ক্যাম্পাসের আড্ডায় একবার বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক জ্বালানির উৎস কমে আসার বিষয়টি উঠে এলো। এক বন্ধু যুক্তি দিলো মধ্যপ্রাচ্যের খনিগুলো তেলশূন্য হয়ে পড়লে তাদের বিকল্প অর্থনীতির দিকে যেতে হবে। বিশ্বরাজনীতিতে আজকে তাদের যে ভূমিকা সেটাও বদলে যাবে। এমন মন্তব্যকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান পড়ুয়া এক বন্ধু বললো, তুই পাগল হয়েছিস! মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বে সবচেয়ে পবিত্র স্থান। ভূ-গর্ভে তাদের তেলের ভাণ্ডার অসীম। কখনই শেষ হতে পারে না।
প্রতিপক্ষ বন্ধুর এমন দাবির পর বহুক্ষণ চলেছে তর্কবিতর্ক। তার যুক্তি ছিল, পৃথিবী যেমন অসীম নয়, তেমনি এর সব সম্পদও সীমিত। যে হারে চাহিদা বাড়ছে তাতে জ্বালানির বর্তমান উৎসগুলো কোনো এক সময় শেষ হয়ে যাবে। এতে বিকল্প উৎসের সন্ধান না করলে বিপদে পড়তে হবে বিশ্বকে। কেউ হার না মেনেই শেষ হয়েছিল আজ থেকে প্রায় দুই দশক আগের সেই আড্ডা।
আজ অবশ্য বিশ্বপ্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভূগর্ভস্থ জীবাশ্ম জ্বালানির সংকট দিন দিন তীব্র হচ্ছে। উন্নত দেশই শুধু নয়, বিকল্প উৎসের সন্ধান করছে প্রতিটি দেশ। নবায়নযোগ্য জ্বালানির পাশাপাশি পারমাণবিক জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। বলা যায়, জ্বালানির উৎস নিয়ে ভূগোল পড়ুয়া সেই বন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি বা বিশ্বাসের এখন বদল ঘটেছে। আর মূল্যবোধের এই বদল ঘটাচ্ছে বাস্তবতা।
যদিও এই মুহূর্তে জ্বালানির সংকটের চেয়ে বিশ্বে সবচেয়ে বড় বিপদ পরিবেশ বিপর্যয়ের। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গত কয়েক দশকের মধ্যে যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে মানবসভ্যতার সামনে। তবে এক্ষেত্রেও দায়িত্বশীল নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর প্রথাগত মূল্যবোধের বৃত্তেই আটকে আছে সংকট উত্তোরণের সব মত-পথ।
করোনা মহামারির প্রাণঘাতি তাণ্ডবের মধ্যেই বিশ্ববাসী ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। বিশেষ করে শীতপ্রধান অঞ্চলেও ‘হামলে’ পড়ছে ভয়াবহ তাপদাহ (হিটওয়েব) বা হিটডোম। যা বেশি বিপদে ফেলছে উন্নত দেশগুলোকে। হিটডোমের পাশাপাশি অনেক শান্ত অঞ্চলেও ঘন ঘন প্রবলমাত্রার ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডব দেখা দিচ্ছে। চরিত্র বাদলাচ্ছে ভূমিকম্পও। এসব বিপর্যয়ে ইতোমধ্যে মৃত্যু অথবা উদ্বাস্তুর সংখ্যা প্রতিদিন রেকর্ড ভাঙছে। মানবপ্রজাতিকে আকস্মিক বিধ্বংসী পরিস্থিতির মুখোমুখি করার বার্তা দিচ্ছে। এর ওপর বায়ুদূষণ, পানি দূষণ, মাটি দূষণ, সমুদ্র দূষণসহ বহুবিধ দূষণ মহামারির আকার নিয়েছে।
অথচ বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিপর্যয়ের মহাবিপদের সেই পদধ্বনি কানে বাজলেও অনেক ক্ষেত্রেই নির্বিকার বিশ্বনেতারা। বিশেষ করে বিশ্বরাজনীতির নিয়ন্ত্রক বা পরাশক্তির দেশগুলোর বেশিরভাগ নেতার প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সংকট প্রতিদিন ঘনীভূত হচ্ছে। ধরিত্রী বাঁচাতে, নানা কৌশলপত্র তৈরি করতে প্রতিবছরই নানা ধারনের বিশ্ব সম্মেলন হচ্ছে। যাতে অংশ নিচ্ছেন বিশ্বের বড় বড় প্রভাবশালী নেতারা। বড় বড় অঙ্গীকারও করছেন তারা। তবে নিজ দেশে ফিরে সেসব অঙ্গীকার বাস্তবায়নের উদ্যোগ খুবই কম দেখা যাচ্ছে। কারণ হিসেবে, নেতাদের প্রথাগত ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি আর বিশ্বাসকেই দায়ি করছেন অনেকে।
বিষয়টা আরও পরিষ্কার হয় যখন পরিবেশ বা জলবায়ু নিয়ে বিশ্বনেতাদের বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। স্মরণ করা যায় গত ২০১৯ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপশ্চিম অঞ্চলের তাপমাত্রা মাইনাস ৬০ ডিগ্রির নিচে নামার সময়টায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত কারণেই যে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঘটছে সেটাকে বিজ্ঞানীদের কাল্পনিক বিষয় হিসেবে দাবি করে আসা যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তখন এক হাস্যকর টুইট করেছিলেন। যেখানে লিখেছিলেন, ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং, তুমি কোথায়? তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। এখন আমাদের তোমাকে প্রয়োজন’।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই টুইটই প্রমাণ করে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ে তার মূল্যবোধ বা দৃষ্টিভঙ্গি কতটা ভ্রান্ত। ট্রাম্পের মতোই আরেক নেতা ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো। যিনি পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত আমাজন বন ধ্বংসে অসাধারণ ভূমিকা রেখে বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হয়েছেন। যার বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়ার পরিবেশগত ন্যায়বিচার প্রচারক সংগঠন ‘অলরাইজ’ হেগভিত্তিক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) মামলাও ঠুকে দিয়েছে।
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ এনে মামলায় দাবি করা হয়, ব্রাজিলের এই নেতা ব্যাপক প্রচার চালিয়ে পরিবেশের রক্ষকদের হত্যা করেছেন। আমাজন উজাড় করে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাধ্যমে বিশ্বের জনগোষ্ঠীকে বিপন্ন করে তুলছেন। আমাজনকে রক্ষার জন্য কাজ করে এমন আইন, সংস্থা ও ব্যক্তিদের পদ্ধতিগতভাবে অপসারণ, অকার্যকর ও নির্মূল করার চেষ্টা করছে বলসোনারোর প্রশাসন। প্রতিবছর আমাজনের চার হাজার বর্গকিলোমিটার রেইন ফরেস্ট ধ্বংসের জন্য দায়ী বলসোনারো। যিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ব্রাজিলে বনভূমি ধ্বংসের হার বেড়েছে ৮৮ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বউষ্ণায়নের ভয়াবহতার সঙ্গে অভিযোজনের কৌশল রপ্ত করতে ব্যর্থ হলে সভ্যতার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আর অভিযোজনের সবচেয়ে ভালো উপায় জীবনযাত্রার মানবৃদ্ধিসহ টেকসই উন্নয়নের সহায়ক পরিকল্পিত নগরায়ন। তবে তার আগে ইতি টানতে হবে প্রকৃতির ওপর মানুষের ভয়াবহ আগ্রাসনের।
তবে বিজ্ঞানীদের এই সতর্কবাতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েই চলেছেন পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প, ব্রাজিলের বলসোনারোর মতো গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের হাজার হাজার নেতা। যাদের ইন্ধনে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক বা পরিকল্পনাকারীরাও পরিবেশ-প্রতিবেশকে উপেক্ষা করে অনবরত উন্নয়ন আগ্রাসন চালাচ্ছেন। তারা অনেক সময় জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে অদৃষ্টের ওপর সবকিছু ন্যস্ত করছেন। যেসব নেতার সংখ্যা বিশ্বে হু হু করে বেড়ে চলেছে।
আবার এসব ক্ষমতামুখী, প্রবল পুঁজিবাদী, দৃষ্টিভঙ্গিপ্রতিবন্ধী বিশ্বনেতাদের হাত ধরেই বিশ্বব্যাপী পরিবেশের হুমকি হয়ে উঠছে করপোরেট কোম্পনিগুলো। যাদের কারণে ধ্বংস হচ্ছে আমাজনের মতো সুবিশাল সব বন। স্ট্যান্ড ডট আর্থ নামের সাপ্লাই চেইন রিসার্চ ফার্মের গবেষণা বলছে, বিশ্বব্যাপী জুতা আর মানিব্যাগ-হ্যান্ডব্যাগ সরবরাহ করতে যে কোটি কোটি গবাদি পশুর চামড়ার দরকার পড়ে, সেসব পশু লালন পালন করা যেতে পারে আমাজন অরণ্যেই। সেজন্যই ঘন জঙ্গল পুড়িয়ে দিতে তারা নানা কৌশল করে চলেছে। যাদের আশির্বাদ হয়ে দেখা দিচ্ছেন ব্রাজিল প্রেসিডেন্টদের মতো নেতারা।
সেই গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, ভোক্তাদের মানিব্যাগ, হ্যান্ডব্যাগ ও জুতা সরবরাহ অব্যাহত রাখতে, বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন শিল্পকে ২০২৫ সালের মধ্যে ফি বছর ৪৩ কোটি গরু জবাই করতে হবে। গবেষণায় প্রমাণিত, বিশ্বের ৮৪টি ফ্যাশন কোম্পানির মধ্যে ২৩টিরই আমাজন বন উজাড়ের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট নীতি রয়েছে।
মূলত, ক্ষমতা আর নির্বাচনমুখী রাজনীতিকদের হাত ধরে ট্রাম্প-বোলসোনারোদের বিপজ্জনক স্বর্গে পরিণত হচ্ছে আজকের বিশ্ব। অন্যদিকে আবার বিশ্বের বেশিরভাগ গণমাধ্যমই এখন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বিপজ্জনক রাজনৈতিক দর্শনে। যে কারণে সামাজিক মানসিকতারও বদল ঘটছে। প্রযুক্তি, জ্ঞান বা দর্শনমুখী দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে অর্থ-ক্ষমতা আর রাজনীতিমুখী প্রবণতা বাড়ছে। শুধু উন্নত বিশ্বই নয়, উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেও রাজনীতিতে এখন ‘রিয়ালপলিটিক’ তত্ত্বের প্রভাব বাড়ছে। যেখানে ‘নীতি-আদর্শের বদলে ক্ষমতার ভিত্তিতে অনুসৃত নীতিই’ প্রধান। তাতে যদি পরিবেশের বিপর্যয়ও হয় তাতেও কোনো ক্ষতি নেই নেতাদের।
গত কয়েক দশক ধরে বিশ্বে রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলগুলো বেশি বেশি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসছে। ক্ষমতাসীন এসব রাজনৈতিক দলের নেতারা যে নীতি বা পথ অনুরসরণ করছেন তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জনতুষ্টিবাদের ভিত্তিতে। যেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত থাকছে পরিবেশ। বিশ্বনেতাদের ব্যক্তিগত প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গির বৃত্তেই আটকে আছে বিশ্ব পরিবেশের ভাগ্য।
আনন্দবাজার/শহক