জনপ্রিয় মসলা জাতীয় ফসল পেঁয়াজ উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় স্থান দখল করেছে বাংলাদেশ। অথচ কয়েক বছর ধরেই পেঁয়াজের ঝাঁঝে নাকানি-চুবানি খেতে হচ্ছে দেশবাসীকে। বছর তিনেক আগে (২০১৯) এক কেজি পেঁয়াজ কিনতে গুণতে হয়েছে ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে আগের বছরের তুলনায় সেবার পেঁয়াজের দাম বেড়ে গিয়েছিল ৪২৩ শতাংশ। যে কারণে জনপ্রিয় এই মশলা চলে যায় সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে পেঁয়াজের বিকল্প ব্যবহারের পাশাপাশি উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়। তবে উৎপাদন বাড়াতে গিয়েই আরো বেশি বিপাকে পড়ছেন পেঁয়াজ চাষিরা।
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জেলায় পেঁয়াজের দাম কমে যাওয়ায় চাষিদের মধ্যে হাহাকার দেখা গেছে। বিক্রি না করে ঘরে ফেরত নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। পেঁয়াজের রাজধানী খ্যাত ফরিদপুরের সালথা, কুষ্টিয়ার কুমারখালিসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বর্তমানে পেঁয়াজ চাষিদের মাথায় হাত পড়েছে। প্রতিকেজিতে ১৮-২০ টাকা উৎপাদন খরচের পেঁয়াজ বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে ৭-৮ টাকা দরে। প্রতিকেজিতে তাদের গচ্চা দিতে হচ্ছে ১০-১২ টাকা। চাষিদের শ্রম ও সময় ধরলে সেই লোকসান বেড়ে দাঁড়ায় ২০ টাকা অবধি।
কৃষিবিভাগের তথ্যমতে, মাথাপিছু দৈনিক ৩৫ গ্রাম করে ব্যবহার ধরে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে ২৪ লাখ মেট্রিক টন। দেশে উৎপাদিত ১৮ লাখ টনের বেশি পেঁয়াজের মধ্যে সংরক্ষণের অভাবে পচে নষ্ট হয় ৫ থেকে ৭ লাখ টন। এই ঘাটতি পোষাতে প্রতিবছর ভারত, মিয়ানমার, চীন, মিসর, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ১০ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। কৃষিবিদরা বলছেন, দেশে পেঁয়াজ সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা থাকলে বড় জোর ৪ লাখ টন আমদানি করতে হতো। শুধু সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকার কারণে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে প্রতিবছর বড় ধরনের লোকসান গুনতে হচ্ছে চাষিদের।
কৃষি গবেষকরা বলছেন, পেঁয়াজ উৎপাদনে কেজিতে খরচ হয় ২০ টাকার বেশি। এর সঙ্গে কৃষকের মজুরি ধরলে ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। সেজন্য পেঁয়াজের কেজিপ্রতি দাম ৪০ টাকার মধ্যে বেঁধে দেয়া প্রয়োজন। তবে চাষিরা যদি প্রতি কেজি ৩৫-৪০ টাকা দরে বিক্রি করতে পারেন তাহলে লাভের কিছু অংশ তাদের থাকতো।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) অধীন মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র ফরিদপুরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মুশফিকুর রহমান দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, পেঁয়াজ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় হয়েও বছরে ১০ লাখ টনের মতো আমদানি করতে হয়। শুধু সংরক্ষণের অভাবের কারণেই এই আমদানি নির্ভরতাসহ লোকসান বেড়েছে। দেশে পেঁয়াজ সংরক্ষণে রয়েছে মাত্র একটি হিমাগার।
বারির অধীন বগুড়ার শিবগঞ্জে মসলা গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মাজহারুল আনোয়ার দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, দেশে আলু সংরক্ষণের মতো পেঁয়াজের জন্য কোনো সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। স্থানীয়ভাবে স্বল্প পরিমাণে যে ব্যবস্থা রয়েছে তাতে ৬ মাস সংরক্ষণ করা যায়। সংরক্ষণাগার আরো বাড়াতে হবে।
পেঁয়াজের আমদানি নির্ভরতা কমাতে রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে বলে জানান ড. মো. মাজহারুল আনোয়ার। তিনি বলেন, সেই রোডম্যাপে প্রাধান্য পাবে বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ। সরকারি পর্যায়ে এখন অবধি দেড় হাজার থেকে এক হাজার ৮শ কেজি বীজ উৎপাদন করা হয়। তবে আমাদের লক্ষ্য কৃষকরাই বীজ উৎপাদন ও আবাদ করবেন। বছরে পেঁয়াজের প্রায় ৫-৬ লাখ টন ঘাটতি পূরণে বারি-৪ গ্রীষ্মকালে চাষে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
ফরিদপুরের সালথার পেঁয়াজ চাষি আলম ভূইয়া দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, কৃষি অফিসের পরামর্শে আমরা উন্নত জাতের পেঁয়াজের বীজ বপন করেছি। অনেক জমিতে আবাদ করায় শ্রমিকও বেশি লেগেছে। অথচ এখন বাজারে দাম পাচ্ছি না। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে পেঁয়াজ চাষ কমে যাবে। বাইরে থেকে পেঁয়াজ কিনে খেতে হবে। তবে সরকার যদি বছরেই দুই মৌসুমে মাস ছয়েক পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রাখতো তাহলে চাষিরা প্রকৃত দাম পেতো।
রাজশাহীর পদ্মাচরের এক চাষি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাজারে তো পানির দামে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। যেখানে এক কেজি পেঁয়াজ হওয়ার কথা ৫৫ টাকা, সেখানে ৫ কেজি বেচে সেই টাকা পাওয়া যাচ্ছে। অথচ কেজিপ্রতি উৎপাদন খরচই হয়েছে ২০-২৫ টাকার মতো। এর মধ্যে আবার অকাল বন্যায় চরের পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে চাষিদের।
পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে আমদানির কারণে দাম পড়ে গেছে বলে মনে করছেন চাষিরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ বেড়েছে। তার ওপর দেশের বাইরের পেঁয়াজও বাজারে এসেছে। এ কারণে হঠাৎ করেই পেঁয়াজের বাজার পড়ে গেছে। তবে উৎপাদনের ভরা মৌসুমেও পেঁয়াজের আমদানির অনুমতি কেন দেয়া হয়েছে সে ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে পারেন কেবল বাণিজ্যমন্ত্রী। বিষয়টি জানতে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষকে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ করা হলেও পাওয়া যায়নি।
আনন্দবাজার/শহক