উপমহাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতির পরিবর্তন উপনিবেশিক শাসনামল থেকে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ অবধি অনেকের চোখেই দৃশ্যমান। বিশেষ করে জীবদ্দশায় যারা সাতচল্লিশে ভারতভাগ আর একাত্তরে পাকিস্তান বিভাজনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তারা উপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর এ ভূ-খণ্ডের সমাজের পট পরিবর্তনের সঙ্গে রাজনীতির বদলে যাওয়ার যোগসূত্র খুঁজে পেতে পারেন। আর তার আলোকেই বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিবাচক ধারায় বদলে যাওয়ার অন্তনির্হিত কারণ অনুসন্ধান করা যায়। যার মাধ্যমে সুস্থ ও কল্যাণকর ধারার রাজনীতির প্রতি আজকের প্রজন্মকে আরো আগ্রহী করে তোলা যাবে। সুশাসন নিশ্চিত করে কল্যাণকর, উন্নত বিশ্বের ধারায় বাংলাদেশ বিনির্মাণে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও সম্ভব হবে।
একাত্তরে মহাকাব্যিক অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও প্রকৃতপক্ষে শোচনীয়ভাবেই আমাদের হারাতে হয়েছিল রাজনৈতিক শুদ্ধতা আর মৌলিকত্ব। ধর্মীয় সম্প্রীতি আর সহনশীলতাকে ছাপিয়ে রাজনীতিতে ভয়ঙ্করভাবে বিস্তার ঘটেছিল শোষণ প্রবণতা, হিংসা, লোভ। আর নব্যস্বাধীন বাংলায় যে লাল সূর্যের উদয় হয়েছিল পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনে রক্তপাতের রাজনীতির শুরুর মধ্য দিয়ে সেটাও ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছিল। বিগত সাড়ে চার দশকে রাজনীতি পালাবদলে মত-পথ-নীতি-আদর্শের নানা ঝড় এসে দফায় দফায় ধাক্কা দিয়ে গেছে আমাদের সমাজ আর রাষ্ট্রের শরীরে। যার চূড়ান্ত পরিণতির শিকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠী আর নতুন প্রজন্ম। তাতে অনিবার্যভাবে মূল্যবোধের বিপর্যয়ের পাশাপাশি এক ধরনের মূল্যবোধহীনতাও দেখা দিয়েছে সমাজে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তয়ায়ন আর নীতিবোধের অবক্ষয়ের কারণে যৌক্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে বার বারই পিছিয়ে পড়তে হয়েছে বাংলাদেশকে।
সামাজিক এই নেতিবাচক পরিবর্তনের মূল সুর কিন্তু উপনিবেশিক শাসনামল থেকে শুরু। দীর্ঘকালব্যাপী বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপ আর রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের কবলে উপমহাদেশের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জগতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রে পরনির্ভরতার প্রভাব যেমন স্পষ্ট, তেমনি সামাজিক জীবনেও পরাধীনতা আর চাপিয়ে দেয়া ভিন্ন সংস্কৃতির আগ্রাসন ছিল প্রবলমাত্রার। সে সময়ের কিংবদন্তী বিপ্লবীরা সমাজে বিদ্রোহ আর স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিন্নমাত্রার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও গোটা ভূ-খণ্ডের জনগোষ্ঠীর মানসপটে গেঁথে যাওয়া পরাধীনতার প্রভাব দূর হয়নি। দুশ বছরের উপনিবেশিক শাসনের অবসানে স্বাধীনতার প্রকৃত সুর তাই অধরাই থেকে যায়।
দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্রের বিশাল অংশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ভারতীয় উপমহাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার ওপর আরেকবার ধাক্কা আসে সাতচল্লিশে ভারতভাগের সময়। সামাজিক মানসপটে গেঁথে থাকা জাতিগত ধ্যান-ধারণা থেকে সে সময়েই বিকাশ ঘটে দ্বিজাতিতত্ত্বের। ভারত আর পকিস্তান নামে ভিন্ন দুটি সম্প্রদায়ের অনিবার্য আকাঙ্ক্ষা থেকেই বিভাজন ঘটে দুই দেশের। তবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নৃশংসতা নাড়িয়ে দিয়ে যায় গোটা ভূ-খণ্ডকে। ‘মানুষের চেয়েও ধর্ম বড়, মানবিকতার চেয়েও ধর্মরক্ষা পবিত্র’ এমন দৃষ্টিভঙ্গির ভয়ঙ্কর বিকাশ ঘটতে দেখা যায়। সাতচল্লিতে সহস্রাধিক মাইল দূরের দু’ভূ-খণ্ড মিলে তৈরি হয় জাতি ও সম্প্রদায়গত স্বাধীন দেশ। যা ভাবনাতেও ছিল অস্বস্তিকর। যে অস্বস্তির বহিঃপ্রকাশ বায়ান্নতে ঘটে যায়।
স্বাধীকারের মোড়কে স্বাধীনতার প্রবল আকাঙ্ক্ষা থেকে প্রথমে ভাষার জন্য শুরু হয় আন্দোলন। নিজের ভাষাকেই নিজের করে পাওয়ার জন্য বলি দিতে হয় কিছু প্রাণ। সেই বায়ান্ন থেকে একাত্তর- দীর্ঘ পথ চলায় সামাজিক জীবন ও গণমানসে অভূতপূর্ব এক চেতনা তৈরি হয়। যা অতীতের চেয়েও প্রবলমাত্রার। দ্বিজাতিতত্ত্বের বিপরীতে এক নবচেতনা। নিজের ঘরেই নিজের জন্য যুদ্ধ। যেখানে ধর্মের বন্ধন তার ঔজ্জ্বল্য হারাতে থাকে। এরপর সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর অবধি পুরোটা জুড়ে সমাজ তথা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মানসপটে যে পরিবর্তন ঘটে গেছে তা উপলব্ধি করার মধ্যেই ইতিহাসের মূল সুরের সন্ধান পাওয়া যায়।
মূলত, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এ ভূ-খণ্ডের দৃষ্টিতে ছিল স্বাধীকারের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলন। আর পশ্চিম পকিস্তানের কাছে সেটা ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন মাত্র। কখনও কখনও বাঙালি জাতীয়তাবাদ তথা ভারতপন্থিদের আন্দোলন হিসেবেও তারা দেখেছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মধ্যে ভাষার মিলকেই তারা খুঁজে পেয়েছে আমাদের মূখ্য চেতনা হিসেবে। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের স্বাধীকার কিংবা স্বাধীনতার চেতনাকে কোনোভাবেই তারা স্বীকৃতি দেয়নি। মানতেও চায়নি কিছুতেই। নেতিবাচক এই মনোভাব ও জাগতিক স্বার্থের মোহ বিভেদ রেখা এঁকে দেয় স্বধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে। তাতে শুধু ধর্মীয় জাতিবোধের পরাজয়ই ঘটে না, তীব্র প্রতিহিংসারও জন্ম নেয়।
সত্য বলতে কি, বায়ান্ন থেকেই টানাপোড়েন শুরু হয় পৃথক ভূ-খণ্ডে বসবাস করা স্বধর্মীয় অনুসারিদের। এক ভূ-খণ্ডের বাসিন্দারা ভাতৃত্ববোধের দায়বদ্ধতা উপেক্ষা করে শোষণের শৃঙ্খলে বেঁধে রাখতে চায়। আর ভুক্তভুগি দেশ স্বজাতীয় প্রতিহিংসার শিকার হয়ে আত্মমর্যাদা আর স্বাধীকারের লড়াইয়ে প্রাণপাত করতে থাকে। মর্মান্তিক এই শাসন- শোষণ ছিল রাজনৈতিক বিভ্রান্তি-সভ্যতায় বাজে এক দৃষ্টান্ত। তৎকালীন তরুণ প্রজন্মের কাছে সমধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে নোংরা এই রাজনীতি তথা ষড়যন্ত্র ঘৃণার এক বার্তা দিয়েছিল। সেই বাজে দৃষ্টান্ত থেকেই অনেকের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছিল, ‘ধর্ম মানুষের অধিকারের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে না; যতক্ষণ না মানুষ নিজে সেটা রক্ষা করে।’ বায়ান্নতে সামান্য হলেও একাত্তরে নবীন-প্রবীণসহ সর্বস্তরের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভয়ঙ্কর এ দৃষ্টিভঙ্গি পাকাপোক্ত হয়ে যায়। আর একাত্তরে বিশ্বইতিহাসে ভয়ঙ্কর নৃশংসতম গণহত্যার পর সেই দৃষ্টিভঙ্গির যেন বিস্ফোরণ ঘটে।
মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের নৃশংসতা তাবৎ মানবতাকে হারিয়ে দিয়েছে। হারিয়ে দিয়েছে ধর্মীয় বিবেচনাবোধকে। ভাবতে অবাক লাগে, সহস্রাধিক মাইল দূরে থেকেও শুধু ধর্মের ভিত্তিতে যে দেশটি অপর দেশকে এক সূতোয় গেঁথে নিয়ে সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, সেই দেশটিই শুধুই জাগতিক স্বার্থে অপর দেশটিতে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা চালিয়েছিল। নিজ সম্প্রদায়ের নারীদের পৈশাচিক হত্যা-ধর্ষণে মেতে উঠেছিল। ইতিহাসে এ ঘটনা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর চরম এক আঘাত।
দৃষ্টিটাকে আরেকটু প্রসারিত করলে আমরা দেখতে পাই, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় শিকার কিন্তু নারীরা। মুসলিম বিশ্বের খ্যাতিমান চিন্তাবিদ হিসেবে পরিচিত সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর হাত ধরে পাকিস্তানে গড়ে ওঠা জামায়াতে ইসলামীর অনুসারীরা সুসংগঠিতভাবে মুক্তিযুদ্ধকালীন নারীদের ওপর যে নৃশংসতার ঘটনা ঘটিয়েছে তার প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা যায় আজকের শিক্ষিত ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির নারীসমাজে। এমনকি তারা ধর্মীয় অনুশাসনের মোড়কে নারীদের ব্র্যাকেটবন্দী করার মধ্যেও নৃশংসতার ছায়া দেখে আঁতকে ওঠেন। কেননা, মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের প্রতি সমাজে ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়ানোর পেছনেও কাজ করেছিলো স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি।
এখনও বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা বলতে তারাই দ্বিধা করেন যারা ধর্মীয়মতবাদে বিশ্বাসী। বিপরীতে বীরাঙ্গনাদের পরম মমতায় কাছে টেনে নিয়ে মা আর মেয়ে হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বীরাঙ্গনা মায়েরা পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় স্থান। শুধু কি তাই, যারা পাকিস্তানিদের হয়ে একাত্তরে হত্যা-ধর্ষণে জড়িত ছিল নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তাদের বিচারের কাঠগড়ায় এনে বিচার করেছে স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ। এসব ঘটনা আর ঘটনার পরম্পরা পাকিস্তান আর পাকিস্তানপন্থি রাজনীতি আর ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর বড় আঘাত হয়ে এসেছে। আর তারই প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে।
পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর বহুদিন ধরে এ দেশের রাজনীতিতে পাকিস্তানপন্থি উগ্র ধর্মীয়বাদীদের প্রভাব ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা গেছে। তবে সমাজের যৌক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের পথ রোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূল ধ্যান-ধারণায় পরিবর্তন, দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদের পাশাপাশি জঙ্গিবাদের প্রসারের কারণে রাজনৈতিক সে চরিত্রের বদল ঘটতে থাকে। তীব্র, তুমুল প্রতিরোধের মুখে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বদলে যেতে থাকে। বিশেষত যৌক্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের মাধ্যমে সুশাসন আর জনমুখী সমাজ সংস্কারের অগ্রযাত্রাকে প্রমোট করে- এমন ধারার রাজনৈতিক দলই দৃষ্টি কাড়তে থাকে নতুন ও তরুণ প্রজন্মের।
সমাজবিদদের দৃষ্টিতে এ ভূ-খণ্ডের জনগোষ্ঠী ধর্মীয় মূল্যবোধকে ধারন করে শান্তি আর সম্প্রীতির জন্য। তারা ধর্মভিরু সত্য, কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। এ বাস্তবতার কারণেই একাত্তরের পর থেকে এ সমাজে রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির বদল ঘটতে থাকে। ধর্মীয় অনুভূতি থেকে রাজনীতিকে আলাদা করে ফেলার সহজাত প্রবণতা দেখা যায়। বহুজাতিক এ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে উদার দৃষ্টিভঙ্গির জনপ্রিয়তা তরুণ প্রজন্মের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য বলেই মনে হয়। নারী শিক্ষার প্রসার, ক্ষমতায়ন আর সমতার ক্ষেত্রে ইতিবাচক অগ্রগতি আরো কিছু মূল্যবোধকে সামনে এনেছে। সামাজিক এসব অগ্রগতি আর মূল্যবোধের ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই রাজনীতির ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। যেখানে উগ্রবাদী রাজনৈতিক শক্তির প্রতি সার্বজনীন বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছে। এমনকি সমাজের সর্বস্তরে ধর্মীয় উপাদানগুলোকে রাজনীতির মোড়কে চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নিয়েও সচেতনতা তৈরি হয়েছে। ধর্মীয় তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড নিয়েও আলোচনা সমালোচনা তৈরি হচ্ছে। বাস্তবতার নিরিখে মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির পথ প্রসারিত হচ্ছে। আজকের প্রজন্ম নিশ্চিতভাবেই এসব ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করতে আগ্রহী। দ্বিজাতিতত্ত্বের পাশাপাশি উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ইতিহাসও নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছে তারা।
(চলবে)