চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে মানুষ জাতীয় বাজেটে তার জন্য কী বরাদ্দ থাকছে। নিজের এলাকার কাঁদাযুক্ত রাস্তাটি ইটের হবে কিনা, স্কুলের ফুটো চাল দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়া বন্ধ হবে কিনা? রাস্তায় শুয়ে থাকা ব্যক্তিও জানতে চায় তার জন্য কী রয়েছে রাষ্ট্রীয় বাজেটে। কোটি চাহিদা পূরণে প্রতি বছরই বাজেট ঘোষণা ও বাস্তবায়িত হয়ে আসছে। তবে এসব বাজেটের বিশাল একটি অংশ থাকে ঘাটতি। এই ঘাটতির গ্লানি তুলতে গিয়ে বাদ পড়ে অনেক স্বপ্ন সম্ভাবনার খাত!
আজ বৃহস্পতিবার বিকেল তিনটায় জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটি তার ব্যক্তিগত চতুর্থ ও আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৪ ও দলীয়ভাবে ২৪তম বাজেট।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, এবারের বাজেটটি হবে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার। তার মধ্যে ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আসন্ন প্রস্তাবিত বাজেট চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ৭৪ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা বেশি। আর সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৮৪ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা বেশি। চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। যদিও সংশোধিত বাজেটের আকার বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
মূল বাজেট থেকে ঘাটতি বাদ দিলে ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৬৪ কোটি টাকা থাকে। অর্থাৎ বাজেটের তিনভাগের এক ভাগই ঘাটতি। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ছিল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। সেখানে ঘাটতি ছিল ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬.২ শতাংশ। এই ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক সূত্র থেকে ১ লাখ ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক বহির্ভুত উৎস থেকে ৩৭ হাজার ১ কোটি টাকা।
বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের আয়ের সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রা হতে যাচ্ছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। সেখানে বাজেটে অনুদান ছাড়া ঘাটতির আকার ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। আর অনুদানসহ ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।
সম্পদ আহরণে এনবিআর বহির্ভুত কর থেকে আয় করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। কর ছাড়া আয় ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি। আর বৈদেশিক অনুদান থেকে আয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। অনুদানের ফেরত দিতে হয় না বিধায় এর পরিমাণও রাজস্ব আয় হিসাবে দেখাতে যাচ্ছে প্রস্তাবিত বাজেটে।
সম্ভাব্য বাজেটে ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নেবে সরকার। সেখানে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এক লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা ও বৈদেশিক উৎস থেকে ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রবীণ অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে না পারলে ব্যয় বাড়ানো কঠিন। কিন্তু বাস্তবতা হলো এবার অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয় বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। এর মধ্যে অবকাঠামো, জ্বালানি এবং সামাজিক নিরাপত্তা অন্যতম। যেহেতু আমরা বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যে রাখতে চাইছি, সে কারণে রাজস্ব না বাড়লে ব্যয় বাড়ানো সম্ভব হয় না। তাই রাজস্ব বাড়ানোর একটি দিকনির্দেশনা বাজেটে থাকতে হবে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি গত ২২ মে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জন্য ২০ লাখ ৫০ হাজার ৩৬ কোটি টাকার বিকল্প বাজেট পেশ করে। সেখানে অভ্যন্তরীণ উৎস রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। যা প্রস্তাবিত বিকল্প বাজেটের ৯২ শতাংশের বেশি। প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আয়ের ৭৭ শতাংশ আসবে প্রত্যক্ষ কর থেকে, বাকিটা পরোক্ষ কর। যেখানে সরকারের প্রত্যক্ষ কর থেকে আসে মাত্র ৪৬ শতাংশ।
গত ২৮ মে মুভমেন্ট ফর ওয়ার্ল্ড এডুকেশন রাইটস (এমডব্লিউইআর) ১৬ লাখ ৩৯ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকার ‘জাতীয় স্বপ্নবাজেট ২০২২-২৩’ প্রস্তাব করেছে। সেখানে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ২৮ হাজার ৮ কোটি টাকা অর্থাৎ ২৬.০৯ শতাংশ ও উন্নয়ন ব্যয়-১০ লাখ ৪৬ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা অর্থাৎ ৬৩.৮০ শতাংশ। (সেখানে ৫ লাখ ২৬ হাজার ৪৩১ কোটি টাকার উন্নয়ন অর্থাৎ ৩২.১০ শতাংশ এবং ৫ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায় ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যয় করতে হবে অর্থাৎ ৩১.৭০ শতাংশ)। পরিচালন ও উন্নয়ন মোট ব্যয় মিলে ৯ লাখ ৫৪ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা। ঋণ পরিশোধ ২০ হাজার ৫০১ কোটি টাকা অর্থাৎ ১.২৫ শতাংশ। বিশেষ ব্যয়, বিভিন্ন সংস্থার চাঁদা ও অন্যান্য ব্যয় ৬৬৫০০ কোটি টাকা। সর্বমোট ব্যয় ১৫ লাখ ৬১ হাজার ৪৪০ অর্থাৎ শতাংশ ও বাজেটে উদ্বৃত্ত থাকবে ৭৮ হাজার ৫০৮ অর্থাৎ ৫.০২ শতাংশ।
বাজেটে আয়ের খাত সম্পর্কে এমডব্লিউইআর জানায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত করসমূহ হতে ৮ লাখ ৩৩ হাজার ২২৫ কোটি টাকা অর্থাৎ ৫০.৮০ শতাংশ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বহির্ভুত করসমূহ হতে ১ লাখ ৭৩ হাজার ২০১ কোটি টাকা অর্থাৎ ১০.৫৬ শতাংশ ও কর ব্যতীত প্রাপ্তি ৬ লাখ ৩৩ হাজার ৫২২ কোটি টাকা অর্থাৎ ৩৮.৬৩ শতাংশ। মোট ১৬ লাখ ৩৯ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ দৈনিক আনন্দবাজারের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই ঘাটতি বাজেট থাকে। আমাদের দেশেও সেটি আছে। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হলে বাজেটে ঘাটতি হবেই। কেননা আমাদের বাজেটে ব্যয়ই বেশি থাকে। ঘাটতি পোষাতে আয়ের পথ বাড়াতে হবে, আয় বাড়াতে হবে। ব্যালেন্সশিট ঠিক করতে হবে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, সংবিধানের ‘প্রস্তাবনায়’ সর্ব প্রথমে উচ্চারিত তিন শব্দ ‘আমরা বাংলাদেশের জনগ’ সঙ্গত কারণে জাতীয় বাজেটে প্রতিফলিত হওয়া উচিত সেই ‘সকল’ জনগণের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বিধিবিধান, খতিয়ান। ‘জাতীয়’ বাজেটটি হবে রাষ্ট্রের; শুধু সরকারের নয়, শুধু পক্ষের নয়- বিপক্ষেরও এবং সকলের।
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাজেটে করণীয় ও কৌশল সন্ধান বিষয়ে ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, রাজস্ব আহরণ খাতে চলমান সংস্কার ও অনলাইনীকরণ বাস্তবায়নে দৃঢ়চিত্ত ও সময়সূচিভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করা। বিদ্যমান আইনের সংস্কার এবং অনলাইনীকরণ ব্যতিরেকে বিদ্যমান কর্মকাঠামো ও লোকবল দিয়ে রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি ও পরিবেশের উন্নয়ন সাধন সম্ভব ও সমীচীন হবে না।
তাছাড়া রাজস্ব আহরণ ও প্রদান ব্যবস্থাপনাকে গতিশীল ও আস্থায় আনতে সংসদের অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির তত্ত্বাবধানে সরকারি-বেসরকারি খাত সমন্বয়ে উপদেষ্টা প্যানেল প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এ প্যানেল থেকেই কর নীতি ও রাজস্ব আহরণ পদ্ধতি প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রস্তাব আসতে পারে। জাপানসহ অনেক উন্নত অর্থনীতির দেশে এধরনের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আছে। তিনি বর্তমানের জুন-জুলাই অর্থবছরের পরিবর্তে জানুয়ারি বা এপ্রিলে নিয়ে আসার প্রস্তাব করেন।
বাজেটে ঘাটতি পোষাতে বাংলাদেশে অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম বলেন, বাজেটে আয়ের নতুন ২৭টি উৎস প্রস্তাব করেছে অর্থনীতি সমিতি। তার মধ্যে রয়েছে- ১. কালো টাকা উদ্ধার হতে প্রাপ্তি, ২. অর্থচার উদ্ধার হতে প্রাপ্তি, ৩. সম্পদ কর, ৪. অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর (অনলাইন ব্যবসা-বাণিজ্যসহ), ৫. বিলাসী দ্রব্য-পণ্যের ওপর কর, ৬. সংসদ সদস্যসহ অন্যান্যদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি বাতিল, ৭. বিদেশি নাগরিকদের ওপর কর, ৮. সেবা থেকে প্রাপ্ত কর, ৯. বিমান পরিবহন ও ভ্রমণ কর, ১০. রয়্যালিটি ও সম্পদ থেকে আয়, ১১. প্রতিরক্ষা থেকে প্রাপ্তি, ১২. রেলপথ থেকে আয়, ১৩. ডাক বিভাগ, ১৪. সরকারের সম্পদ বিক্রয়, ১৫. সেচবাবদ আয়, ১৬. তার ও টেলিফোন বোর্ড, ১৭. টেলিকম রেগুলেটরি কমিশন, ১৮. সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, ১৯. এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, ২০. বিআইডব্লিউটিএ, ২১. পৌর হোল্ডিং কর, ২২. ডিজি হেলথ: বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার অনুমতি ও নবায়ন ফি, ২৩. ডিজি ড্রাগস: ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি লাইসেন্স ও নবায়ন ফি, ২৪. বিউটি পার্লার সেবাবন্ধ কর, ২৫. আবাসিক হোটেল/গেস্ট হাউজ ক্যাপাসিটি কর, ২৬. বিদেশি পরামর্শক ফি ও তার ও ২৭. টেলিফোন বোর্ড ইত্যাদি থেকে প্রাপ্ত কর। এসব স্থান থেকে অর্থ আসলে বাজেটে ঘাটতি অনেক কমে যাবে।
এই ২৭টি নতুনখাত এনবিআরে রাজস্ব আদায়ে যুক্ত হবে। তা ছাড়া প্রতিষ্ঠানটিকে আরো সচল ও শক্তিশালী হতে হবে রাজস্ব আহরণে।
আনন্দবাজার/শহক




