প্রাণ নয় পণ্যমেলা–
‘শঠতায় বাণিজ্য লক্ষ্মী’। ব্যতিক্রম থাকলেও জেলা-উপজেলার মেলা আয়োজকরা অধিকাংশই কেবলমাত্র পকেট ভরার জন্য শঠতায় বাণিজ্য লক্ষ্মী চেতনা লালন করছেন। মেলা করতে গিয়ে বৈধ পথকে পায়ে ঠেলে তারা দ্রুতই কোটিপতি হওয়ার লক্ষ্যে ভয়ংকর রকমের শঠতার আশ্রয় নিচ্ছেন। গত এক দশক আগের মেলার চিত্র আমূল পালটে গেছে। বড় পুঁজির অধিক মুনাফা লোভীদের দাপটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ রুচিশীল শিক্ষিত লোকজন এই ব্যবসায় খাবি খাচ্ছেন। এতে করে ভোক্তা অধিকার, দেশীয় পণ্য উৎপাদকদের স্বার্থ রক্ষা কিংবা শিল্পের সেবা নয়, কেবলমাত্র অধিক মুনাফা অর্জনই মূখ্য হয়ে উঠেছে।
আজকের পেশাদার মেলা আয়োজকরা জেলার ব্যবসা বাণিজ্যের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্টাস্ট্রিজকে এড়িয়ে সহজে অধিক লাভের পথ বেছে নিচ্ছেন। চেম্বারের পরিবর্তে পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি (পুনাক) নামের ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যের কারণে সবাই সেদিকেই ঝুঁকছে। যেখানে যেভাবে পারা যায় তাই কাজে লাগানো হচ্ছে। এদের পকেট ভারীর কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে বিসিক, মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী থেকে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড পর্যন্ত। পুনাকের মেলায় পুলিশ পরিবারের নারীদের অংশগ্রহণ নামেমাত্র, কেবলমাত্র অলংকারীক।
শুধু চেম্বারসমূহ নয়, কোনো কোনো জেলায় মেলা আয়োজনের ক্ষেত্রে অনুমতি প্রদানে জেলা প্রশাসকের অসহায়ত্বও প্রকট হয়ে উঠেছে। সে কারণেই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান গোপালগঞ্জের শিক্ষিত যুবক সিরাজুল ইসলাম, আলী নাজির শাহীন এবং মজিবর রহমান বেলাল প্রমুখ সুস্থ ধারার মেলা আয়োজকরা নিজেদের হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। সিরাজ একজন পাকিস্তানি ঘরাণার উর্দূভাষী মেলা সংগঠকের কূটচালে পুঁজি হারিয়ে আয়োজকদের তালিকা থেকে ছিটকে পড়ে বেকার এবং অসহায় জীবন যাপন করছেন।
বর্তমান মেলা আয়োজকদের কেউ কেউ বিভ্রান্ত করে কিংবা নগদ লক্ষ্মী দিয়ে প্রশাসনের কোনো কোনো স্তরে এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলে দারুণভাবে প্রশ্রয় পাচ্ছেন। ফলে জেলা-উপজেলায় আয়োজিত অধিকাংশ মেলা ভোক্তা এবং দেশীয় উৎপাদকদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে। সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।
বাণিজ্য মেলায় সরকারী নীতিমালা বাস্তবায়ন, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং জনস্বার্থ সংরক্ষণের জন্য প্রস্তাবিত ট্রেড ফেয়ার গভঃরুল করাপশন এন্ড পাবলিক ইন্টারেস্ট (টিএফজিআরসিপিআই)-এর পর্যবেক্ষণে এইসব চিত্র উঠে এসেছে। টিএফজিআরসিপিআই- এর পর্যবেক্ষণে দেশের করনা পরিস্থিতি সহনীয় হয়ে আসলে মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত গত তিন মাসেই রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলা- উপজেলায় শতাধিক মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব মেলার লেন-দেনের পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এর প্রায় পুরোটাই হয়েছে অবৈধভাবে।
টিএফজিআরসিপিআই জানায়, বিগত রমজানে মিরপুর-১৪ এলাকায় ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের আওতাধীন রজনীগন্ধা সুপার মার্কেট সংলগ্ন মাঠসহ এপ্রিল-মে মাসে কেবলমাত্র ঢাকা শহরেই ২২টি মেলার আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে ২০টিরই কোন অনুমতি ছিলো না। আবার কয়েকটি বৃহৎ মেলার জন্য আবশ্যিক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতির তোয়াক্কা করা হয়নি।
রজনীগন্ধা মার্কেটের প্রায় তিন শতাধিক ব্যবসায়ীর তীব্র প্রতিক্রিয়া সত্বেও নিজেকে তাঁত বোর্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ভূয়া পরিচয় দানকারী এক ব্যক্তি রমজানে সবচেয়ে বড় মেলাটির আয়োজক ছিলেন। তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতির ধার ধারেননি।
কারওয়ান বাজারে তাঁত বোর্ডের গ্যারেজে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের নামে একটি এবং মুগ্দা থানাধীন ওয়াসা রোডে জামদানি ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের নামে অপর একটি মিলে মাত্র দুইটি মেলা অনুমতিপ্রাপ্ত হয়। এর মধ্যে আবার কারওয়ান বাজারে তাঁত বোর্ডের গ্যারেজে অনুষ্ঠিত মেলার অনুমতির বিষয়টি ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
যাত্রাবাড়ি থানার আওতাধীন প্রধান সড়কের পাশে পুলিশের সামনেই অনুমতিবিহীন একটি মেলা চলেছে বেপড়োয়াভাবে। শনির আখড়া ওভার ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় ঈদ তাঁত বস্ত্র নামের মেলাটি অনুমতি ছাড়াই দেড়মাস চুটিয়ে ব্যবসা করেছে।
কামরাঙ্গীর চর থানাধীন কুড়ারঘাট এলাকায় ৩০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের সামনে অনুমতিবিহীন ঈদ মেলাকে কেন্দ্র করে এক ব্যাক্তি খুন হন। এই থানার ঠোটা এলাকার মুসলিমবাগ টাওয়ার মাঠের অবৈধ মেলায় টিকিট নিয়ে প্রবেশ করতে হয় ক্রেতা-দর্শকদের।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মেলা বিষয়ক পরিপত্রকে অবজ্ঞা করে ঈদ পরবর্তী সময়ে মেলা আয়োজকরা যার যার সুবিধাজনক স্থানে হুমরি খেয়ে পড়েন বলে টিএফজিআরসিপিআই’র পর্যবেক্ষণ। এ সময়ে বিভিন্ন জেলা শহরে একযোগে প্রায় ৩০টি বড় আকারের মেলার উদ্যোগ নেয়া হয়। ফলে অধিকাংশ মেলা স্টল সংকটে পড়ে। কোনো কোনো আয়োজক ১৫/২০ লাখ টাকা স্টল মালিকদের কাছে লগ্নী করে তাদের নিয়ে আসেন। বার কয়েক তারিখ পিছিয়েও কয়েকটি মেলা উদ্বোধনের সময়ে একটিও স্টল ছিল না।
নীতিমালা লঙ্ঘন করে মেলা চলমান রয়েছে মানিকগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, নরসিংদী, নওগাঁ, পটুয়াখালি, ও গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে। এসব মেলার অধিকাংশেই ‘শঠতায় বাণিজ্য লক্ষ্মী’ চেতনা প্রকট হয়েছে।
বিগত তিন মাসে মেলা করার ক্ষেত্রে অধিক মুনাফালোভী কিছু আয়োজক নানা ধরনের ফন্দি-ফিকির এবং বিচিত্রসব নাম ব্যবহার করছেন। শঠতায় বাণিজ্য লক্ষ্মী চেতনাকে উৎকটভাবে তুলে ধরেছে জে,বি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে সম্প্রতি মেলা বাণিজ্যে যুক্ত হওয়া একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি মেলা আয়োজনে এসেই দেশের সর্বোচ্চ সম্মানের অবস্থানে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরও বিভ্রান্ত এবং বিতর্কিত করতে ছাড়েনি। প্রতিষ্ঠানটি তাদের গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে বীর মুক্তিযোদ্ধাধের নাম যুক্ত করে সেখানে আয়োজিত মেলার স্টল প্রাপ্তির জন্য একটি প্রচার পত্র দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিয়েছে। মেলার নাম দিয়েছে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা হস্ত ও কুটির শিল্প ও পণ্য মেলা -২০২২’। আয়োজনে: ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সুন্দরগঞ্জ ও জে,বি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল’।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠে মেলা করার ক্ষেত্রে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে জে,বি ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের ভাষায় ‘ভিন্ন ধর্মী’ এই মেলার স্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ‘সুন্দরগঞ্জ আব্দুল মজিদ সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ’। ‘কোন অবস্থায় মেলা উদ্বোধনের সময়সীমা পরিবর্তন করা হবে না’ মর্মে প্রচারপত্রে অঙ্গীকার থাকলেও চার দফা তারিখ পরিবর্তন করা হয়। শেষপর্যন্ত অধিকাংশ স্টল ফাঁকা রেখেই জুয়া খেলার আয়ের ওপর ভর করে গত ২৮ মে মেলাটি উদ্বোধন করা হয়।
সেদিন থেকেই জে,বি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামের ঐ প্রতিষ্ঠান ২শতাধিক সিএনজিতে জোড়া মাইক লাগিয়ে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের এস.এস.সি পরীক্ষার মাত্র কয়েকদিন আগে কানফাটা শব্দ করে সুন্দরগঞ্জ ছাড়াও গাইবান্ধার বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত জুয়ার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এই জে,বি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল মাত্র মাস দুয়েক আগে গাইবান্ধায় পুলিশলাইন মাঠে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিভ্রান্ত করে অপর একটি মেলার নামে একই ধরনের জুয়ার আসর বসিয়েছিল। বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে আনন্দবাজারের এই প্রতিনিধিকে ভীতি প্রদর্শন করে তিনি বলেন ‘আপনার নামে তো একটি মামলা হয়েছে, গাইবান্ধায় নয়, সিরাজগঞ্জে। আমার কাছে সেই মামলার কাগজ আছে, আপনাকে পাঠিয়ে দেবো’। সেই মেলার বিষয়ে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসকের কাছে জানতে চাইলে তখন তিনি প্রথমে জে,বি’র জুয়ার আসর এবং পরে মেলাটিই বন্ধ করে দেন।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আশরাফুল আলম সরকার জানতে চাইলে ক্ষোভ প্রকাশ করে আনন্দ বাজারকে বলেন ‘আমি নৌকা মার্কার চেয়ারম্যান, আমি চাই অবিলম্বে এই জুয়ার আসর বন্ধ করা হোক। জুয়া, মদ এসবের বিরুদ্ধে অবস্থান আমার’।
সুন্দরগঞ্জে সরকারি হাই স্কুল মাঠে এস.এস.সি পরীক্ষার ঠিক কয়েকদিন আগে শুরু হওয়া চলমান মেলা এবং জুয়ার আসর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক মো. অলিউর রহমান বলেন, সেখানে জুয়া খেলা চালানো হচ্ছে বলে জেনেছি। এটি খুবই অনভিপ্রেত, ব্যবস্থা নেবো। সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধারা এসে বলেছেন, মেলাটি করলে তারা একটি মাইক্রোবাস পাবেন। তাই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকে একটি পরিচ্ছন্ন মেলা হবে বিবেচনায় অনুমতি দিয়েছি। তাতে শর্ত দেয়া আছে জুয়া, হাউজি, লটারিসহ কোন অনৈতিক কাজ করা যাবে না। পরে এই প্রতিবেদন লেখার সময় জনাব অলিউর রহমান আনন্দবাজার প্রতিনিধিকে মোবাইল করে জানান, সুন্দরগঞ্জে জুয়ার আসর বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওটি বন্ধ হয়ে গেছে। পুলিশ সুপারসহ আমি ওই মেলায় যাচ্ছি।
বিষয়ে জানতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষের সঙ্গে বার কয়েক যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। ব্যক্তিগত সহকারী বলেছেন, স্যার কেবিনেট মিটিংয়ে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো. আমিনুল ইসলাম আনন্দবাজারকে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সিনিয়র সচিবের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। তবে তিনি মেলা বিষয়ে ২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বরের পরিপত্রটিই বহাল রয়েছে বলে জানান।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. ওয়াহিদুজ্জামান আনন্দবাজারকে বলেন, জেলা-উপজেলার অনুমতির বিষয় জেলা প্রশাসকরাই দেখেন। মেলা আয়োজকদের শীর্ষ নেতা আমির হোসেনকে এই বিষয়ে জানার জন্য যোগাযোগ করলে তিনি ব্যস্ততার কারণে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।