- রপ্তানিশিল্পে কর হ্রাস দাবির প্রতিফলন
- রপ্তানিতে উৎসে কর বৃদ্ধি নেতিবাচক
করোনা ও ইউক্রেন সংকটের বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা ও শত প্রতিকূলতার মধ্যেও জনগণের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কল্যাণমুখী বাজেট দিয়েছেন বলে জানান বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই)। গত শুক্রবার বিসিআইয়ের মহাসচিব ড. অর্ধেন্দু শেখর রায়ের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ অভিমত তুলে ধরেন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে জাতীয় সংসদে আগামী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ বাজেট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের চতুর্থ বাজেট।
ওই বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিসিআইয়ের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, এবারের বাজেট প্রস্তাবের শিরোনাম নির্ধারণ করা হয়েছে কভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন। আসন্ন অর্থবছরের বর্তমান করোনা ও ইউক্রেন সংকটের বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা ও শত প্রতিকূলতার মধ্যেও জনগণের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কল্যাণমুখী বাজেট দেয়ায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। বিশ্ব অর্থনীতি করোনা ও ইউক্রেন সংকটে বিপর্যস্ত, ঠিক এই কঠিন সময়ে আজকের জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য নিয়ে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে আসন্ন অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। এই সময়ে এরূপ উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ঘোষিত বাজেট আশাব্যঞ্জক হলেও সুশাসন, যথাযথ মনিটরিং, দক্ষতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও যথাযথ পরিকল্পনা নিশ্চিত করা না গেলে বাস্তবায়নে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে সরকারকে।
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বর্তমান সংকটময় বিশ্ব অর্থনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রস্তাবিত বাজেটে তৈরি পোশাক শিল্পের ন্যায় সব ধরনের রপ্তানিমুখী কোম্পানির করহারও ১২ শতাংশ করা হয়েছে। যা বিসিআইয়ের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতিফলন। এজন্য আমরা অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। তবে রপ্তানি ক্ষেত্রে উৎসে কর দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ১ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে। যা বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে রপ্তানির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই আমরা উৎসে কর দশমিক ৫০ শতাংশ পূনর্বহাল করার প্রস্তাব করছি। প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে প্রণোদনা প্রদানকে আমরা স্বাগত জানাই। প্রয়োজনে ডলারের মূল্য পূননির্ধারন করে প্রবাসী আয়কে আরো উৎসাহিত করা জরুরী। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই প্রস্তাাবিত বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ। প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার কথা উল্লেখ করা হলেও তা বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দেশীয় শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা জরুরি। নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠির জন্য রেশনিং ব্যবস্থা জোরদার করা এবং বাজেটে ৫০ লাখ পরিবারকে ১৫ টাকা দরে চাল সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। আমরা এই চালের দর পূর্বের ন্যায় ১০ টাকায় নির্ধারনের প্রস্তাব করছি।
বিসিআই মূলত তরুণ শিল্প উদ্যোক্তা সৃষ্টি, মাইক্রো ও স্মল শিল্প উদ্যোক্তা সৃষ্টি, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শিল্পায়নের প্রসার নিয়ে কাজ করছে। বিসিআই মনে করে, মাইক্রো ও স্মল শিল্প উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে মূসক অব্যাহতি, সকল ধরনের ইউটিলিটির ওপর মূসক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করছে। স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের টার্নওভার করহার শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ করায় আমরা স্বাগত জানাই। তরুণ উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের জন্য বাজেটে বিশেষ তহবিল গঠন করে তহবিল বিতরনের জন্য সুষ্ঠ নীতিমালা প্রনয়নের প্রস্তাব করছি। প্রস্তাবিত বাজেটে করপোরেট কর ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। যা বিসিআই স্বাগত জানায়। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু শর্তারোপ করা হয়েছে। যা বাস্তাবায়ন কষ্টসাধ্য।
মূল্যস্ফীতি ও জীবন যাত্রার ব্যয় বিবেচনায় আগামী কর বৎসরের ব্যক্তি শ্রেনির করমুক্ত আয়ের সীমা ৪ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করছি। কর ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ, দ্রুত, আধুনিক, যুগোপযোগী হয়রানিমূক্ত এবং সকলকে কর প্রদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কর ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরুরে ডিজিটাল করে কর এসেসমেন্ট সিসটেম ফ্রেন্ডলি সহজ করার প্রস্তাব করছি। যার ফলে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে এবং সকলে কর প্রদানে উৎসাহিত হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে শিল্পে কাঁচামাল সরবরাহের ক্ষেত্রে উৎসে কর ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ এবং পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে উৎসে কর ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। উৎসে কর সমন্বয়যোগ্য বিধায় আমরা এ কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব পুর্নব্যক্ত করছি কারণ এ কর ব্যবসার খরচ বৃদ্ধি করে। এছাড়া অগ্রিম আয়কর (এআইটি) ও অগ্রিম কর (এটি) বিলুপ্ত করার প্রস্তাব করছি।
স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ৪ হাজার ১৩২ কোটি টাকা বৃদ্ধি করে ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা (মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ) এবং টানা তৃতীয় অর্থবছরে চিকিৎসা গবেষণা খাতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করায় অর্থমন্ত্রীকে আমরা আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। তবে করোনাভাইরাস টেস্টিং কিট, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) উৎপাদন করার কাঁচামাল আমদানির ওপর বিদ্যমান শুল্ককর মওকুফের সুবিধা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। যা পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব করছি।
স্টীল পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত এইচ আর কয়েল ও জিংক এলয় জাতীয় কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে কর হার ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। বাংলাদেশী পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের আয় ২০৩০ সাল পর্যন্ত করমুক্ত কারায় এ সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। কোভিড-১৯ জনিত কারনে কর্মহীনতা ও আয়- হ্রাস কমাতে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি, প্রতিবন্ধী ভাতা কর্মসূচি, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা কর্মসূচী প্রভৃতির আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। যা ইতিবাচক। বিদ্যুৎ ও জ্বালানী, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়ে বাজেটে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা বিনিয়োগ, শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থান প্রক্রিয়াকে গতিশীল করবে বলে বিসিআই মনে করে।
দক্ষতা উন্নয়নের জন্য নজর দেয়া হয়েছে। মানবসম্পদকে সার্বিকভাবে উন্নয়ন করা হলে স্বাভাবিকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে নীতিমালা সহজিকরন করে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার প্রস্তাব করছি। আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। যা বিগত বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ১২ দশমিক ১২ শতাংশ বেশি। বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। যা ৫ শতাংশের মধ্যে থাকা বাঞ্ছনীয়। এ ঘাটতি পূরণে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা যার মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৫ টাকা ঋণ গ্রহণের কথা বলেছে। সরকার ব্যাংক খাত থেকে এ পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রাজস্ব ঘাটতি ও অর্থায়নসহ অন্যান্য বিষয়গুলো অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। বিসিআই মনে করে বর্তমান সংকটময় বিশ্ব পরিস্থিতে সকল ক্ষেত্রে অপচয় কমিয়ে আনতে হবে। খাদ্য পণ্য উৎপাদন, বিপনন এবং পরিবহন পর্যায়ে অপচয় ও চাদাবজি বন্ধ করা জরুরি। যানযট নিরসন, অতিরিক্ত আলোকসজ্জা না করা ইত্যাদির মাধ্যমে সম্পদ অপচয় কমিয়ে এনে সম্পদের সুষ্ট ব্যবস্থাপনা করা জরুরি। বহুল কাঙ্খিত পদ্মাসেতু উদ্বোধন হতে চলেছে আগামী ২৫ জুন এবং আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে সর্বজনীন পেনশন চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আমার প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি।
আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে, দেশের জনগণের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য বাজেটের এই আকার অবাস্তব নয়। দেশের অর্থনীতির পরিকাঠামো বৃদ্ধির সাথে সাথে বাজেটের আকারও প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সুশাসন, যথাযথ মনিটরিং, বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যবান্ধব রাজস্ব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কাঙ্খিত রাজস্ব আদায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণের চাহিদাকে বিবেচনায় নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরো সুদৃঢ় করতে ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব বাজেট প্রণয়নে জোর প্রচেষ্টা গ্রহণ করায় প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আনন্দবাজার/শহক