কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’ প্রতিপাদ্য নিয়ে ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ ব্যয় বাড়িয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে। নতুন এ বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এতে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে রাখার কথা বলা হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটের আকার চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ৭৪ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা বেশি। আর সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৮৪ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা বেশি। নতুন বাজেটে সরকারের আয়ের সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রা হতে যাচ্ছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। অনুদান ছাড়া ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। আর অনুদানসহ ঘাটতি ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।
আয়ের লক্ষ্যমাত্রা চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের তুলনায় ৪৪ হাজার ৭৯ কোটি টাকা বেশি। কর বাবদ ৩ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা আয় করার পরিকল্পনা করছে সরকার। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরে এনবিআরকে আগের বছরের তুলনায় ৪০ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দিচ্ছে সরকার। এনবিআর বহির্ভুত কর থেকে আয় করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। আর কর ছাড়া আয় ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক অনুদান থেকে আয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২৭১ কোটি টাকা।
বাজেটের বিশাল ঘাটতি
বিশাল এ বাজেটের ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। বিশাল এ ঘাটতি পূরণে সরকার কোন খাত থেকে কত টাকা ঋণ নেবে তারও একটি ছক তৈরি করেছে। ছক অনুযায়ী, এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ নেবে এক লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এছাড়া বৈদেশিক ঋণ হিসেবে ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা ধার নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার। চলতি অর্থবছরের বাজেটে যা আছে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা।
অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে সরকার সবচেয়ে বেশি ধার নিতে চায় ব্যাংক খাত থেকে। যার পরিমাণ ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা আরও বাড়ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি পূরণে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেবে বলে লক্ষ্য ঠিক করেছে। এই অংক চলতি অর্থবছরের চেয়ে ২৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা আছে। এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ ৩৫ হাজার কোটি টাকা আর অন্যান্য খাত থেকে আসবে পাঁচ হাজার এক কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে এটি আ হ ম মুস্তফা কামালের চতুর্থ বাজেট, আর দেশের ইতিহাসে ৫১তম। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, এবারের বাজেটে প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে-
১. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা
২. গ্যাস, বিদ্যুৎ মূল্যবৃদ্ধিজনিত বর্ধিত ভর্তুকির জন্য অর্থের সংস্থান
৩. বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ব্যবহার, মন্ত্রণালয় ও বিভাগের
৪. উচ্চ-অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করা
৫. শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন
৬. অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন কর সংগ্রহের পরিমাণ ও ব্যক্তি আয়করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করা
৭. টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা।
ভর্তুকি ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা
প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থমন্ত্রী বলেন, সামগ্রিক পরিস্থিতিতে সরকারের ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার ওপরও চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের প্রাথমিকভাবে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব করছি, যা জিডিপির ১ দশমিক ৯০ শতাংশ। আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, গ্যাস ও সারের মূল্যের সাম্প্রতিক যে গতিপ্রকৃতি তাতে ভর্তুকি ব্যয় আরও ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে, যা আগামী অর্থবছরের বাজেট ব্যবস্থাপনায় একটি চ্যালেঞ্জ।
শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ল ৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা
২০২২-২৩ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ছে। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৭১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। ৯ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা বাড়িয়ে আসন্ন অর্থবছরে শিক্ষা খাতের জন্য মোট ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য এবার ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা চলতি অর্থবছরের জন্য ছিল ৩৬ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। আর কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা চলতি অর্থবছরের জন্য করা হয়েছিল ৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা।
স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ছে
২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা খাতে বরাদ্দ বাড়ছে। এবার এ খাতে প্রস্তাবিত বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। গত বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। সে তুলনায় এ খাতে বরাদ্দ বেড়েছে চার হাজার ১৩২ কোটি টাকা।
কৃষিতে বরাদ্দ ৩৩ হাজার কোটি টাকা
কৃষিক্ষেত্রে (কৃষি, খাদ্য এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ) সার্বিক উন্নয়নে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জন্য ৩৩ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, যা ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ২৪ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা ছিল। বরাদ্দ বেড়েছে ৯ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা।
৮ লাখ বৈদেশিক কর্মসংস্থান
২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ৮ লাখ ১০ হাজার বাংলাদেশি কর্মীর বৈদেশিক কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা এবং ৫ লাখ ২০ হাজার মানুষের বিভিন্ন ট্রেডে দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ প্রদানের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে আড়াই শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দেওয়ার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী।
নারী-শিশু উন্নয়নে বরাদ্দ বেড়েছে ১০০ কোটি
২০২২-২০২৩ অর্থবছরে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য চার হাজার ২৯০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ছিল ৪ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এই খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ১০০ কোটি টাকা। নারীর ক্ষমতায়ন ও শিশু কল্যাণ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আগামী বাজেটে পাঁচটি ব্যয়খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে, দুস্থ মাতাদের খাদ্য সহায়তা (ভিজিডি) কর্মসূচি, জীবন-চক্রভিত্তিক মাদার অ্যান্ড চাইল্ড বেনিফিট প্রোগ্রাম, শিশু বিকাশ কেন্দ্র ও কিশোর-কিশোরীদের ক্ষমতায়ন কর্মসূচি, নারীদের জন্য কারিগরি, বৃত্তিমূলক, আয়বর্ধক ও উৎপাদনশীল প্রশিক্ষণ ও নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধ ও আইনগত সহায়তা দেওয়া।
জলবায়ুতে ৮০ বিলিয়ন বিনিয়োগের পরিকল্পনা
পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা অর্জনে ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে এ বিনিয়োগের অর্থায়ন করা হবে বলে জানান অর্থমন্ত্রী।
ভাতার আওতায় আরও ২ লাখ
সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচিকে সর্বোত্তম বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করে এবারের বাজেটে অর্থ বরাদ্দ করেছে সরকার। এ কর্মসূচিকে প্রাধান্য দিয়ে গত অর্থবছরে উপকারভোগীর সংখ্যা রাখা হয়েছিল ১০ লাখ ৪৫ হাজার। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে এ সংখ্যা ১২ লাখ ৫৪ হাজারে উন্নীত করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এতে উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়বে ২ লাখ ৯ হাজার। এজন্য এ খাতে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ১ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন তিনি।
আনন্দবাজার/শহক