বৃহস্পতিবার, ১২ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৮শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দিল্লি যেন আগুনের চুল্লি

দিল্লি যেন আগুনের চুল্লি

গরমের ঋতু সবে শুরু হতে যাচ্ছে। আর তাতেই দাবদাহে পুড়ছে উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকা। ভারত ও পাকিস্তানের কিছু কিছু জায়গায় এরমধ্যেই রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছে গেছে তাপমাত্রা। গতকাল সোমবারের প্রাপ্ত রেকর্ডে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁই ছুঁই করছে। ভয়াবহ এই তাপপ্রবাহে চরম ঝুঁকিতে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ। আর এসবের জন্য বৈশ্বিক উষ্ণায়ন আর জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত এপ্রিলে উত্তরপশ্চিম ও মধ্য ভারতে গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ১২২ বছর আগে তাপ রেকর্ড শুরু হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ, এত সুদীর্ঘ বছরের ইতিহাসে এমন ছাড়খার করা উত্তাপের দেখা মেলেনি। ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগের তথ্যমতে, এপ্রিলে আলোচিত দুই অঞ্চলে তাপমাত্রা যথাক্রমে ৩৫.৯ ও ৩৭.৭৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়। গত শুক্রবার দিল্লির নজফগড়ের তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৬.১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এরপর গতকাল সোমবার তাপমাত্রা ৪৯ ডিগ্রি অতিক্রম করে যায়।

অন্যদিকে, পাকিস্তানে ভয়াবহ দাবদাহ চলছে। গত শনিবার সিন্ধু প্রদেশের জ্যাকোবাবাদে সর্বোচ্চ ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাও দেখা গেছে। করাচিতে অতটা তীব্র না হলেও গরম খুব একটা কমও ছিল না। গত শনিবারই করাচিতে একপর্যায়ে সর্বোচ্চ ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাও দেখা গিয়েছিল। এমন এক দিনে দুই ম্যাচ খেলা এক ক্রিকেটার হিট স্ট্রোকে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে খবর এসেছে। গতকাল পাকিস্তানে তাপমাত্রার নতুন রেকর্ডে দেখা গেছে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রির কাছাকাছি।

ইতোমধ্যে কমলা সতর্কতা জারি করেছে ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর। এতে বলা হয়েছে, দিল্লির তাপমাত্রা পৌঁছে যেতে পারে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। কিছুদিন আগেই ভারতে আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছিলেন, খুব শিগগিরই উত্তর ভারতের তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি পেরিয়ে যাবে। যা গতকাল দেখা গেছে বিভিন্ন এলাকায়।

এরমধ্যেই খরতাপ থেকে বাঁচতে কিছু রাজ্যে স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে। ফসলের ক্ষতির তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে। গরম বাড়ায় বিদ্যুৎ চাহিদা আকাশ্চুম্বী। এতে করে প্রচণ্ড চাপ পড়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহে। ভারতীয় কর্মকর্তারা, জনগণকে প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে না যাওয়া এবং প্রচুর পানি পানের পরামর্শ দিচ্ছেন।

আরও পড়ুনঃ  আগামী মাসেই আসছে মডার্নার ভ্যাকসিন

ভারতের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানেও তাপদাহে জনজীবন বিপর্যস্ত। দেশটির দক্ষিণপূর্ব সিন্ধু প্রদেশের জ্যাকোবাবাদ ও সিবি শহরে গত শুক্রবার তাপাঙ্ক রেকর্ড হয়েছে ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১১৬.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট। পাকিস্তনের আবহওয়া বিভাগ জানিয়েছে, ওইদিন উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত বিশ্বের যেকোনো শহরের তুলনায় বেশি তাপমাত্রা ওই দুটি শহরেই রেকর্ড করা হয়। পাকিস্তানের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী শেরী রেহমান এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথমবার ‘বসন্তহীন’ একটি বছর পাকিস্তানে দেখা যাচ্ছে।’

তাপদাহে স্বাস্থ্যঝুঁকি
চলমান তীব্র গরমের কারণে পাকিস্তানে কিডনি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছে দেশটির গণমাধ্যম। হিটস্ট্রোকের কারণে দেশটিতে বিশেষ করে সিন্ধু ও পাঞ্জাব প্রদেশে কিডনি, ডায়রিয়া ও গ্যাস্ট্রোএনটারিটিস রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। গত শনিবার সিন্ধু প্রদেশের জেকোবাবাদে ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। প্রদেশের অন্যান্য স্থানেও তীব্র গরম ছিল। বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানুষ এই তীব্র গরমে অস্থির হয়ে পুকুরের নোংরা পানি পান করায় ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।

আকু ওয়েদারের তথ্যমতে, গতকাল রবিবার স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টায় পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। অথচ একদিন পরেই সেই তাপমাত্রা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু সংকট আরও ঘন ঘন ও দীর্ঘ তাপদাহের জন্ম দিবে, এতে ভারত ও পাকিস্তান এ দুই দেশের শত কোটির বেশি জনতার জীবনধারণ দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।

জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) তথ্যমতে, জলবায়ু সংকটে সবচেয়ে বাজেভাবে প্রভাবিত দেশ দেশগুলোর মধ্যে ভারতও থাকবে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  ৪০ বছরে মধ্য দিল্লিতে সর্বোচ্চ বৃষ্টি

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি
গ্রীষ্মকালের মে ও জুন মাসেই সাধারণত তাপদাহ দেখা যায় ভারতে। কিন্তু এবছর শীত বিদায় নিতে না নিতেই মার্চ ও এপ্রিল থেকে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে। ফলে ‘ভারতের রুটির ঝুড়ি’ খ্যাত উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য পাঞ্জাবে লাখ লাখ কৃষি শ্রমিক গরমে ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে পড়ছে। প্রচণ্ড উত্তাপে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমির গমের ফসল ঝলসে যাচ্ছে। অথচ এই ফসলের ওপর নির্ভর করছে ভারতের কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের অন্নের যোগান।

পাঞ্জাব রাজ্যের কৃষি পরিচালক গুরবিন্দর সিং জানিয়েছেন, এপ্রিলে গড়ে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপবৃদ্ধি গমের ফলন কমিয়ে দিয়েছে। তিনি সিএনএনকে বলেছেন, ‘তাপদাহের কারণে আমরা হেক্টরপ্রতি ৫ কুইন্টাল (৫০০ কেজি) ফলন কমে আসার অনুমান করছি।’

আইপিসিসি’র গবেষক চাঁদনী সিং বলেছেন, প্রচণ্ড তাপে কৃষি শ্রমিকদের জন্য ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। কৃষক, নির্মাণ শ্রমিক, দিনমজদুরসহ যেসব মানুষ বাড়ির বাইরে কায়িক পরিশ্রম করেন তাদের কষ্টই হবে সর্বাধিক। কাজের কারণে একটু জিরিয়ে নেওয়া বা ঠাণ্ডা হওয়ার সুযোগও তাদের কম, নিজের বা পরিবারের খাদ্য যোগাতে গরমের মধ্যেই তাদের কাজে যেতে হচ্ছে।

স্কুল বন্ধ, ব্যাহত বিদ্যুৎ সরবরাহ
ভারতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান উৎস কয়লা। দেশটির কোনো কোনো স্থানে বিদ্যুৎ চাহিদা নাটকীয় হারে বাড়ায় দেখা দিয়েছে কয়লার স্বল্পতা। এতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় লাখ লাখ মানুষকে তীব্র গরমের মধ্যে বিদ্যুৎহীন থাকতে হচ্ছে। কয়েকটি এলাকায় দিনে সর্বোচ্চ ৯ ঘণ্টাও হয়েছে লোডশেডিং। গত সপ্তাহে দিল্লির মোট পাঁচটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে তিনটিতেই কয়লার মজুদ অতি-নিম্ন মাত্রায় বা ২৫ শতাংশে নেমে আসে। অথচ বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য এসব কেন্দ্রের ওপর রাজ্যটির রয়েছে ব্যাপক নির্ভরশীলতা।

আরও পড়ুনঃ  ৫ মাস পর হিলিতে ট্রেন চলাচল শুরু

জরুরি ভিত্তিতে কয়লাবাহী ট্রেন চলাচলে গতি আনতে চলতি মে মাসের শেষপর্যন্ত নির্ধারিত শিডিউলের ৬৫০টি ট্রেন ক্যানসেল করেছে ভারত। দ্রুতগতিতে সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলির কয়লার মজুদ পূরণে ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে দেশটির রেল মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন। ভারতীয় রেলওয়ে সারা দেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে কয়লার একটি প্রধান সরবরাহকারী।

এদিকে পশ্চিমবঙ্গ এবং ঊড়িষ্যাসহ ভারতের কয়েকটি রাজ্য ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা মোকাবিলা করতে স্কুল বন্ধ ঘোষণা করেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি গত সপ্তাহে সাংবাদিকদের বলেন, ‘স্কুলে যাওয়া অনেক শিশুর নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে, তারা এই দাবদাহ সহ্য করতে পারছে না।’

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবশ্য ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলো উভয়েই দাবদাহের ভয়াবহতা প্রশমনে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে স্কুল বন্ধ করা থেকে শুরু করে জনগণকে স্বাস্থ্য নির্দেশনা দেওয়ার মতো পদক্ষেপ।

তবে চাঁদনী সিং মনে করেন, আগামীর আরও ভয়াল তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় এখন থেকেই আরও বেশি প্রস্তুতি নিতে হবে। ‘উত্তাপ মোকাবিলার কোনো কর্মপরিকল্পনা আমাদের নেই, দিন দিন পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার ব্যবধান বেড়েই চলেছে। মানিয়ে চলা বা অভিযোজন সক্ষমতারও একটি সীমা রয়েছে। প্রতিনিয়ত দাবদাহ যেন মানুষের টিকে থাকার সেই সীমাকেই পরীক্ষার মধ্যে ফেলছে।’

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খাদ্য শস্যের ক্ষতির পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘তীব্র তাপদাহের প্রভাবে প্রকৃতির মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকা জীবানুরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে প্রাচীন রোগ-বালাই নতুন করে ফিরে আসে।’

এদিকে গরমের প্রখরতায় শিক্ষা-শ্রমের পাশাপাশি মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়ে বাধাগ্রস্ত হতে পারে উৎপাদনশীলতা। সবকিছু এ অঞ্চলের মানুষদের মিলিয়ে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

অনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন