- বাড়ার হার ১৮.৫৪ শতাংশ
- আয় কমেছে বস্তিতে ৮ শতাংশ, গ্রামে ৩
চলমান মুল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের স্বল্প আয়ের পরিবারগুলো তাদের প্রকৃত আয়, খাদ্যনিরাপত্তা এবং প্রয়োজনীয় খরচের ক্ষেত্রে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানো তাদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গতকাল রবিবার ‘ইনফ্লেশন, কোপিং অ্যান্ড রিকভারি চ্যালেঞ্জেস’ শিরোনামের একটি ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশান রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (বিআইজিডি)’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন।
গবেষণায় জানানো হয়, মূল্যস্ফীতি এবং দারিদ্রের ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ধীরগতিতে হওয়ায় ‘নতুন দরিদ্রের’ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮.৫৪ শতাংশে। পিপিআরসি-বিআইজিডি’র এক যৌথ সমীক্ষার সর্বশেষ রাউন্ড থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে এই ফলাফল উপস্থাপন করেন বক্তারা। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে গবেষণাটি শুরু হয়। শহরাঞ্চলের বস্তি ও গ্রামাঞ্চলের বড় জনগোষ্ঠীর ওপর একাধিক সমীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখার চেষ্টা করা হয় কীভাবে বাংলাদেশের স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট ব্যাপক ঝুঁকি তৈরি করছে। এ বছরের মে মাসে প্রায় ৪ হাজার পরিবারের ওপর জরিপের পঞ্চম রাউন্ড চালানো হয়েছিল।
সেখানে দেখা যায়, দ্বিতীয় দফায় দেয়া লকডাউনের পরে মাথাপিছু দৈনিক আয় বেশ ভালোভাবে পুনরুদ্ধারিত হয়েছিল। আগস্ট ২০২১ থেকে জানুয়ারী ২০২২ পর্যন্ত আয়বৃদ্ধির এই হার ছিলো ২৭ শতাংশ। কিন্তু মূল্যস্ফীতির কারণে জানুয়ারি এবং মে ২০২২ এর মধ্যে এই আয় আবার ৬ শতাংশ কমতে শুরু করেছে। ফলে মানুষ কোভিড-পূর্বে যত আয় করত, বর্তমানে প্রকৃত আয় সেরকম আশানুরূপ হচ্ছে না।
ড. রহমান জানান, ঠিক কোভিড-১৯’র ধাক্কা সামলানোর সময়টিতে মূল্যস্ফীতি ঘটায় পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। মহামারীর দুবছর পর, এখনও ১৫ শতাংশ পরিবারের আয় মহামারী-পূর্ব আয়ের সমান হয়নি। বাংলাদেশ এখন একটি নতুন ঝুঁকির সম্মুখীন। তা হলো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় পুষ্টি ও শিক্ষার যে লক্ষ্য নির্ধারিত, সেটি পূরণ না হওয়ার আশংকা।
দৈনিক প্রকৃত মাথাপিছু আয়ের সাম্প্রতিক পতন গ্রামীণ এলাকার (৩ শতাংশ) তুলনায় শহুরে বস্তিতে (৮ শতাংশ) তীব্র হয়েছে। করোনা শহুরে বস্তিতে থাকা পরিবারগুলোর জীবন-জীবিকায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলো। আবার গ্রামের তুলনায় শহরে আয়ের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অনেক ধীরে এগিয়েছে। আর এখন মূল্যস্ফীতি সেই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে আরও মন্থর করেছে।
মূল্যস্ফীতির এই চাপ আরও অনেক নারীদের কাজের খোঁজে বাইরে বের হতে বাধ্য করেছে। জানুয়ারিতে সমীক্ষায় অংশ নেয়া নারীদের ৪০ শতাংশ আয়-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। মে মাসে দেখা গেছে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২ শতাংশ। তবে জরিপে অংশ নেয়া ৩৬ শতাংশ নারী- যারা করোনার আগে উপার্জন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত ছিলেন, তারা এখনও কর্মহীন।
দাম বেড়ে যাওয়ায়, জরিপে অংশ নেয়া পরিবারগুলো ফেব্রুয়ারি মাস হতে খাদ্যতালিকায় থাকা মূল খাবার যেমন মাছ, মাংস, দুধ এবং ফল খাওয়া হয় খুব কমিয়ে দিয়েছে অথবা, বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলের বস্তিতে খাবারের মান ও পরিমাণ দুটোই বেশ কমেছে। মে মাসে অর্থাভাবে প্রতি পাঁচ পরিবারে একটি পরিবার অন্তত একবেলা খাদ্যগ্রহণ করেনি।
আগস্ট ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ এর মে-তে আরও বেশকিছু পরিবার তাদের নিজেদের আয় ও উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। অর্থ ধার, দোকান থেকে ধারে পণ্য কেনা বা আত্মীয়দের কাছ থেকে তারা সাহায্য নেয়নি। এটাকে ইতিবাচক পরিবর্তন বলা যেতে পারে।
জরিপে অংশ নেয়া ৩৮ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, তাদের আরও টাকা প্রয়োজন ছিলো কিন্তু তারা সেটা জোগাড় করতে পারে নি। কারণ, আগে থেকেই তারা বড়ধরনের ঋণে জর্জরিত ছিল। ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে জরিপে অংশ নেয়া দুই-তৃতীয়াংশ পরিবার খাদ্য-বহির্ভূত ব্যয় সংকোচন করেছে। আশঙ্কার কথা হলো, এই ব্যয় সংকোচনের ভেতর চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যয়ের মত খাতও ছিল। মূল্যবৃদ্ধির সাথে খাপ খাওয়াতে এসব পরিবার কম এমনকি নিম্ন মানসম্পন্ন পণ্য দিয়ে কাজ চালিয়েছে।
গত বছরের তুলনায়, এ বছর মে মাসে দারিদ্র্যসীমার উপরে ও নিচে থাকা উভয় জনগোষ্ঠীর মাঝেই ন্যায্যমূল্যে চাল কেনার পরিমাণ বেড়েছে। সেই সাথে টিসিবির খাদ্যপণ্য বিক্রিতেও পরিবর্তন দেখা যায়; জরিপের ৩৮ শতাংশ পরিবার ফেব্রুয়ারি ২০২২ হতে টিসিবি থেকে খাদ্যপণ্য ক্রয় করে। তা সত্ত্বেও, অনেকাংশেরই চাহিদা মেটানো যায়নি। শুধু মাত্র ৫ শতাংশ পরিবার টিসিবির খাদ্যর প্রয়োজন নেই বলে মনে করে।
জরিপ করা পরিবারের অর্ধেকের বেশি স্বীকার করে তাদের টিসিবি থেকে খাদ্যপণ্য ক্রয় করা প্রয়োজন ছিল কিন্তু নানান কারণে কিনতে পারেনি। যেমন, কেনার সুযোগ না পাওয়া এবং টিসিবি’র পরিবার কার্ড না থাকা। এক-পঞ্চমাংশ পরিবার জানিয়েছে, দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার কারণে তারা খাবার কিনতে পারে নি। যদিও সামগ্রিকভাবে টিসিবি থেকে যারা ক্রয় করেছে তাদের অভিজ্ঞতা সন্তোষজনক ছিল। এদের মাঝে দুই-তৃতীয়াংশ জানিয়েছে, তাদের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ছিলো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই গবেষণায় বোঝা যায়, শহরে এবং গ্রামে দরিদ্র পরিবারের জন্য টিসিবি এবং এধরণের অন্যান্য কর্মসূচী সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
অর্ধেকেরও বেশি পরিবার বিশ্বাস করে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পেছনে সরকারের যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও অনুশাসনের অভাব রয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই চায়, সরকার সিন্ডিকেট এবং দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনুক। যদিও এদের এক-তৃতীয়াংশের পরামর্শ ছিলো মূল্যহ্রাস করা, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য।
গবেষণার এই পর্যায়ে উদ্বেগজনক কিছু দীর্ঘমেয়াদী প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। প্রথমত, বিভিন্ন অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে আয়ের দিক থেকে অভিন্নতা দেখা গেছে। যারা দরিদ্র নয় এবং দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর আয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তুলনায় তীব্রভাবে কমেছে। কিন্তু সেই তুলনায় দারিদ্রতা থেকে পুনরুদ্ধারের গতি বেশ মন্থর, বিশেষত দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য। দ্বিতীয়ত, জরিপে অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ মহামারীর পর থেকে কর্মহীন।
পরিশেষে, মের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতি এবং দারিদ্রের ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ধীরগতিতে হওয়ায় “নতুন দরিদ্রের” হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮.৫৪ শতাংশে। মূল্যস্ফীতিজনিত বিপরীত ধাক্কা আরও বড় পরিসরে দীর্ঘ সংকট বয়ে আনছে- বলেছেন ড. মতিন।
আনন্দবাজার/শহক