ঢাকা | বুধবার
১৫ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১লা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাজস্বের চেয়ে ক্ষতি বেশি

সুনির্দিষ্ট কর আরোপের মাধ্যমে সিগারেটসহ সব তামাকপণ্যের দাম বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স (আত্মা)। গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলনে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য তামাক কর ও দাম সংক্রান্ত বাজেট প্রস্তাব গণমাধ্যমের কাছে তুলে ধরে সংগঠন দুটি। অনুষ্ঠান আয়োজনে সহযোগিতা করেছে ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস।

সংবাদ সম্মেলনে, সব ধরনের সিগারেটে ব্রান্ডে খুচরা মূল্যের ৬৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার দাবি রাখে সংগঠন দুটি। একই সঙ্গে মূল্যস্তরভিত্তিক সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ (সম্পূরক) শুল্ক প্রচলন করা, ফিল্টার যুক্ত ও ফিল্টার বিহীন বিড়িতে অভিন্ন করসহ খুচরা মূল্যের ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক চূড়ান্ত করার দাবি রাখেন।

সম্মেলনের শুরুতে এক প্রস্তাবে বলা হয়, তামাক খাত থেকে রাজস্ব আহরণে বাংলাদেশে কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। প্রতিবছর বাজেট তৈরির সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তামাক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসে এবং তাদের প্রস্তাবকে অগ্রাধিকার দিয়ে তামাকপণ্যের কর ও মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাকবিরোধীদের দেয়া প্রস্তাব কখনই তেমন একটা আমলে নেয়া হয় না।

প্রস্তাবে আরও বলা হয়, দেশে ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ (৩ কোটি ৭৮ লাখ) তামাক ব্যবহার করে। ধূমপান না করেও প্রায় ৩ কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বিভিন্ন পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র ও পাবলিক পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর এক লাখ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। একই সময় তামাকখাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের (২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা) চেয়ে অনেক বেশি। যার প্রেক্ষিতে এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে সিগারেটের মূল্য ও কর প্রস্তাব করে বলা হয়।

প্রস্তাবে সব সিগারেট ব্র্যান্ডে অভিন্ন করসহ খুচরা মূল্যের ৬৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক চূড়ান্ত করা, নিম্ন স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৩২ দশমিক ৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা, মধ্যম স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৭৫ টাকা নির্ধারণ করে ৪৮ দশমিক ৭৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক সম্পূরক আরোপ করা, উচ্চস্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরামূল্য ১২০ টাকা নির্ধারণ করে ৭৮ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা এবং প্রিমিয়ামস্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৯৭ দশমিক ৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার কথা বলা হয়।

এছাড়া মধ্য মেয়াদে (২০২২-২৩ থেকে ২০২৭-২৮ অর্থবছর) সিগারেটের ব্রান্ডসমূহের মধ্যে দাম ও করহারের ব্যবধান কমিয়ে মূল্যন্তরের সংখ্যা ৪টি থেকে দুটিতে নামিয়ে আনার আহ্বান জানায়। বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে মূল্য ও কর প্রস্তাবে বলা হয়, ফিল্টার যুক্ত ও ফিল্টার বিহীন বিডিতে অভিন্ন করভারসহ (সম্পূরক শুল্ক চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৪৫ শতাংশ) সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ (সম্পূরক) শুল্ক প্রচলন করা, ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১১ দশমিক ২৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়।

একই সঙ্গে ফিল্টারযুক্ত ২০ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২০ টাকা নির্ধারণ করে ৯ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা, জর্দা এবং গুলের কর ও দাম বৃদ্ধিসহ সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ শুল্ক (সম্পূরক শুল্ক চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৬০ শতাংশ) প্রচলন করা, প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৪৫ টাকা নির্ধারণ করে ২৭ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক (৬০ শতাংশ) আরোপ করা এবং প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক (৬০ শতাংশ) আরোপের প্রস্তাব করা হয়।

বাজেট পেশের ফলাফল উল্লেখ করে বলা হয়, সিগারেট থেকে সম্পূরক শুল্ক, স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ এবং ভ্যাট বাবদ ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় অর্জিত হবে, অর্থাৎ বিগারেট খাত থেকে ৩০ শতাংশ বাড়তি রাজস্ব আয় হবে। সিগারেটের ব্যাবহার ১৫ দশমিক ১ থেকে হ্রাস পেয়ে ১৪ শতাংশ হবে। প্রায় ১৩ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপান থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত হবে এবং ৮ লাখ ৯৫ হাজারের অধিক তরুণ ধূমপান শুরু করতে নিরুৎসাহিত হবে। দীর্ঘমেয়াদে ৪ লাখ ৪৫ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৪ লাখ ৪৮ হাজার তরুণ জনগোষ্ঠির অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে। বিড়ি এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে এসব পণ্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করবে এবং একইসাথে সরকারের রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে।

সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমানা হক বলেন, প্রস্তাবনাগুলোর সঙ্গে আমি সম্পূর্ণভাবে একমত। আমরা জানি যে তামাকের চাহিদা এবং যোগান কমানোর জন্য অনেকগুলো কৌশল রয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী একটি কৌশল হচ্ছে সটিকভাবে তামাকের ওপর কর আরোপ করে তামাকের চাহিদা কামনো, যোগান কমানো এবং এটিকে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাওয়া।

ড. রুমানা হক প্রশ্ন করে বলেন, তাহলে কি আমাদের দেশে তামাক কর বসানো হচ্ছে না? হ্যাঁ বসানো হচ্ছে। প্রতিবছরই আমরা দেখছি তামাকের ওপর কর আদায় এবং কর পরিবর্তন দেখছি। কিন্তু যেখানে সমস্যাটা হচ্ছে সেটা হলো আমরা সঠিকভাবে, কৌশলগত দিক দিয়ে তামাকের কর বসাতে পারছি না। যে কারণে আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পৌঁছাতে পারছি না। এভাবে চললে প্রধানমন্ত্রীর ২০৪১ সালের মধ্যে তামাক নির্মূলের লক্ষ্যও পূরণ হবে না বলে জানান।

প্রস্তাবনাগুলোর পক্ষে একমত পোষণ করে অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, আমরা একটা দাবি বেশ কিছুদিন ধরে করে আসছি, সেটা হচ্ছে ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো থেকে তাদের যে অংশ রয়েছে সেটা প্রত্যাহার করতে হবে সরকারকে। প্রত্যাহার না করলে তাদের আধিপত্য বাড়তে থাকবে এবং ফলস্বরুপ প্রধানমন্ত্রীর ২০৪১ সালের ঘোষণা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে না।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন