ঢাকা | মঙ্গলবার
৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২৩শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ক্ষুদ্র চা চাষিদের টিকতে প্রয়োজন সহায়তা

চা দিবস

ক্ষুদ্র চা চাষিদের সহায়তা না দিলে বড়দের ভিড়ে অস্তিত্ব হারাবে। এতে উৎপাদন ক্ষমতা কমে লোকসানের দিকে যাবে খাতটি। সেক্ষেত্রে এখন থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবনা শুরু হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। গতকাল শনিবার দ্বিতীয় জাতীয় চা দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ আশঙ্কার কথা জানান তিনি। ‘চা শিল্পের সংকল্প, সমৃদ্ধ চা শিল্প’ স্লোগান দিবসটি পালন করা হয়।

রাজধানী ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ চা বোর্ড যৌথভাবে দিবসটি পালনের আয়োজন করে। এতে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ সভাপ্রধান ছিলেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ।

বক্তব্য দেন বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম, বাংলাদেশীয় চা সংসদের সভাপতি এম শাহ আলম, টি ট্রেডার্স অ্যাসোশিয়েনের সভাপতি ওমর হান্নান ও দি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি-এফবিসিসিআই’র সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন।

প্রধান অতিথি বলেন, ব্রিটিশরা কলের গান বাজিয়ে বিড়িসহ চা খাওয়াতো। আর এখন ১০ কোটি চা প্রতিদিন পান করা হয়। প্রতিদিন সকালের একটি অনুসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে চা। বঙ্গবন্ধু এক বছর ৪ মাসে এ খাতে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করে গেছেন। যা ভালো মনে করেছেন সেখানে হাত দিয়েছেন এবং তা উন্নতি হয়েছে।

টিপু মুনশি এমপি বলেন, প্রতিবছর ৫-৬ শতাংশ হারে উৎপাদন বাড়ছে। দেশের মানুষ প্রচুর পান করছে তাই বিক্রি করতে পারছি না। তৃণমূলের মানুষের অর্থনীতি বাড়ছে। জীবনধারণ ক্ষমতা বাড়ছে। খাওয়া বাড়লে রপ্তানি করা সম্ভব হবে না। উত্তরাঞ্চলে ২০-২২ বছর যাবত চা উৎপাদন হচ্ছে। যা মোট উৎপাদনের ১৫ শতাংশ। চা পাতা ও চা চাষ উত্তরাঞ্চলের জীবন পাল্টে দিয়েছে। সেখানকার শ্রমিকরা দৈনিক ৭শ টাকা করে আয় করছে। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র চা বাগানের মালিকদের দিকে না তাকালে তারা এগুতে পারবে না। আমরাও পারবো না। প্রধানমন্ত্রী সবাইকে নিয়ে সার্বিকভাবে আগাতে প্রস্তুত। শ্রমিকদের সাড়ে ৫ লাখ সন্তানদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থাও আমরা নিতে পারি।

টিপু মুনশি বলেন, চা চাষ ও উৎপাদন আগামীতে আরো বিস্তৃত হলে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে চা-শিল্পের সম্প্রসারণ জরুরি। মানুষ চা পান করবেই। সঙ্গে বিনোদনের ব্যবস্থাও যুক্ত করা যায়। চা জমির জন্য ইজারাকৃত জমিতে অন্যান্য অর্থকরি ফসল করা যেতে পারে তবে মূল উদ্দেশ্য থেকে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

ইমরান আহমদ এমপি বলেন, চা শিল্পের ইতিহাস ১৮০ বছরের। পৃথিবীর সব দেশেই চা পান জনপ্রিয়। শ্রমিকদের জন্য প্রধানমন্ত্রী যা করেছেন বা করে যাচ্ছেন সে জন্য নারীর ক্ষমতায়নে অনেক এগিয়েছে। তা ছাড়া সেখানকার শ্রমিকরা বাগানের এলাকা ছেড়ে যেতে চায় না। তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠালে তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা পরিবর্তন হবে। চা উৎপাদনের ৯৯ শতাংশ অবদান শ্রমিকদের। তাদের কল্যাণ সাধন করতে পারলে ভালো হয়। ১৪.৫৫ মিলিয়ন কেজি চা উত্তরবঙ্গ থেকে আসছে পতিত জমি থেকে।

ইমরান আহমদ বলেন, আমাদের প্রকল্পগুলোতে সাধারণত বড় বাগান বা কোম্পানিগুলো লাভবান হয়। ছোট ও ক্ষুদ্র বাগানগুলোকে সুবিধা দিতে হবে। ম্যানেজমেন্টের জন্য প্রশিক্ষণ দরকার। চা বোর্ডের অনেক আইন বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

ইমরান আহমদ বলেন, চা-বাগানের সঙ্গে ইকো-টুরিজম করা যেতে পারে। ছোট বাগানগুলো যেন যথাযথভাবে নিজেদের পাতাগুলো বিক্রি করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু ছোট বাগানগুলোর জন্য আলাদা প্রকল্প করতে হবে।

তপন কান্তি ঘোষ সভাপ্রধানের বক্তব্যে বলেন, দেশে বৃহৎ ও ক্ষুদ্রায়তন মিলে চা’য়ের মোট ভূমির পরিমাণ ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪২২.৬৯ একর। কৃষিতে যেমন সারসহ অন্যান্য ভর্তুকি দেয়া হয় এখানেও তা দিতে হবে। চারা দিতে হবে। চা বোর্ডের আয় বাড়াতে হবে ও ক্ষুদ্র কৃষদের চারাসহ সব সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। তিনি বলেন, চা পাতায় ১৮ টাকা কেজি দাম জেলা প্রশাসক নির্ধারণ করলেও তারা পাচ্ছেন ১০ টাকা। এটির সমাধান করতে হবে। সমতল ভূমিতে ২০২৫ সালে ১৪০ বিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যাচ্ছি।

আশরাফুল ইসলাম বলেন, ১৯৫৭ সালের ৪ জুন থেকে ২৩ অক্টোবর ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম বাঙালি হিসেবে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভারতীয় উপমহাদেশে ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামে ব্যক্তিপর্যায়ে প্রথম চা আবাদ শুরু করা হয়। আর বাণিজ্যিকভাবে ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় চা বাগান করা হয়।

বঙ্গবন্ধু দায়িত্ব নিয়ে মৌলবীবাজারের শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত টি রিসার্চ স্টেশন ল্যাবরেটরি ও লাইব্রেরি স্থাপন করে গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ করেন। এই সময়ে ‘টি-অ্যাক্ট-১৯৫০’ সংশোধন করে চা বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য ‘কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড-সিপিএফ’ চালু করেন। তিনি ১৯৭৩ সালে টি রিসার্চ স্টেশনকে চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে-বিটিআরআই উন্নীত করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর ব্যক্তিমালিকানাধীন ও পরিত্যক্ত চা বাগান পুনর্বাসন করে ‘বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রিজ ম্যানেজমেন্ট কমিটি-বিটিআইএমসি’ গঠন করেন। তিনি জানান, ২০২৫ সালে চা উৎপাদিত হবে ১৪০ মিলিয়ন কেজি। দেশের ১২৫ মিলিয়ন কেজি চাহিদা পূরণ করে ১৫ মিলিয়ন কেজি রপ্তানি করা সম্ভব হবে।

চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে ১৬৭টি বৃহৎ ও প্রায় ৮ হাজার ক্ষুদ্রাতয়নের বাগান রয়েছে। উদ্ভাবিত হয়েছে ২৩টি ক্লোন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে সমতলে চা বাগান শুরু করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ভারত থেকে চারা সংগ্রহ করে নিজ বাংলোতে তা উৎপাদন করে তা বাগানের কার্যক্রম গ্রহণ করেন পঞ্চগড়ে।

২০১৮ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ডের উদ্যোগে অনলাইন টি লাইসেন্স সিস্টেম চালু করা হলে বর্তমানে ঘরে বসে চা ব্যবসার লাইসেন্স নিচ্ছে মানুষ। এমনকি ২০১৭ সালে ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ মোবাইল অ্যাপস ও ২০২১ সালের ১৫ মার্চ চট্টগ্রামে ‘অনলাইন চা নিলাম কার্যক্রম’ চালু করা হয়েছে। ২০১৯ সালে চট্টগ্রামের বান্দরবানে একটি চা-প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা নির্মাণ করা হয়েছে। তা ছাড়া ২০২১ সালে উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ও নীলফামারীতে ক্ষুদ্র পর্যায়ে ১২৩৫ একর জমিতে একটি প্রকল্প সফলভাবে সমাপ্ত হয়েছে।

মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ২০০৮ সালে ৯০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যের পরিধি থাকলেও বর্তমানে তা ৪১৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। স্থানীয় বাজারে চায়ের চাহিদা আছে। এই ব্যবসা সম্প্রসারণ করা সম্ভব।

উল্লেখ্য ২০২০ সালের ২০ জুলাই মন্ত্রিপরিষদের সভায় ৪ জুনকে জাতীয় চা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে ২০২১ সালে প্রথম দিবসটি পালিত হয়। চা বোর্ড জানায়, ভবিষ্যতে চা বাগানের রোপনযোগ্য ভূমির পরিমাণ ১ লাখ ৫২ হাজার ৫৬২.৭৩ একর। ২০২১ সালে একর প্রতি গড় চা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৬৯৭ কেজি। এ খাতে মোট শ্রমিকের সংখ্যা ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯৭ জন। মোট ক্ষুদ্রায়তন চা চাষির সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। তা ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, বাহরাইন, যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড, ফ্রান্স, সাইপ্রাস, গ্রিস, চীন, জাপান, মরিশাস, মালয়েশিয়া, কানাডা, ভারত, ইতালি, কুয়েত, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব, সুইজারল্যান্ড, সলোমন আইল্যান্ড, ইউএই, ইউএসএসহ বিশে^র ২৩টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।

‘উন্নয়নের পথনকশা: বাংলাদেশ চা শিল্প’ শিরোনামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি ২০১৬-২০ সাল পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদী, ২০১৬-২৫ মধ্যমেয়াদী ও ২০১৬-৩০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদীসহ ১১টি প্রকল্প গ্রহণ করেন।

চা উৎপাদন ও রপ্তানির বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, ২০২১ সালে ৯৬.৫১ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। সেখানে শূন্য দশমিক ৬৮ মিলিয়ন কেজি রপ্তানি করা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া ২০২০ সালে উৎপাদিত হয়েছে ৮৬.৩৯ মিলিয়ন কেজি ও রপ্তানি হয়েছে ২.১৭ মিলিয়ন কেজি। ২০১৯ সালে ৯৬.০৭ উৎপাদান ও শূন্য দশমিক ৬০ মিলিয়ন রপ্তানি, ২০১৮ সালে উৎপাদন ৮২.১৩ ও রপ্তানি শূন্য দশমিক ৬৫, ২০১৭ সালে উৎপাদন ৭৮.৯৫ ও রপ্তানি ২.৪৭, ২০১৬ সালে উৎপাদন ৮৫.০৫ ও রপ্তানি শূন্য দশমিক ৪৭, ২০১৫ সালে উৎপাদন ৬৭.৩৮ ও রপ্তানি শূন্য দশমিক ৫৫, ২০১৪ সালে উৎপাদন ৬৩.৮৮ ও রপ্তানি ২.৬৬, ২০১৩ সালে উৎপাদন ৬৬.২৬ ও রপ্তানি শূন্য দশমিক ৫৪ এবং ২০১২ সালে উৎপাদন ৬২.৫২ ও রপ্তানি ১.৫৬ মিলিয়ন কেজি ছিল। গত ১০ বছরের মধ্যে ২০১৪ সালে ২.৬৬ মিলিয়ন কেজি রপ্তানিই সবচেয়ে বড় পরিমাণ।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন