এক সময় দেশে উৎপাদিত ভোজ্যতেল দিয়েই চাহিদা মেটানো হতো। সরিষা, তিল, তিসি, গর্জন, বাজনা, ভেণ্ডা, বাদামসহ বিভিন্ন ফসল থেকে তেল পাওয়া যেত। এখন তা শুধুই ইতিহাস। বর্তমানে দেশের চাহিদার ৮০ ভাগ ভোজ্যতেলই আমদানি করতে করতে হচ্ছে। আশির দশক থেকে আমেরিকার লোভনীয় প্রচারে সয়াবিনকে বুকে টেনে নিয়ে বাকিদের গলাধাক্কা দিয়েছে বাঙালি। সেই গলাধাক্কা এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন সয়াবিন, পামতেল ছাড়া রান্না কল্পনাই করা যায় না।
জনপ্রিয় ভোজ্যতেল সয়াবিনের প্রচার-প্রসার আমেরিকা চালালেও বাংলাদেশে বেশিরভাগ সয়াবিন আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। বিশ্বের অন্তত ৩০ ভাগ তেলই দেশ রপ্তানি করে থাকে দেশ দুটি। তবে চলমান যুদ্ধের কারণে সয়াবিনের সংকট বেড়েছে। সয়াবিনের এই সংকট ভোজ্যতেলের আরেক উৎস পাম তেলের বাজারেও অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে।
সয়াবিনের মতোই পাম তেল এক ধরনের ভোজ্য উদ্ভিজ্জ তেল। যা পাম ফলের মধ্যবর্তী অংশ হতে পাওয়া যায়। উচ্চ বিটা-ক্যারোটিনের কারণে স্বাভাবিকভাবেই পাম তেল লালচে রংয়ের হয়। একই ফলের শাঁস (বীজ) হতে পাম শাঁসের (বীজের) তেল পাওয়া যায়। আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ব্রাজিল অঞ্চলে রান্নায় পামতেলের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে।
সয়াবিনের সঙ্গে পাল্লা দেয়া পামতেলের একচ্ছত্র বিশ্ববাজার দখলে রেখেখেছে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া। অবশ্য দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আরো কয়েকটি দেশে পাম চাষ হলেও বিশ্বের ৯০ ভাগ উৎপাদন ও যোগান দেয় ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া। এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে গেল ২৮ এপ্রিল থেকে বিশ্ববাজারে পামতেল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এতে তেলের বাজার আরেক দফা তেতে ওঠে।
তবে পামতেল যে শুধু ভোজ্য তেল হিসেবেই ব্যবহার হচ্ছে তা নয়, বরং লিপস্টিক বলুন বা সাবান, শেভিং ফোম বা আইসক্রিম- সব কিছুতেই এখন কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে পাম তেল। আজকাল সুপার মার্কেটগুলোতে যত প্যাকেটজাত সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে তার অর্ধেকেই পাম তেল ব্যবহৃত হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার একতরফা সিদ্ধান্তে একেবারেই বিপাকে পড়ে রান্নাঘরসহ প্রসাধনী উৎপাদনকারীরা।
অবশ্য পামতেলের ধোঁয়াশা কেটে গেছে গতকাল সোমবার থেকে। রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে আর রপ্তানি শুরু করেছে ইন্দোনেশিয়া। রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ার কারণে দেশটিতে প্রতিনিয়তই ক্ষোভ বাড়ছিল পামচাষিদের। অবশেষে প্রেসিডেন্ট জোকো ইউদোদো গত ১৯ মে রপ্তানি খুলে দেয়ার ঘোষণা দেন। এতে পামতেল বিক্রির সুযোগ পেয়ে আবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন ইন্দোনেশিয়ার চাষিরা। তবে পামতেলের উৎপাদনের পেছনে রয়েছে ইন্দোনেশিয়ার চাষিদের করুণ ইতিহাসে।
১৯৯০ এর দশকে সুমাত্রা দ্বীপে আসে একটি পাম অয়েল কোম্পানি। তারা প্রাচুর্য আর উন্নয়ন নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দেয়। এখানকার বাসিন্দা ওরাং রিম্বার লোকেরা বলেন, কোম্পানি বলেছিল এখানে পাম তেলবীজের গাছ লাগানো হবে। এর বিনিময়ে তারা অর্ধেকের বেশি জমি ফেরত পাবে। এটি ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি প্রাণবৈচিত্র সমৃদ্ধ বনভূমির অন্যতম। তাছাড়া বোর্নিও দ্বীপটি ছিল ঘন বনে ঢাকা। এখন সেখানে মাইলের পর মাইল ধরে পামগাছের ক্ষেত।
ইন্দোনেশিয়ায় ২০০৭ সালে একটি আইন করা হয়- যার ফলে যে কোনো নতুন আবাদ তৈরি করতে হলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে তার এক পঞ্চমাংশ দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। যাতে সেখানকার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীগুলো দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু অভিযোগ উঠতে থাকে যে অনেক কোম্পানিই তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি, প্লাজমা দেবার আইনি বাধ্যবাধকতা রক্ষা করেনি।
বনভূমি উজাড়ের কারণে জনগোষ্ঠীগুলো প্রতি বছর কম করে হলেও ৯ কোটি ডলার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ২০১৫ সালে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের মধ্যস্থতায় একটি চুক্তি হয়- যাতে সেলিম গ্রুপ একটি লিখিত অঙ্গীকারে স্বাক্ষর করে। এতে ওরাং রিম্বাকে প্লাজমা দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। পরিবেশবাদীরা বলছে, আরও বেশি জমিতে পাম তেল চাষের জন্য ইন্দোনেশিয়ার রেইনফরেস্ট ক্রমেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। যেমন ১৯৬৭ সালে ইন্দোনেশিয়ায় অয়েল পামের চাষ হয়েছিলো ২ হাজার বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলে। আর এখন তা ৩০ হাজার বর্গ কিলোমিটার ছাড়িয়ে গেছে।
এভাবে বন ধ্বংস হতে থাকায় অবমুক্ত হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাইঅক্সাইড। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর ইন্দোনেশিয়া সর্বোচ্চ কার্বন নির্গমণকারী দেশে পরিণত হয়েছে। সেইসঙ্গে দেশটিতে সামাজিক সংঘাত ছড়িয়ে দিচ্ছে এই পাম তেল। কেননা বন কাটার কারণে আদিবাসীরা তাদের ঘরবাড়ি হারাচ্ছে। এছাড়া ওরাং-ওটাংসহ সুমাত্রা ও বোর্নিওর হাতি, বাঘ ও গন্ডারেরাও আজ হুমকির মুখোমুখি।
পামচাষের ইতিহাস
গত ১৮০০ সালের শেষ দশকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মিশরের অ্যাবাইডোসে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পুরনো একটি সমাধিতে একটি পদার্থ আবিষ্কার করেন। পরে গবেষণা করে জানতে পারেন, সেটি ছিল মূলত পামতেল। ধারণা করা হয়, আরব ব্যবসায়ীরা পামতেল মিশরে নিয়ে আসেন। আফ্রিকান পামতেল পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোতে স্বীকৃত হয়েছে। ইউরোপীয় বণিকরা মাঝে মাঝে পশ্চিম আফ্রিকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পামতেল কিনতো ইউরোপে রান্নার তেল হিসাবে ব্যবহারের জন্য।
শিল্পবিপ্লবের সময় যন্ত্রপাতির জন্য পিচ্ছিলকারক (লুব্রিকেন্ট) হিসেবে ব্যবহারের জন্য পাম তেল ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে পরবর্তীতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সাবান পণ্যগুলির ভিত্তি পাম তেল। ১৮৭০ সালের দিকে পাম তেল ঘানা এবং নাইজেরিয়াসহ কিছু পশ্চিম আফ্রিকান দেশের রপ্তানির প্রধান পণ্য ছিল।
তেলের মিলগুলো বিভিন্নভাবে পাম তেল পণ্যগুলি পরিশোধন প্রক্রিয়া ব্যবহার করে থাকে। প্রথমে পামকে ভাঙা হয়, স্ফটিককরণ এবং পৃথক প্রক্রিয়ার সাথে সলিড (পাম স্টিয়ারিন) এবং তরল (ওলিন) করা হয়। তারপরে গলনশীল ও রেশম জাতীয় পদার্থ দূর করা হয়। তারপরে তেল ছাঁকন ও ধলাই করা হয়। অনেক কোম্পানি রান্নার তেল হিসাবে পাম তেলকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় পরিশোধন করে বাজারজাত করে।
১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে লাল পাম তেল তৈরি করা হতো পাম ফল থেকে। শীতকালে পাম তেল জমাট বেধে যেতো এবং পরবর্তিতে রান্নার তেল হিসাবে ব্যবহারের জন্য বোতলজাত করা শুরু হয়েছে। মেয়োনেজ এবং উদ্ভিজ্জ তেল মিশ্রিত হিসাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এতে প্রায় ৫০ শতাংশ সম্পৃক্ত চর্বি- পামের পরিমাণ যথেষ্ট কম এবং ৪০ শতাংশ অসম্পৃক্ত ফ্যাট এবং ১০ শতাংশ পলিয়নস্যাচুরেটেড ফ্যাট।
গত ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাপী পাম তেলের উৎপাদন ছিল আনুমানিক ৬২.৬ মিলিয়ন টন। যা ২০১৫ সালের তুলনায় ২.৭ মিলিয়ন টন বেশি। ২০১৬ সালে পাম তেলের উৎপাদন মূল্য ছিল আনুমানিক ৩৯.৩ বিলিয়ন ডলার। যা গত বছর সংরক্ষিত উৎপাদন চিত্রের তুলনায় ২.৪ বিলিয়ন ডলার (বা +৭ শতাংশ) বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৬২ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী বার্ষিক পাম তেল রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে অর্ধ মিলিয়ন থেকে ২.৪ মিলিয়ন টন এবং ২০০৮ সালে বিশ্বে পাম তেল এবং পাম শাঁসের তেলের উৎপাদিত পরিমাণ ৪৮ মিলিয়ন টন।
চাষাবাদ ও প্রক্রিয়া
এটি বর্ষজীবী উদ্ভিদ। টানা ৬০-৭০ বছর ফল দেয়। ঝড় জলোচ্ছাসে গাছের ক্ষতি হয় না। অন্যান্য গাছ থেকে ১০ গুণ বেশি অক্সিজেন দেয়। ২০ ফুট দূরত্বে ২ ফুট বাই ২ ফুট গর্ত করে মাটির সাথে ৫/৭ কেজি গোবর, ১শ গ্রাম টিএসপি ও ৫০ গ্রাম এমওপি মিশিয়ে চারা রোপন করতে হয়। ফল থেকে হাতে ও মেশিনে তেল সংগ্রহ করা হয়। ফল পানিতে সিদ্ধ করে চিপন দিলে তেল বের হয়। উল্লেখযোগ্য ক্যালোরির উৎস হিসাবে এটি কাজে লাগে। পাম তেল অনেক কিছু রান্নার জন্য প্রধান তালিকায় আছে। বিশ্বব্যপী গড় করে দেখা গিয়েছে, ২০১৫ সালে প্রতিটি মানুষ সাড়ে ৭ কেজি পাম তেল গ্রহণ করেছে। পাম তেল ব্যবহারে রোগের ঝুঁকি আছে, কিন্তু গবেষণায় সেটা খুব কম বলে দেখানো হয়েছে।
আনন্দবাজার/শহক




