চট্টগ্রাম কাস্টমসের দুর্বল নজরদারির কারণে বেড়ে চলেছে অর্থ পাচারের ঘটনা। একইসঙ্গে বেড়েছে ভুয়া রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচার। এসব ঘটনার মধ্যে কিছু কিছু ঘটনা ধরা পড়লেও বেশিরভাগই থেকে যাচ্ছে আড়ালে। ইট-বালু কিংবা মূল্যহীন বস্তু আমদানির মতো ঘটনা ঘটেছে অসংখ্যবার। এসব পণ্য আমদানির মাধ্যমে মূলত আমদানিকারকরা অর্থপাচার করতেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
তবে ধরা পড়া সেইসব চালানের আমদানিকারকরা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলতেন, তাদের সঙ্গে রপ্তানিকারকরা প্রতারণা করে এসব মূল্যহীন বস্তু কিংবা ইট-বালু পাঠিয়েছেন। পণ্য আমদানিতে অর্থপাচারের সেই হার কমলেও সম্প্রতি বেড়েছে পণ্য রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচারের ঘটনা। মুলত কাস্টমসের দুর্বল নজরদারির ফলেই পণ্য আমদানি ও ভুয়া রপ্তানির আড়ালে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।
আমদানি-রপ্তানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাস্টমসের দুর্বল নজরদারির কারণে পণ্য রপ্তানির চালানে অর্থপাচারের ঘটনা বাড়ছে। অনেক সময় পণ্য জাহাজীকরণের আগে সঠিক নিয়মে কায়িক পরীক্ষা করা হয় না। এ ছাড়া একশ্রেণির অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে অতিরিক্ত পণ্য রপ্তানি করার অভিযোগ রয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রমতে, গত ২২ মার্চ ঢাকার গুলশানের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইনফিনিটি সার্ভিস সলিউশনের বিরুদ্ধে নন-বন্ডেড বা স্থানীয়ভাবে তৈরি পোশাক রপ্তানির নামে ২২ লাখ টাকা পাচারের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নগরীর আগ্রাবাদ এলাকার সিএন্ডএফ এজেন্ট ডায়নামিক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এছাক ডিপোতে তৈরি পোশাকের চালান জাহাজীকরণের জন্য কন্টেইনারে লোড করে।
রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান পণ্য চালানে ৩৮ হাজার ৩১১ পিস তৈরি পোশাক রপ্তানির ঘোষণা দিয়ে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খোলে। তবে ৩৮ হাজার ৩১১ পিস পোশাকের বদলে তারা ৮৩ হাজার ৩৫১ পিস রপ্তানির চেষ্টা করেন। কায়িক পরীক্ষা শেষে ৮৩ হাজার ৩৫১ পিস তৈরি পোশাকের মূল্য দাঁড়ায় ৪০ লাখ ৮৮ হাজার ২৪১ টাকা। ফলে ২১ লাখ ৯৭ হাজার ৪৮৬ টাকা পাচারের চেষ্টা করা হয়েছে বলে জানান কাস্টমস কর্মকর্তারা।
এর আগে গত ১৯ জানুয়ারি ঢাকার উত্তরার আরএম সোর্সিং বাংলাদেশ নামের একটি রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান চারটি পোশাক রপ্তানির চালানের আড়ালে ৬ কোটি ৬২ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮৮ টাকা অর্থপাচারের চেষ্টা করেছে বলে জানান চট্টগ্রাম কাস্টমসের অডিট ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড রিসার্চ (এআইআর) শাখার কর্মকর্তারা। ফিলিপাইনে চালানগুলো রপ্তানির জন্য একটি বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোতে কন্টেইনারে লোড করা হয়।
এ সব চালানে দায়িত্বপ্রাপ্ত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ছিল নগরীর সদরঘাটের বেঙ্গল প্রগ্রেসিভ এন্টারপ্রাইজ। আরএম সোর্সিং চারটি বিল অব এক্সপোর্টের বিপরীতে আইএফআইসি ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি করে। রপ্তানিকারকের ঘোষিত ২৪ হাজার ৩৪৪ পিসের (প্রতি চালানে ৬ হাজার ৮৬ পিস) বিপরীতে মোট ২৯ হাজার ৯৪৪ ইউরো (প্রতি পিসের ঘোষিত মূল্য ১ দশমিক ২৩ ইউরো) বা ২৯ লাখ ৬০ হাজার ২৪৮ টাকা পাওয়া যেত। তবে সঠিক ঘোষণা থাকলে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬ কোটি ৯২ লাখ ২৭ হাজার ৯৫২ টাকা পাওয়া যেত। অর্থাৎ রপ্তানিকারক এ চারটি চালানে ৬ কোটি ৬২ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮৮ টাকা পাচারের চেষ্টা করেছে বলে জানায় চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
সূত্রমতে, গত ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে মানি লন্ডারিং ঠেকানোর লক্ষে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে এন্টি মানি লন্ডারিং শাখা খোলা হয়। শাখাটি গঠনের পর মানি লন্ডারিং আইনে কয়েকটি মামলাও করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। গত দুই বছর ধরে শাখাটির কার্যক্রম এক প্রকার স্থবির হয়ে পড়েছে। বর্তমানে এই শাখার কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এখানে কাজ করছেন।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার ফখরুল আলম বলেন, সম্প্রতি আটক হওয়া কয়েকটি রপ্তানি পণ্যের চালানে আমরা অসঙ্গতি পেয়েছি। এ সব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও চলমান রয়েছে। সরকারি রাজস্ব সুরক্ষায় চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তৎপর রয়েছে। কোনো ধরণের অনিয়ম দুর্নীতি প্রশ্রয় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আনন্দবাজার/শহক