেশ থেকে ঋণ নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) নেতারা।

গতকাল শনিবার মতিঝিল এফবিসিসিআই কার্যালয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন সংগঠনটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) আয়োজিত অনুষ্ঠানে সংগঠনটির পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, বিভিন্ন চেম্বার সভাপতিরা উপস্থিত ছিলেন।

বিদেশ থেকে পাচার করা টাকা ফেরত আনা সমর্থন করেন কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে এফবিসিসিআই সভাপতি ব‌লেন, আমরা আগেও বলেছি পাচার হওয়া টাকা বিনা প্রশ্নে দেশে আনার সু‌যোগ ব্যবসায়ীরা সমর্থন ক‌রে না। কারণ এ ধরনের সু‌যোগ দিলে সবাই এতে উৎসাহী হবে। এখন ডলারের সংকট তাই সরকার হয়তো ডলারের প্রবাহ বাড়াতে এ সু‌যোগ দি‌য়ে‌ছে।

মো. জসিম উদ্দিন ব‌লেন, আমি এখন ২৭ থেকে ৩০ শতাংশ কর দি‌য়ে দিচ্ছি। অন্যদিকে বিদেশ থেকে ফেরত আন‌তে ৭ শতাংশ কর দিলে ১৮ শতাংশ ডিসকাউন্ট পাওয়া যা‌চ্ছে। তাই আমরা এটা সমর্থন করি না। রপ্তানীমুখি সকল শিল্পে পোশাক খাতের মতো ১২ শতাংশ করেপোরেট কর নিধারণসহ ব্যবসায়িদের জন্য বেশ কিছু সুবিধা দেয়া হয়েছে। ফলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে বলছে এফবিসিসিআই। একইসঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছে সংগঠনটি।

লিখিত বক্তব্যে জসিম উদ্দিন বলেন, কোভিড ও ইউক্রেন পরিস্থিতির কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি, খাদ্য, পণ্যের কাঁচামালের মূল্যসহ শিপিং ও ট্রান্সপোর্ট খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে সব ধরনের দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বাড়ছে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা বাজেট বাস্তবায়নে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

ল্যাপটপে ১৫ শতাংশ কর আরোপ করার তীব্র বিরোধিতা করছে এফবিসিসিআই। জসিম উদ্দিন বলেন, প্রধানমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলেন, তাহলে এটা কি ল্যাপটপ ছাড়া সম্ভব? এনবিআরকে কে এই প্রস্তাব দিল সেই প্রশ্নও রাখেন তিনি। এখনো সে সময় আসেনি বলে তিনি জানান, যখন দেশে মানসম্মত ল্যাপটপ উৎপাদন হবে তখন এটা করা যায়।

বাজেটে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব বিবেচনা করা হয়নি জানিয়ে অগ্রিম আয়কর উঠিয়ে দেয়ার দাবি জানান এফবিবিসিআই সভাপতি। আড়াই শতাংশ কর না কমিয়ে উৎসে ১ শতাংশ কর ওঠিয়ে দিলে আরো বেশি ভালো হতো বলছে ব্যবসায়ীরা। উৎসে ১ শতাংশ ধরণে এটা ২৫ শতাংশে দাঁড়ায়। এতে করে ২৫ শতাংশ আর ১২ শতাংশ কর দাঁড়ায়, একটা হাস্যকর বলেও মন্তব্য করেন জসিম উদ্দিন।

আয়করের সীমা বৃদ্ধি না করায়ও প্রশ্ন তোলেন ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা। জীবনযাত্রার ব্যয়, মুদ্রাস্ফীতি এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় এনে ব্যক্তি শ্রেণির আয়করের সীমা বর্তমান ৩ লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৪ লাখ টাকা করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে আয়করের সীমা বৃদ্ধি করা হয়নি। ভারতে আয়করের সীমা ৫ লক্ষ রুপি উল্লেখ করে এখানে তিন লাখ থাকা উচিত নয় বলছে এফবিসিসিআই। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় আয়করের সীমা বৃদ্ধির প্রস্তাবটি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানানো হয়।

রপ্তানি আয়ের ওপর ১ শতাংশ উৎসে কর বাতিল করে পুনরায় শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ করার দাবি জানানো হয়। এটা প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমাতে উল্লেখ করে এটাকে অযৌক্তিক বলছে এফবিসিসিআই। এটা ২০ থেকে ২৫ শতাংশ হয়ে যায় বলছে ব্যবসায়ীরা। এই মুহূর্তে বিদেশি অর্থ দরকার ফলে ১ শতাংশ মানে ১০০ শতাংশ বৃদ্ধির সামিল বলছে তারা। সোলার প্যালেনের ওপর ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ নিয়েও প্রশ্ন তুলে এফবিসিসিআই। সবুজ কারখানাগুলো দেশের ভাবমূর্তিই পরিবর্তন করে দিয়েছে উল্লেখ করে অনেকে বাসার ছাদেও এটা ব্যবহার করছে জানায় এফবিসিআই।

খেলাপি ঋণ মওকুফ করা হলেও তাতে আবার কর আরোপকে ‘যুক্তিযুক্ত নয়’ বলছে এফবিসিসিআই। অতিলোভের কারণে এটা করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন জসিম উদ্দিন। জিডিপির তুলনায় করহার অনেক কম বলা হয়। এটা থেকে উত্তরণের জন্য এনবিআরকে আধুনিকায়নের কথা বলা হয়। এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, আমরা কর দিতে চাই। তাই ডিজিটালাইজেশন করতে হবে। এনবিআর-এর পলিসি বিভাগ আর বাস্তাবায়ন বিভাগকে আলাদা করার দাবি জানান। বর্তমান কাঠামো দিয়ে কর বাড়বে না বলেও মন্তব্য করা হয়।

আয়কর আইন নিয়ে সব ব্যবসায়ীকে নিয়ে আলাপ করে নতুন আইন কাঠমো দেয়া হলেও বাজেটে এটার কোনো প্রতিফলন হয়নি বলেও অভিযোগ করেন জসিম উদ্দিন। ব্যাংক হিসাবে ৫ কোটি টাকা বা এর বেশি জমা হলে ৫০ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক কাটা হবে বলে বাজেট প্রস্তাবনায় বলা হয়। যেটা আগে ৪০ হাজার টাকা ছিল। এতে করে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত হবে মনে করছে এফবিসিসিআই। মানুষ বালিশের নিচে, মাটির নিচে টাকা রাখবে বলেও মন্তব্য করেন জসিম উদ্দিন।

সরকারি সেবার হাজার কোটি টাকার মূসক ছাড় দেয়া হলেও কোভিড-১৯ টেস্ট কিট, পিপিপি, প্লাস্টিক ফেসশিল্ড, মাস্ক প্রভৃতি উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি প্রত্যাহার করেছে সরকার। এসিতে মূসক না থাকলেও টেস্ট কিটে ভ্যাট প্রত্যাহার কীভাবে যায় সে প্রশ্ন তোলেন জসিম উদ্দিন। ভারতে কভিড বাড়ছে তাই দেশেও যে কোনো সময় এটা বাড়তে পারে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

ব্যবসায়ীদের থেকে কর আদায়ে জেল-জরিমানা ও তাৎক্ষণিক ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। এতে হয়রানি আরো বাড়বে বলছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান। কেউ অপরাধ করলে আদালত সেটি দেখবে। কিন্তু নির্বাহী বিভাগের হাতে কেন এসব তুলে দেয়া হচ্ছে সে প্রশ্নও তোলেন তিনি।

জসিম উদ্দিন আরও বলেন, এসব স্বেচ্ছাচারিতার জন্যই আমরা অটোমেশনের দাবি জানাচ্ছি। এনবিআরকে আধুনিকায়ন করতে কত টাকা লাগে- সে প্রশ্নও তোলেন তিনি। ডোনেশনের জন্য বিশ্বব্যাংক-ডোনারের দিকে তাকিয়ে থাকায় এসব হচ্ছে না বলেও অভিযোগ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এফবিসিসিআই সভাপতি।

সর্বোপরি সুপারিশগুলো পুনর্বিবেচিত হলে প্রস্তাবিত বাজেট আরও বেশি ব্যবসা, বিনিয়োগ ও রাজস্ব-বান্ধব হবে বলে মনে করছে দেশের শীর্ষ এ ব্যবসায়ী সংগঠনটি। সামগ্রিকভাবে বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণের চাহিদাকে বিবেচনায় নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরো সুদৃঢ় করতে ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব বাজেট প্রণয়নে জোর প্রচেষ্টা গ্রহণ করায় প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারকে ধন্যবাদ জানায় এফবিসিসিআই।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন