শিল্প বিপ্লবের পরে বিশ্বব্যাপী উল্কার গতি পায় নগরায়ন। রাজনীতির হাত ধরে উন্নয়ন ধারণায় অপরিহার্য হয়ে ওঠে অবকাঠামো। এর মধ্যে নতুন নতুন শিল্পপণ্যের উদ্ভাবনে বিশ্বজুড়ে শুরু হয় তুমুল অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এতে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হতে থাকে পরিবেশ-প্রতিবেশ। ধ্বংস হতে থাকে প্রাকৃতিক সম্পদ, বাস্তুসংস্থান, জীববৈচিত্র। এভাবে দশকের পর দশক চলার পর বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ঙ্কর ছোবলে ক্ষতবিক্ষত বিশ্ব। পৃথিবীব্যাপী শুরু হয়েছে পরিবেশ দূষণের মহাবিপর্যয়। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশে দেশে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও প্রকল্পে পরিবেশ ভাবনাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন এসেছে।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লব শুরু হয়েছে। সভ্যতার অগ্রগতিতে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টিতে দৃষ্টি দেয়া হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নে নতুন মাত্রা যোগ করেছে সবুজবিপ্লব। আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে পরিবেশের পুরোনো প্রাকৃতিক রূপ ফিরিয়ে দিতে উন্নয়ন ভাবনা তথা প্রকল্পের পরিবেকল্পনা ও বাস্তবায়নে পরিবেশ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি দূষণকারী দেশগুলোই এখন উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবেশকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এর মধ্যে চীন হতে যাচ্ছে আগামীর পরিবেশবান্ধব শিল্পের নতুন মডেল। তবে এশিয়ায় উন্নয়নের ‘নতুন বাঘ’ খ্যাত বাংলাদেশে উন্নয়ন পরিকল্পনায় এখনও তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না পরিবেশ ভাবনা। বহুমুখী দূষণে বিশ্বসেরা হলেও পরিবেশ আইন বাস্তবায়নে তেমন উদ্বেগ নেই। অথচ পরিবেশ দূষণে দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর দায় সবচেয়ে বেশি বলে গবেষণার মাধ্যমে জানাচ্ছে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। সংস্থাটি বলছে, বাতাসকে বিষিয়ে তোলার জন্য সবচেয়ে বেশি (৩০ শতাংশ) দায় অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণ কাজ তথা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর। যেখানে ২৯ শতাংশ দূষণের উৎস ইটভাটা ও শিল্পকারখানা।
পরিবেশবিদরা বলছেন, উন্নয়ন পরিকল্পনাসহ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানভিত্তিক মূল্যবোধের প্রয়োগের চেয়ে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবই বেশি। যে কারণে সুদীর্ঘকালের টেকসই অর্থনীতি নিয়ে দেখা দিচ্ছে চরম অনিশ্চিয়তা। তাছাড়া দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশের সুরক্ষা না দিয়েই বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যাতে পরিবেশের ঝুঁকি দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এতে আগামী প্রজন্মের জন্য অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়লেও পরিবেশগত বিপর্যয়ের আশঙ্কা বেশি। জল, স্থল, বায়ু দূষণের পর আকাশ দূষণের দিকেও ধাবিত হচ্ছি আমরা। এই ভয়াবহতা থেকে এখনই ফিরে আসা দরকার।
শিক্ষা ও গবেষণাভিত্তিক সংগঠন ‘মুভমেন্ট ফর ওয়ার্ল্ড এডুকেশন রাইটসের উদ্যোগে গত ৯ এপ্রিল ‘পরিবেশ-প্রতিবেশ দূষণে হুমকিতে জনজীবন’ শীর্ষক ওয়েবিনারে যুক্ত হওয়া বিশেষজ্ঞরাও পরিবেশ বিষয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির কথা বলেছেন। যেখানে মিডিয়া পার্টনার হিসেবে ভূমিকা পালন করে দেশের উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক নতুন ভাবনার পত্রিকা দৈনিক আনন্দবাজার।
ওয়েবিনারের আয়োজক সংগঠনের আহ্বায়ক সাংবাদিক ফারুক আহমাদ আরিফ বলেন, শব্দ, পানি, বাতাস, মাটি, নদী, সাগর এমনকি আকাশ দূষণেও আমরা পিছিয়ে নেই। গত কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে জাতীয়-আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র ও গণমাধ্যমে বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ বিষয়ে নাজুক পরিস্থিতি তুলে ধরা হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে করণীয় বিষয়গুলো বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকেই জানতে হবে। যেকোনো প্রকল্প প্রণয়ন কিংবা বাস্তবায়নে তাদের অংশগ্রহণ জরুরি।
দৈনিক আনন্দবাজারের বার্তা সম্পাদক ও পরিবেশচিন্তক নিয়ন মতিয়ুল বলেন, আমার বিশ্বাস রাজনীতিবিদরা বিজ্ঞান পড়েন না, এক্ষেত্রে তাদের প্রচুর ঘাটতি রয়েছে। কারণ পরিবেশবিষয়ক বিদ্যমান আইনগুলো খুব কমই বিজ্ঞানসম্মত। যেহেতু রাজনীতিবিদরা আইন প্রণয়ন ও পাস করে থাকেন সেজন্য তারা বিজ্ঞান পড়লে কিংবা চর্চা করলে দেশের অনেক কিছুই বদলে যেতে পারতো।
ওয়েবিনারে উন্নয়ন প্রকল্প ও পরিবেশের বিপদ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ এইচ এম সাদাত বলেন, পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থানের সঙ্গে আমাদের টিকে থাকার যে সূত্র আর পৃথিবীতে প্রাণধারণের মূল কারণ হচ্ছে এখানে সবকিছুর সমন্বয় রয়েছে। যা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোনো গ্রহে নেই। পরিবেশে যেখানে যা থাকা দরকার সেখানে তা থাকতে দিতে হবে।
উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবেশ ভাবনা বিষয়ে ড. সাদাত বলেন, এখানে যে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ হচ্ছে তাতে ভালো ফল আসছে না। এ জন্য সবার আগে সমন্বয় প্রয়োজন। বিশেষ করে বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী- সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। পৃথিবীর সীমিত সম্পদের সমন্বয়েই চাহিদা পূরণ করতে হবে। দেশের সংবিধানের উল্লেখ করে ড. সাদাত বলেন, সংবিধানের ২৫নং অনুচ্ছেদে মানবাধিকার নিয়ে অনেক কথা হয় অথচ পরিবেশ অধিকার ও পরিবেশের ন্যায়বিচার নিয়ে কথা বলি না, বলা হয় না।
রাজধানী ঢাকার পরিবেশ বিষয় জাবির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান আরো বলেন, ঢাকা শহরের শুধু খাদ্যসামগ্রী নয়, বাতাসও বাইরে থেকে আসে। গ্রামের মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে রয়েছে, তারা বেঁচে থাকতে পারবেন। ঢাকায় বসবাসরতদের সেটা নেই। তিনি আরো বলেন, পরিবেশ দূষণ বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়, এটি সামগ্রিক জীবনেরই অংশ। এখানে সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত। আমরা নানা আইন ও নীতি বানাচ্ছি বা কথা বলছি, এটি কখনও বাস্তবায়িত হবে না, যতক্ষণ না সমাজব্যবস্থা সেটি গ্রহণ, উপলব্ধি ও মেনে না চলে।
ড. এ এইচ এম সাদাত মনে করেন দেশের বিদ্যমান আইন ও নীতিমালাগুলোতে প্রচুর ঘাটতি রয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, শিল্প-কারখানার বর্জ্যে নদী ও পরিবেশ ধ্বংসের কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষতির মুখে পড়ছে। শুধু লাভবান হচ্ছেন শিল্পমালিকরা। এখানে স্থানীয়দের কোনো অংশগ্রহণ নেই, তারপরও তারা ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।
দেশে শুধু বায়ু দূষণের কারণেই যে বছরে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ প্রাণ হারান- সেই তথ্য তুলে ধরে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ইএনটি অ্যান্ড হেড-নেক সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মনি লাল আইচ লিটু বলেন, আমাদের আইন ও নীতিগুলো বেশিরভাগই অন্যদেশ থেকে কপি করা। এগুলোতে খানিকটা বিজ্ঞানের ছোঁয়া আছে, তবে বেশিরভাগই ব্যবসা ও রাজনীতিকে কেন্দ্র করে তৈরি করা।
অ্যাসোসিয়েশন অব সার্জনস ফর স্লিপ অ্যাপনিয়া বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ডা. মনি লাল আইচ আরো বলেন, যারা এসব আইন তৈরি করেন তাদের মধ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তার প্রচণ্ড অভাব। বলতে গেলে অনুপস্থিত। আইনপ্রণেতা ও বাস্তবায়ন সংস্থা মনে-প্রাণে তা ধারণ ও লালন করেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. গুলশান আরা লতিফা বলেন, পৃথিবী শুধু মানুষের একার নয়। মানুষ, প্রকৃতি, বাস্তুতন্ত্র সবার। তাই পরিবেশের ভাবনাটা সবাইকে নিয়েই ভাবতে হবে। এককভাবে কোনো উদ্যোগ বা পরিকল্পনা করা যাবে না।
উন্নত দেশের প্রকল্প বাস্তবায়নের রীতির বিষয় উল্লেখ করে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ও ক্যাপস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, প্রকল্প শুরুর আগে তারা অধ্যাপক, গবেষকদের কাছে জানতে চায়, এই জাতীয় প্রকল্প নিতে চাচ্ছি- আপনারা দেখুন সেটির সম্প্রসারণ ও প্রতিবন্ধকতা কী কী? অথচ আমাদের দেশে উল্টো ঘটনা ঘটে। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করার পর যখন ক্ষতির মুখে পড়ে তখন তারা এসে এ সম্পর্কে জানতে চায় সাইকোলজিস্টদের কাছে। সেখানে বিজ্ঞানী বা শিক্ষকদের কাছে তারা আসেন না। অর্থাৎ পুরো বিষয়টিই উল্টো। এটি উন্নয়নশীল দেশের চিত্র।
ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, আমাদের ক্লিন এয়ার অ্যাক্ট হওয়ার কথা ছিল। সেটি না করে বিধিমালা হচ্ছে। তবে সেটা কোন বিজ্ঞানীর পরামর্শে হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, আমাদের কথা না মানলেও মহামান্য হাইকোর্টের কথা তো মানতে হবে। নির্মাণনীতিমালা পুরোপুরি মানতে হবে। বিশেষ করে প্রকল্প এলাকা ঘিরে রাখতে হবে। কোনোভাবে ময়লা-আবর্জনা স্তূপিকৃত না থাকে সেটি খেয়াল রাখতে হবে। বাতাস দূষিত করে এমন কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলোকে বন্ধ করে দিতে হবে। শীতকালের বায়ু দূষণ নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা নিতে হবে। আইনগুলোতে বিজ্ঞানের অনুপস্থিতি দেখা যায়, এখান থেকে বেরুতে হবে।
আনন্দবাজার/শহক