করোনার বিরূপ প্রভাবের সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা সক্রিয় থাকায় স্থলবাণিজ্য অনেকটা কমে আসে গত দুই বছর ধরে। এতে স্থবির হয়ে পড়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরের কার্যক্রম। আগে শ্রমিক আর পণ্যবাহী ট্রাকে মুখর থাকলেও এখন অনেকটাই নীরব-শান্ত।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতে রেল যোগাযোগ ও রাস্তাঘাট উন্নত হওয়ায় অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে এসেছে। ফলে প্রতিবেশী দেশে পণ্য রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যেসব পণ্যের নতুন করে আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে সেগুলোর চাহিদাও কমে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে নিষিদ্ধ পণ্য ব্যতীত সব পণ্য আমদানির সুযোগ চেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এতে সরকারের রাজস্ব আদায় তিনগুণ বাড়বে বলে মনে করছেন তারা। তা না হলে আমদানি রপ্তানির মতো পণ্যের অভাবে এক সময় বন্ধই হয়ে যেতে পারে আখাউড়ার স্থলবাণিজ্য।
সূত্রমতে, সাত বোন বা সেভেন সিস্টারখ্যাত ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের প্রবেশদ্বার ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা দিয়ে আন্তঃবাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য বিগত ১৯৯৪ সালে আমদানি-রপ্তানি ও যাত্রী পারাপারের জন্য চালু হয় আখাউড়া স্থলবন্দর। এরপর ২০১০ সালে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরে রূপান্তর করা হয়। চালুর পর থেকেই প্রতিদিন গড়ে ৩২টি পণ্য ভারতের সাতটি রাজ্যে রপ্তানি হয়ে আসছে। প্রতিদিন শত শত ট্রাকে করে ভারতে যেত মাছ, ভোজ্যতেল, সিমেন্ট, প্লাস্টিক পণ্য, রড, বালু, পাথর, শুঁটকী, গ্লাস, সুতলী, জুস, বিস্কুটসহ নানা পণ্য।
বিপরীত দিকে, ভারত থেকে আমদানির অনুমতি ছিল শুঁটকী, আদা, মরিচ, পেঁয়াজ, গবাদিপশু, মাছের পোনা, তাজা ফলমূল, গাফগাফড়া, বীজ, চাল, গম, পাথর, কয়লা, রাসায়নিক সার, চায়না ক্লে, কাঠ, টিম্বার, চুনাপাথর রসুন, বলক্লে, কোর্য়াটজ, সাতকড়া, আগরবাতি, জিরা, রাবার, মেইজ, সয়াবিন বীজ, বেম্বু প্রডাক্ট, অরজুন ফ্লাওয়ার, পান, সিএনজি পার্টস, কাজু বাদাম, কাগজ, চিনি, জেনারেটর, ভাঙা কাঁচ, চকোলেট, বেবি ওয়াইপার, কনফেকশনারি দ্রব্যাদিসহ নানাবিধ পণ্য।
তবে ভারতে রেল যোগাযোগ উন্নত হওয়ায় এখন অনেক পণ্যই আর রপ্তানির তালিকায় থাকছে না। গেল কয়েক বছরে পণ্য রপ্তানি কমেছে বহুগুণ। আগে প্রতিদিন অন্তত দেড়শ থেকে দুইশ ট্রাকে করে পণ্য রপ্তানি হতো ভারতে। বর্তমানে তা কমে মাত্র ২৫ থেকে ৩০টি ট্রাকে নেমেছে। রপ্তানি কমে যাওয়ায় স্থলবন্দরের শতশত ব্যবসায়ী ও কয়েক হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য বন্দরের ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে ভারত থেকে ৩০টি পণ্য আমদানি করার অনুমতি চেয়েছিল। সরকার ইতোমধ্যে ফুলের ঝাড়ু, রাবার, পান, বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র, গরুসহ ৫টি পণ্য আমদানির অনুমতি দিয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, যেসব পণ্য নতুন করে আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে এখানে সেগুলোর চাহিদা নাই বললেই চলে। সেজন্য তামাবিল স্থলবন্দরের অনুসরণে শুধু নিষিদ্ধ ব্যতিত সব ধরনের পণ্য আমদানির অনুমতি চান তারা।
সরেজমিনে আখাউড়া স্থলবন্দরে গিয়ে জানা যায়, করোনা মহামারির কারণে গত তিন বছর ধরে যাত্রী পারাপারে নিষেধাজ্ঞা ধাকায় আগে যেখানে প্রতিদিন গড়ে এক থেকে দেড় হাজার মানুষ বন্দর দিয়ে আসা যাওয়া করতেন, এখন সেখানে মাত্র তিন থেকে সাড়ে তিনশ যাত্রী পারপার হচ্ছেন। এতে কমে গেছে শুল্ক। অন্যদিকে আবার করোনার কারণে কিছুদিন বন্ধ থাকার পর রপ্তানি চালু হওয়ায় ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা আবারো আশাবাদী হয়ে উঠেছেন।
আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশন ও আখাউড়া স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে পাওয়া পাঁচ বছরের আমদানি করা তথ্যে জানা যায়, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৭৭ লাখ ৬৪ হাজার ৩৭৫ টাকা মূল্যের ২ টন শুঁটকী। এর মধ্যে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩৯ লাখ ৬৭ হাজার ৭৫৬ টাকা ও বন্দর মাশুল আদায় হয়েছে ৬ লাখ ৩৬ হাজার ৪৩৮ টাকা। যাত্রী পারাপার হয়েছেন মোট এক লাখ এক হাজার ৬৩৮ জন। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে এক কোটি ৭৬ লাখ ২৬ হাজার ৪০৭ টাকা মূল্যের ১০৩ টন বিভিন্ন পণ্য। এর মধ্যে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬০ লাখ ৯৮ হাজার ৭৪৩ টাকা ও বন্দর মাসুল আদায় হয়েছে ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৩৫৩ টাকা। যাত্রী পারাপার হয়েছেন মোট এক লাখ সত্তর হাজার ৬২৩ জন।
২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৮৬ লাখ ২৮ হাজার ৯৩৪ টাকা মূল্যের ৯৭.৩০ টন বিভিন্ন পণ্য। এর মধ্যে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২৮ লাখ ৮৭ হাজার ৬৮২ টাকা ও বন্দর মাসুল আদায় হয়েছে ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৩১২ টাকা। যাত্রী পারাপার হয়েছেন মোট ২ লাখ ১৮ হাজার ৩০৭ জন। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এক কোটি ১৭ লাখ চার হাজার ৬৩৯ টাকা মূল্যের ৬৬ দশমিক ৪১৪ টন শুঁটকী। এর মধ্যে সরকারি রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪০ লাখ ৪৯ হাজার ৮০৫ টাকা ও বন্দর মাসুল আদায় হয়েছে ২৯ লাখ ৭১ হাজার ৫৪১টাকা। যাত্রী পারাপার হয়েছেন মোট ২ লাখ ২২ হাজার ৮৫০ জন।
২০২০-২০২১ অর্থবছরে এক কোটি নয় লাখ বিরানব্বই হাজার ২১৮ টাকা মূল্যের ৭৮ দশমিক ১২ মেট্রিকটন আদা ও শুঁটকী। এর মধ্যে সরকারি রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩২ লাখ, ৬৮ হাজার, ১৯৮ টাকা ও বন্দর মাশুল আদায় হয়েছে ৩৬ লাখ ৫৭ হাজার ৭২২ টাকা। যাত্রী পারাপার হয়েছেন মোট ১০ হাজার ৭০৪ জন। ২০২১-২০২২ এর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ২২২ কোটি ৩২ লাখ, ১৫ হাজার ২০৪ টাকা মূল্যের ৭৪ হাজার ৮৯১ টন আদা, পেঁয়াজ, গম ও শুঁটকী মাছ। এর মধ্যে সরকারি রাজস্ব আদায় হয়েছে ৭ কোটি ৫৭ লাখ ২০ হাজার ২৭৭ টাকা ও বন্দর মাশুল আদায় হয়েছে ৭৫ লাখ ৯ হাজার ৯০ টাকা। এছাড়াও ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে রপ্তানি করা হয়েছে ৫৪২ কোটি ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৯৩০ টাকা, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে রপ্তানি করা হয়েছে ৬৯৭ কোটি ৭০ লাখ ১ হাজার ৭৫৮ টাকা ও চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রপ্তানি করা হয়েছে ৫৩৬ কোটি ৪৬ লাখ ৭ হাজার ৯৪৪ টাকা।
আখাউড়া স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীরা বলছেন নিষিদ্ধ পণ্য ছাড়া সব পণ্য আমদানির অনুমতি দিলে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়ার পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও লাভবান হবেন। আখাউড়া স্থলবন্দরের ট্রাক শ্রমিক সুমন মিয়া জানান, আগে প্রতিদিন গড়ে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ট্রাকের দীর্ঘ সারি দেখা যেত। আমরা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করেছি। এখন সারাদিনে ৫০ থেকে ৬০টি ট্রাক ভারতে যেতে পারে না। আরেক শ্রমিক মো. হাসেন মিয়া জানান, প্রায় ১০ বছর যাবত এই বন্দরে আমরা শ্রমিকের কাজ করছি এত কম ট্রাক যেতে কখনো দেখিনি। তবে কিছুদিন যাবত গম আমদানি করার কারনে আবারো কিছুটা কাজ পাচ্ছি আমরা।
আখাউড়া বন্দরের ব্যবসায়ী মনির হোসেন বাবুল জানান, পূর্ণ রপ্তানিমুখি এই বন্দরের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। ভারতের সেভেন সিস্টারখ্যাত এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় তারা এখন আর আমাদের কাছ থেকে পণ্য কিনছেন না। যার কারণে অনেক ব্যবসায়ী পথে বসে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। সরকার যদি আমাদের তামাবিলের মতো করে নিষিদ্ধ পণ্য ছাড়া সব পণ্য আমদানি করার অনুমতি দিত তাহলে আমাদের অনেক উপকার হতো। পাশাপাশি শ্রমিকেরাও কাজ করে খেতে পারতেন।
আখাউড়া আমদানি-রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম বলেন, আখাউড়া স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে কিছুদিন আগে ৫টি পণ্য আমদানি করার অনুমতি দেয় রাজস্ব বিভাগ। এই পণ্যগুলো আমাদের এই এলাকায় তেমন একটা চলে না। যার কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তামাবিলে যেমনটা করা হয়েছে তেমনি নিষিদ্ধ পণ্য ছাড়া সব পণ্য আমদানি করার অনুমতি দিলে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সরকারও বিপুল পরিমাণে রাজস্ব পেত।
আখাউড়া স্থলবন্দরের ডেপুটি কমিশনার আবু হানিফ মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ জানান, কিছুদিন আগে গমের একটি চালান এসেছে তবে ট্যাক্স নাই। রপ্তানি বাড়তে পারে শুধুমাত্র দুদেশের ব্যবসায়ীদের কথাবার্তার মাধ্যমে। কোন দেশে কোন পণ্যের চাহিদা রয়েছে সে বিষয়ে কথা বলে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি হতে পারে। অনুমোদন আছে এমন পণ্যের রপ্তানিতে কোনা ট্যাক্স নেই।
আনন্দবাজার/শহক