ঢাকা | শুক্রবার
১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিল্পনগরীতে শিল্পে ভাটা

শিল্পায়নের জনকের খুলনা এখন শিল্পে মৃত

👉শিল্পের উত্থান-পতন

  • ষাটের দশকে খুলনায় শিল্পবিপ্লব
  • বর্তমানে শিল্পের মৃত নগরী
  • শিল্প থেকে মৎসখাতে বদল
  • পদ্মাসেতু ঘিরে নতুন স্বপ্ন

👉বাংলায় আধুনিক ধারার শিল্পায়নের জনক আচার্য পি সি রায়ের জন্ম খুলনার পাইগাছায়। তার হাত ধরেই সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার খুলনা শিল্পের সূচনা

👉বেকার তরুণরা আগে ছুটতেন খুলনায়, এখন খুলনা থেকে শিক্ষিতরা ছুটছেন ঢাকায়

উপমহাদেশে শিল্প-রসায়ন ও আধুনিক ধারার শিল্পায়নের জনক আচার্য পি সি রায়ের জন্ম খুলনার পাইগাছায়। উপনিবেশিক শাসন-শোষণ থেকে বাংলার মানুষকে বাঁচাতে বিশ শতকের গোড়ার দিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে এই শিল্পবিজ্ঞানী প্রথম শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। তার হাত ধরেই বাংলায় গড়ে ওঠে নানামুখী শিল্প ও বাণিজ্যপ্রতিষ্ঠান।

পি সি রায় ১৮৯৩ সালে নিজের ল্যাবরেটরিতে ব্রিটিশ কোম্পানি ফার্মাকোপিয়ার এক ওষুধ তৈরি করাকালে উদ্বুদ্ধ হয়ে মাত্র ৮০০ টাকা পুঁজি নিয়ে ভারতবর্ষে প্রথম রসায়নশিল্প বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠা করেন। যা বিংশ শতকের শুরুতে (১৯০১) কলকাতার মানিকতলায় ৪৫ একর জমিতে স্থানান্তরিত হয়। গত ১২০ বছর ধরে জনপ্রিয়তার সঙ্গে টিকে আছে প্রতিষ্ঠানটি।

সে সময় পি সি রায় মানুষের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য নিজ জেলা শহর খুলনায় এপিসি কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি ও টেক্সটাইল মিলস প্রতিষ্ঠা করেন। যে টেক্সটাইল মিল পরবর্তীতে খুলনা টেক্সটাইল মিলস নামে পরিচিতি পায়। অনেকের মতে, পি সি রায়ের হাত ধরেই উপমহাদেশ তথা খুলনায় প্রথম আধুনিক শিল্পায়নের সূত্রপাত ঘটে।

শিল্পায়নের সেই ধারায় ষাটের দশকে বাংলার অন্যতম প্রধান শিল্প কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে খুলনা। তখন এ অঞ্চলে শিল্প বলতে খুলনার কলকারখানাকেই বোঝাতো। যে কারণে খুলনার নামকরণও হয় শিল্পনগরী হিসেবে। সুন্দরবনের প্রবেশদ্বারখ্যাত খুলনা শহরের খালিশপুর, দৌলতপুর ও সংলগ্ন নোয়াপাড়ায় তখন একের পর এক শিল্প স্থাপন করা হয়। এশিয়ার সর্ববৃহৎ নিউজপ্রিন্ট কারখানাও স্থাপিত হয় খালিশপুরে।

স্বাধীনতার আগে দেশের বৃহৎ পাটকলের বেশিরভাগই গড়ে ওঠে খুলনা অঞ্চলে। সারা দেশের লোকজন কর্মসংস্থানের জন্য ছুটে যেতেন খুলনায়। তরুণ বেকারদের বিশ্বাস ছিল, খুলনায় গেলে কোনো না কোনো কাজ খুঁজে পাওয়া যাবেই। বাস্তবেও কর্মসংস্থানের বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল খুলনা। তবে স্বাধীনতার পর দেশের প্রতিটি অঞ্চল এগিয়ে গেলেও খুলনার ক্ষেত্রে ঘটে বিপরীত। অনেকটা পেছনের দিকেই হেঁটেছে দক্ষিণের সাগরঘেঁষা শিল্পনগরী। স্বাধীনতার আগে যে নগরী ছিল শ্রমিকের পদভার আর কর্মময় জীবনের ছন্দে মুখরিত সেই নগরী হয়ে পড়ে মৃত।

এক সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত শিল্পনগরী খুলনায় বর্তমানে বেশিরভাগ কলকারখানা বন্ধ। গ্যাস সংযোগ না থাকায় বড় বা ভারী শিল্প গড়ে ওঠেনি বললেই চলে। তার ওপর একের পর এক শিল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ খুলনামুখী হওয়ার পরিবর্তে রাজধানীমুখী হচ্ছেন। এতে প্রচণ্ড চাপ বাড়ছে রাজধানীর ওপর।

খুলনার ঐতিহ্য
পঞ্চাশ থেকে সত্তর দশকে বড় ধরনের শিল্প কারখানা গড়ে উঠে খুলনায়। যার মধ্যে অন্যতম স্টিলমিল, বৈদ্যুতিক তার কারখানা, চাল ও ময়দার কারখানা, বরফকল, প্রেস, কাঠের কারখানা। পরে ওষুধ তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। ১৯৬৩ সালে প্রথম হিমাগার বা মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপিত হয়। এখানকার শিল্প এলাকা বলতে শিরোমনি, খালিশপুর, বয়রা ও রূপসা-ই প্রধান। দৌলতপুর, ফুলতলা, আলাইপুর, কপিলমুনি ও ডুমুরিয়া বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবেই বিবেচিত।

মোঘল আমলে খুলনায় লবণশিল্প গড়ে ওঠে। সুন্দরবন এলাকা থেকে লবণাক্ত মাটি সংগ্রহ করে পাতন প্রক্রিয়ায় লবণের দ্রবণ সংগ্রহ করে জ্বাল দিয়ে তৈরি হতো লবণ। দাকোপ ও কয়রায় পরীক্ষামূলক লবণ উৎপাদন ও প্রদর্শনী কেন্দ্র চালু করা হয়। যেখানে সৌর পদ্ধতিতে চাতালে লবণ উৎপাদনের ওপর হাতে-কলমে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চলে লবণ উৎপাদনে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়।

বর্তমান হাল
শিল্পনগরীর খেতাপ খুইয়ে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি শিল্পের প্রসার ঘটায় খুলনা পরিচিত পায় রুপালি শহর হিসেবে। শিল্প আর কৃষিখাতে আগ্রহ হারিয়ে ঝুঁকতে থাকেন মৎসখাতে। খুলনার গ্রামাঞ্চলে এখনো নোনা পানি, মিষ্টি পানির বিভিন্ন জাতের চিংড়ি, সাদা মাছ চাষ হচ্ছে। অনেক ঘেরও গড়ে উঠেছে। বর্তমানে মাছ রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে খুলনা। তাছাড়া দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর খুলনা মহানগরীতে অবস্থিত মংলা সমুদ্র বন্দর। রয়েছে নোয়াপাড়া নদীবন্দর, সর্ববৃহৎ বেনাপোল স্থলবন্দর।

স্থানীয় সূত্রমতে, খুলনার নিজস্ব নদী বন্দরের বদৌলতে এবং নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুকে ঘিরে খুলনায় একাধিক বড় প্রকল্প হাতে নেওয়ায় খুলনাঞ্চলের অর্থনীতি শিল্পবাণিজ্য বেশ দ্রুত এগোচ্ছে। এক সময় খুলনায় পাটপাটজাত উৎপাদনে সেরা ছিল। সেই শিল্পের ঐতিহ্যের চিহ্ন বহন করে চলেছে বেশ কয়েকটি পাটকল। বর্তমানে খুলনার উল্লেখযোগ্য শিল্প বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা রপ্তানিযোগ্য চিংড়ি ও হিমায়িত খাদ্য ছাড়াও দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত তারশিল্প কারখানা বাংলাদেশ ক্যাবল শিল্প খুলনায় অবস্থিত। বর্তমানে সহজ উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা, বন্দর সুবিধা ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং পদ্মা সেতুকে ঘিরে বড় বড় প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন