পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগই যে পানি শুধু তাই নয়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে জীবন বা প্রাণের অস্তিত্বও পানিনির্ভর। শত বছর ধরে বিজ্ঞানীরা ভিনগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য যে চেষ্টা করছেন সেখানে আগে তারা পানির সন্ধান করছেন। সে কারণে পানি যে জীবন- সেটা শুধু কথার কথা নয়, বৈজ্ঞানিক সত্য। অথচ পৃথিবীতে বিপুল পরিমাণ কতটুকুই বা পান করি আমরা? পৃথিবীতে ৯৭ শতাংশই পানি লবণাক্ত। প্রক্রিয়াকরণের ফলে পানের উপযোগী করা গেলেও বিশাল জলরাশি পানের যোগ্য নয়।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, পৃথিবীতে জমে থাকা বরফের নিচে পানযোগ্য পানি মাত্র ২ দশমিক ১৪ শতাংশ। আর ভূ-গর্ভস্থ পানি মাত্র শূন্য দশমিক ৬১ শতাংশ। অন্যদিকে, নদী, খাল-বিলে যে মিঠা পানি বা সারফেস ওয়াটার রয়েছে তার পরিমাণ মোট পানির মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য ৯ শতাংশ। ফলে বিশুদ্ধ পানির পরিমাণ মাত্র ৩ ভাগ। অথচ দূষণের কারণে বিশুদ্ধ পানির মাত্র ২ থেকে ১ শতাংশ ব্যবহার উপযোগী। শঙ্কার বিষয়, পৃথিবীতে বিশুদ্ধ পানির পরিমাণ বাড়ছে না। বরং দূষণের কারণে বিশুদ্ধ পানি দ্রুত কমে আসছে।
আরও পড়ুন:
গেল কয়েক দশক ধরে বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভূ-পৃষ্ঠের পানির প্রাপ্যতা ক্রমশ সীমিত হয়ে যাচ্ছে। এতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর সামগ্রিক নির্ভরতা বেড়ে চলেছে বলে মনে করছে জাতিসংঘ। ফলে পানি সংকট হয়ে পড়েছে জীবনের সংকট। বিশ্বে ভূ-গর্ভস্থ পানির উৎসের মধ্যে কৃষিতে ব্যবহার হচ্ছে ৬৯ ভাগ, শিল্পে ৯ ভাগ আর অবশিষ্ট ২২ ভাগ পানি ব্যবহার হচ্ছে গৃহস্থালী কাজে। তবে চাহিদার যোগান দিতে প্রয়োজনীয় পানি প্রাকৃতিকভাবে মাটির নিচে যুক্ত হচ্ছে না।
বৃষ্টিপাতের কারণে ভূ-উপরিভাগের জলাশয় নদ-নদী ভরাট হলেও ভূ-গর্ভস্থ পানিকে নবায়নযোগ্য বলছেন না বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ৬৪ ভাগ করে থাকে এশিয়ার দেশগুলো। আগামী ৩০ বছর বিশ্বে পানির ব্যবহার প্রতি বছর এক ভাগ হারে বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দীর্ঘকাল ধরে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে মোট শ্রমশক্তির ৪০ ভাগ এখনো কৃষিতে যুক্ত। নদী-নালার দেশ হয়েও বাংলাদেশে কৃষি জমিতে সেচ কাজ ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্যমতে, ২০২০ সালে দেশে কৃষি সেচের জন্য ৭৩ ভাগ ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হয়েছে। যেখানে সেচের জন্য ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র ২৭ ভাগ। অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান শিল্পায়নের ফলে প্রনিতিয়ত বাড়ছে পানির ব্যবহার ও চাহিদা। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় ১৯টি জলায় বাড়ছে লবণাক্ততা। এতে তীব্র হচ্ছে খাবার পানি সংকট।
তাছাড়া বাছবিচারহীনভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তলনের ফলে উঁচু এলাকায় পানির স্তর নেমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনকহারে। বিঘ্নিত হচ্ছে কৃষি উৎপাদনও। সম্প্রতি আবাদের জন্য সময়মতো সেচের পানি না পেয়ে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় দুই সাঁওতাল কৃষকের বিষপানে আত্মহত্যার ঘটনা সেই ভয়াবহতার ইঙ্গিত। আসন্ন পানি সংকট নিয়ে এখনই ভাবার সময় হয়েছে বলে হুশিয়ারি দিচ্ছেন বিশেজ্ঞরাও।
এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ব পানি দিবসের এক আলোচনায় পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড কি গ্রাউন্ড ওয়াটার (ভূ-গর্ভস্থ পানি) নিয়ে ভাবে? মোটেই না। আমরা ক্রান্তিলগ্নে পৌঁছেছি বলে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সংকটে পড়তে হবে। কেউ পানি ব্যবস্থাপনা মনিটরিং করছে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে ড. আইনুন নিশাত বলেন, কদিনের মধ্যেই শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় গোলমাল বাঁধবে। এদিকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত লবণাক্ততা পৌঁছে গেছে বলে জানান এ জলবায়ু বিশেষজ্ঞ। আসন্ন পানি সংকটে আগে খাবার পানি নাকি কৃষির পানি তা সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে বলেও মনে করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ইমেরিটাস অধ্যাপক।
পানি উত্তোলনে এগিয়ে বাংলাদেশ
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, বাংলাদেশ বছরে ৩২ ঘন কিলোমিটার এলাকা থেকে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন প্রায় ২৭ লাখ ৫০ হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়, যার ৮০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে উত্তোলন করা হয়। মাটির ওপরের উৎস থেকে বাকি চাহিদা মেটানো হয়। এদিকে ‘মেকিং দ্য ইনভিসিবল ভিসিবল’ শিরোনামে জাতিসংঘের বৈশ্বিক পানি উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০২২ এর তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনকারী দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ।
ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের দিক দিয়ে শীর্ষে ১০টি দেশের তালিকায় এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৭টি দেশ স্থান পেয়েছে। দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ম। বাংলাদেশের চেয়ে বেশি পানি উত্তোলনকারী বাকি ৬ দেশ হলো চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, পাকিস্তান ও তুরস্ক। এই ৭টি দেশ সম্মিলিতভাবে বিশ্বের ৬০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে থাকে।
ভূ-গর্ভস্থ পানি: অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করা
‘দ্য ওয়ার্ল্ডস ওয়াটার’ বইয়ের লেখক পিটার গ্লাইক এএফপিকে বলেন, ‘মানুষ যেভাবে সময়ের আগেই এসব পানি ব্যবহার করে ফেলছে, তাতে এই পানি এখন অনবায়নযোগ্য হয়ে গেছে৷’ বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হারে কমে যাচ্ছে ভূগর্ভের পানির স্তর। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপি সচেতনতা তৈরিতে পালিত হয়েছে বিশ্ব পানি দিবস। দিবসটির এবারে থিম ছিল-ভূ-গর্ভস্থ পানি: অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করা। এ বছরের এ থিমের প্রধান উদ্দেশ্য হলো ভূ-গর্ভস্থ পানি সম্পদে দৃষ্টি আকর্ষণ করানো। এটা সব সময়ই একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হলেও টেকসই উন্নয়ন চিন্তাধারায় কখনো এটাকে স্বীকৃতি দেয়া হয় না। এবারের প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে সেনিটেশন ও পানি ব্যবস্থাপনা এবং কৃষি-শিল্প, বাস্তুতন্ত্র ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ভূ-গর্ভস্থ পানির ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হবে। এই ক্যাম্পেইন থেকে বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে, অন্বেষণ, সংরক্ষণ এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির টেকসই ব্যবহারই ভবিষ্যতে জীবনধারণের লক্ষ্য।
দেশে আয়োজিত পানি দিবসের আলোচনায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূ-গর্ভস্থ পানি বিভাগের পরিচালক ড. আনোয়ার জাহিদ বলেছেন, বাংলাদেশে জীবন ও জীবিকার জন্য মানুষ ব্যাপকভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। তবে এটার গবেষণাভিত্তিক ও প্রাজ্ঞ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা দরকার। উন্নত দেশ হতে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। যার ৬ নম্বর লক্ষ্যে বিশুদ্ধ পানি ও সেনিটেশনের কথা বলা হয়েছে। যার অংশ হিসেবে ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী খাবার পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
সংকটের নানাদিক
এবারের পানি দিসবের আলোচনায় পানি সংকটের নানা দিকের মধ্যে উঠে এসেছে, নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে প্রভাবশালী মহল অনুমোদন ছাড়াই ইচ্ছেমতো গভীর নলকূপ বসাচ্ছেন। বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে নেন ঢাকা ওয়াসার এমডিও। আলোচনায় অংশ নিয়ে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং-এর নির্বাহী পরিচালক আবু সালেহ খাঁন বলেন, পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান একই কাজ করছে। তাই ডুপ্লিকেশন হচ্ছে। তাছাড়া নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল থাকায় ক্ষমতাবানরা ডিপ মেশিন স্থাপন করে ফেলছে।
আসন্ন সংকট নিয়ে একাত্তর টিভির প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু বলেন, পানি সংকট লেগে গেলে কোনো অর্থনীতিই পরিচালনা করা যাবে না। আমরা একদম শেষ স্তরে চলে এসেছি। এরপরই রেড এলার্ট। সংকট সমাধানে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দরকার। আলোচনায় ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, সারফেস ওয়াটার ব্যবহার বিরাট চ্যালেঞ্জ। সে ক্ষেত্রে নিচ থেকে পানি তোলা সহজ, খরচও কম। নদীর পানি প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে ওয়াসা এমডি বলেন, শীতলক্ষ্যার পানি খুবই অযোগ্য। তাই পদ্মা-মেঘনা থেকে পানি আনতে হচ্ছে। এতে ব্যয়ও বাড়ছে। ঢাকা ওয়াসার পরিকল্পনায় ৭০ শতাংশ সারফেস ওয়াটার ব্যবহারের চিন্তা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি বলেও জানান তিনি। তবে চিটাগাং ওয়াসা ৯০ শতাংশ সারফেস ওয়াটার ব্যবহার করে বলে জানান ওয়াসা এমডি।
আনন্দবাজার/শহক