ঢাকা | শুক্রবার
২১শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাজারের রাজা সয়াবিন

বাজারের রাজা সয়াবিন

বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ সয়াবিন তেল আমদানিকারক বাংলাদেশে এখন চলছে ভোজ্যতেলের রাজত্ব। যেখানে রাজার ভূমিকায় সয়াবিন তেল। ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের নির্বিঘ্ন সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। যা আমদানিকারক দেশগুলোকে এক ধরনের সংকেট ফেলে দেয়। তবে সেই সংকটের ভয়াবহতা বাংলাদেশে বেশি দেখা যাচ্ছে। যেখানে ভোজ্যতেলের চাহিদার ৭০ ভাগই করা হয় আমদানি। আর সয়াবিনে এমন পরনির্ভরতার সুযোগ নিয়ে ভালো ব্যবসা ফেঁদে বসার পরিকল্পনা নিয়েছেন দেশের শীর্ষ আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে দেশের বাজারে সয়াবিনের দাম বাড়ানো হতে থাকে। যা রীতিমত অস্বাভাবিক।

বলতে গেলে দাম বাড়ার কারণে বাজার থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে সয়াবিন। ঈদের আগের দিনে চরম সংকট দেখা দেয় তেল নিয়ে। ছোট বড় দোকানে ধর্ণা দিয়েও ক্রেতারা সয়াবিন পাচ্ছিলেন না। কিছু দোকানে দেখা মিললেও দাম শুনে ভোক্তার মাথা ঘুরে যাওয়ার অবস্থা। গত বৃহস্পতিবার সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৈঠক শেষে সয়াবিনের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়। যেখানে ভোক্তাপর্যায়ে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৯৮ ও খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৮০ টাকায় বিক্রি হবে। পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৮৫ টাকা। একইসঙ্গে প্রতিলিটার পাম অয়েলের দাম ১৭২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে বাজারে প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে দুশ টাকায়।

বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সচিবের সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গত বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানানো হয়। নতুন নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, আগের চেয়ে বোতলজাত সয়াবিন তেলে লিটারপ্রতি ৩০ টাকা এবং খোলা তেলে লিটারপ্রতি ৩৭ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া পাম অয়েলের দাম লিটারপ্রতি ৩৯ টাকা বেড়েছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে প্রতিলিটার ১৮০ টাকা, যা এতদিন বিক্রি হয়েছে ১৪০ টাকায়। বোতলজাত সয়াবিন তেল লিটারপ্রতি ৩৮ টাকা বাড়িয়ে ১৯৮ এবং ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হবে ৯৮৫ টাকায়। তাছাড়া এতদিন ১৩০ টাকায় বিক্রি হওয়া পরিশোধিত পাম সুপার তেল প্রতি লিটার ১৭২ টাকায় বিক্রি হবে।

এর আগে চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি সরকার প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৬৮ টাকা এবং খোলা তেলের দাম ১৪৩ টাকা, পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৭৯৫ টাকা ও পাম অয়েলের দাম ১৩৩ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। অবশ্য এর আগে ২৬ এপ্রিল ইন্দোনেশিয়ার পাম তেল রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণার পর এক রাতের ব্যবধানে চট্টগ্রামের বনেদি পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে মণপ্রতি ভোজ্যতেলের দাম ৮শ টাকা বেড়ে যায়। ফলে পাইকারিতে লিটারপ্রতি খোলা তেল ১৯৭ টাকা ও পামতেল ১৭৬ টাকায় বিক্রি হতে শুরু করে। এর প্রভাব গিয়ে পড়ে খুচরা বাজারে। তেলের দাম হঠাৎ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দোকানে তেলের সরবরাহও যায়।

আমদানি-রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ২০ লাখ টনের মধ্যে উৎপাদন হয় মাত্র তিন লাখ টন। বাকি ১৬ অথবা ১৭ লাখ টন বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে শুধু রমজান মাসেই দুই লাখ টন তেল অতিরিক্ত প্রয়োজন হয়। তবে সয়াবিনের উৎপাদন খাতও বড় হচ্ছে দিন দিন। বিশেষ করে চলতি শতকের শুরুর দশক থেকে গতি পেয়েছে দেশে সয়াবিন তেল উৎপাদন। এ ধারাবাহিকতায় গত বছর দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি তিন লাখ টন সয়াবিন তেল উৎপাদনের মাইলফলক ছাড়িয়েছে। তবে চাহিদা তুলনায় তা খুবই নগন্য।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎপাদনে না গেলে শুধু আমদানি করে সয়াবিনের বাজার নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত চার বছরে দাম বেড়ে যাওয়া ভোগ্যপণ্যের মধ্যে শীর্ষে ছিল সয়াবিন। ২০১৯ সালে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ছিল ১০৪ টাকা, পরের বছর তা বেড়ে হয় ১১৩ টাকা, ২০২১ সালে ১৩০ টাকা এবং চলতি বছরের শুরুতে ১৬৮ থেকে ১৭০ টাকা। যা এখন দুশ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।

চট্টগ্রামের বৃহত্তর ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জে কয়েকদিন আগেও প্রতিমণ সয়াবিন তেল (৩৭ দশমিক ৩২) সাড়ে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু গত ২৩ এপ্রিল ইন্দেনেশিয়ার পাম তেল রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে গত ২৪ এপ্রিল থেকে ৮শ টাকা বেড়ে প্রতিমণ খোলা সয়াবিন তেল ৭ হাজার ৩শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সে হিসেবে পাইকারিতে এতদিন লিটারপ্রতি ১৭৫ টাকায় বিক্রি হওয়া খোলা সয়াবিন তেল ১৯৭ টাকা ও ১৫৫ টাকায় বিক্রি হওয়া পামতেল ১৭৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ পাইকারিতেই লিটারপ্রতি খোলা তেলে ২২ টাকা ও পামতেলে ২১ টাকা বেড়েছে। সে হিসেবে খুচরা বাজারে ভোজ্যতেলের লিটার ২শ টাকা ছাড়িয়ে যায় মূলত গত ২৪ এপ্রিল থেকে।

এদিকে, গত ১৭ মার্চ খুচরা বাজারে লিটারপ্রতি বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬০, পামতেল ১৩৬ ও পাঁচ লিটার তেল ৭৬০ টাকায় বিক্রি করার সিদ্ধান্ত দেয় সরকার। অথচ বিশ্ববাজারে অস্থিরতা, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমসহ ব্যবসায়ীদের নানা অজুহাতে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। এতে ক্ষোভও প্রকাশ করছেন সাধারণ ভোক্তারা। তার ওপর ইন্দোনেশিয়ার পাম তেল রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা না করে নতুন করে আরেক দফা ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে দেয় পাইকাররা। শুধু তাই নয়, দাম বেড়ে যাবার কারণে ও ঈদকে সামনে রেখে পাইকাররা বাজারে তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগও খুচরা ব্যবসায়ীদের।

খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, ইন্দোনেশিয়ার তেল রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তে আমাদের দেশসহ সারাবিশ্বে ভোজ্যতেলে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবার আশংকা দেখা দিয়েছে। তার ওপর আমদানির পরিমাণও কমে গেছে। তাই তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। খাতুনগঞ্জের একাধিক ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী বলেন, তেলের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা আমাদের হাতে নেই। এটা মিল মালিক বা আমদানিকারকরা ভালো বলতে পারবেন। তবে সরবরাহ কমে যাওয়া, দীর্ঘদিন ধরে বাড়তি জাহাজ ভাড়ার প্রভাব তার ওপর নতুন করে ইন্দোনেশিয়ার তেল রপ্তানির বন্ধের সিদ্ধান্তে তেলের দাম বেড়েছে। মিল মালিক বা আমদানিকারকরা সরবরাহ বাড়ালে দাম কিছুটা হলেও কমতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্রেতা বলেন, দফায় দফায় ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হচ্ছে। আর ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাত খোঁজেন তেলের দাম বাড়ানোর জন্য। দীর্ঘদিন ধরে তেল নিয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণেই তেলের বাজারের আজ এ অবস্থা। এরা মনে হয় আমাদের আর বাঁচতে দেবে না।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক মো. আনিছুর রহমান বলেন, ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখছি না। প্রতিদিন অভিযান অব্যাহত আছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলেইশাস্তির আওতায় আনছি। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সবসময় বাজার অস্থির করে তোলার চেষ্টায় থাকেন। বিষয়টি আবারো খতিয়ে দেখবো। অকারণে তেলের দাম বাড়ালে কঠিন শাস্তির আওতায় আনা হবে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ চট্টগ্রামের ভাইস- প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, অজুহাত ধরে ধরে ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা দেশে একটা নিয়ম বা রীতিতে পরিণত হয়েছে। উছিলা পেলাম, দাম বাড়াবো—এই মেথডে চলছে ব্যবসা-বাণিজ্য। বিশ্বের অন্যান্য দেশে ধর্মীয় উৎসবে দাম কমিয়ে মানুষকে সহযোগিতা করে ব্যবসায়ীরা। আর আমাদের দেশে তার উল্টো চিত্র।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন