ঢাকা | সোমবার
৩০শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৫ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাড়ছে বিনিয়োগভিত্তিক ব্যাংকিং

বাড়ছে বিনিয়োগভিত্তিক ব্যাংকিং

বিশ্বজুড়ে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সুদ-মুক্ত ঋণ সুবিধা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে বিনিয়োগভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। যেখানে ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ না দিয়ে সরাসরি গ্রহীতাকে বিনিয়োগ প্রদান করা হয়। যার অংশিদার হয়ে ওঠে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান। বিগত চার দশক ধরে বিশ্বব্যাপী সুদ-মুক্ত ব্যাংকিং সেবার দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটছে। যা আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে দ্রুততম বর্ধনশীল ব্যাংকিং সেবা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই পদ্ধতি কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনসংখ্যার দেশগুলিতেই নয়, অন্যান্য দেশেও বাড়ছে।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানসহ বহু দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই ধারার ব্যাংক সেবা। এই ধারার ব্যাংকিং সেবায় ঋণখেলাপি কমে আসায় অন্যান্য দেশের মতো পশ্চিমা বিশ্বেও বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে সুদ-মুক্ত ব্যাংকখাতের। পশ্চিম এশিয়ার কিছু দেশ, ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি ব্যাংকে খোলা হয়েছে সুদ-মুক্ত উইন্ডো। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রচলিত ব্যাংকার এবং নীতি নির্ধারকদের দিয়ে সুদ-মুক্ত অর্থের ধারণাকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়ার আগে এখনও দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে।

সূত্রমতে, শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকিংয়ে লাভ-লোকসান বণ্টন এবং সুদ লেনদেন পুরোপুরি নিষিদ্ধ। সেক্ষেত্রে বিনিয়োগভিত্তিক ব্যাংকিং সেবায় কোনো প্রকার ঋণ প্রদান করা হয় না। বিপরীতে গ্রহীতার যেকোনো ব্যবসায় সরাসরি বিনিয়োগ করা হয়। যেখানে গ্রহীতার মূল ব্যবসায় সরাসরি অংশীদার হয় বিনিয়োগকারীরা। একই সঙ্গে পুরো ব্যবসায় ব্যাংক সরাসরি তদারকি ও কর্তৃত্বও প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

এসব কারণে কল্যাণমূলক প্রণোদনা দেয়ার পাশাপাশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা গ্রাহক পর্যায়ে হস্তক্ষেপ-সক্ষমতায় গ্রাহকের আস্থা বেড়ে চলেছে। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো যুক্ত হচ্ছে বিনিয়োগভিত্তিক ব্যাংকিংয়ে। কোনো কোনো ব্যাংক পূর্ণাঙ্গ, আবার কোনো কোনো ব্যাংক উইন্ডো খুলে সেবা দিচ্ছে। আমানত ও বিনিয়োগে প্রচলিত ব্যাংকের তুলনায় বেশি সাফল্য, রেমিট্যান্স আহরণ, ঋণ-আমানত ও সম্পদের বড় সূচকগুলোতে শক্ত অবস্থানে রয়েছে এসব ব্যাংক। যে কারণে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে সুদ-মুক্তধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সাধারণ গ্রাহকরা সবচেয়ে বেশি আমানত রেখেছেন বিনিয়োগভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থায় অনুসারি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডে। শুধু তাই নয়, করোনার মধ্যে অন্যান্য ব্যাংক যখন অর্থ সংকটে ভুগছিলো তখন এই ধারার ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এমনকি আমানতের হিসেবে শীর্ষ পাঁচটি ব্যাংকের মধ্যে তিনটিই বিনিয়োগভিত্তিক ধারার ব্যাংক। বেসরকারি খাতের তৃতীয় ও চতুর্থ সর্বোচ্চ আমানত রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক।

সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে শেষে বিনিয়োগভিত্তিক ব্যাংকগুলোর আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৯৩ হাজার ১১১ কোটি টাকা। যা পুরো ব্যাংকখাতের ২৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে আমানতের পরিমাণ ছিলো তিন লাখ ২৬ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে আমানত বেড়েছে ৬৬ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। একইভাবে বেড়েছে ঋণের পরিমাণও। প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে ঋণের পরিমাণ ছিলো দুই লাখ ৯৪ হাজার ৯৪ কোটি টাকা।

২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় তিন লাখ ৫৩ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক বছরে ঋণ বেড়েছে ৫৯ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা। যা পুরো ব্যাংকিং খাতের ২৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। গত বছর এসব ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ২০ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। যা রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের ৪৯ দশমিক ১৮ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংকিং ও উইন্ডো রয়েছে দুই হাজার ৮০টি। এর মধ্যে এক হাজার ৬৭১টি উইন্ডোই পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকগুলোর। এসব ব্যাংকে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। ২০২০ সালের ৩৮ হাজার ৭৮৪ জন। ২০২১ সালের প্রতিবেদন বলছে, ছয় হাজার ৪৭৬ জন থেকে বেড়ে বর্তমানে কর্মরত আছেন ৪৫ হাজার ২৬০ জন।

ব্যাংকখাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে ৩৮ বছর ধরে বিনিয়োগভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালিত হলেও এ সংক্রান্ত কোনো আইন নেই। যে কারণে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব শরিয়াহ বোর্ডের সিদ্ধান্তেই চলছে কার্যক্রম। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব শরিয়াহ বোর্ড গঠন এবং আইন প্রণয়ন করতে পারলে আরও বেশি সাফল্য বয়ে আনবে ইসলামী ব্যাংকগুলো। ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৯০ টাকা পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করতে পারে।

তবে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো ৮৫ টাকা পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করতে পারে। যেখানে সাড়ে ৫ শতাংশ নগদ জমা রেশিও (সিআরআর) সংরক্ষণের বিপরীতে প্রচলিত ধারার ব্যাংককে ১৩ শতাংশ সংবিধিবদ্ধ তারল্য রেশিও (এসএলআর) রাখতে হয়, সেখানে ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য তা সাড়ে ৫ শতাংশ।

ইসলামী ব্যাংকগুলো যে কোনো সময় আমানতে মুনাফার হার পরিবর্তন করতে পারে। প্রচলিত ধারার ব্যাংক মেয়াদপূর্তির আগে তা পারে না। এসব কারণে প্রচলিত ধারার ব্যাংকের তুলনায় ইসলামী ব্যাংকে মুনাফা বেশি। ফলে অনেক ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিংয়ে রূপান্তরে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে ৯৫ শতাংশ মানুষ মুসলিম। ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ হারাম এবং ব্যবসা হালাল। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকে আমানত বেশি এবং আস্থা ও বিশ্বাসের কারণে উদ্যেক্তারা ইসলামী ব্যাংকিংয়ের দিকে ঝুঁকছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক তাসনিমা খান বলেন, ইসলামের ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে এটা একটা শেয়ারিং মেথড হবে। ‘প্রফিট-লস-শেয়ারিং’ অর্থাৎ ব্যাংক যেহেতু আমার কাছ থেকে আমানত রাখছে, ব্যাংকের যদি লাভ হয় তাহলে আমানতের ওপর আমি লভ্যাংশ পেতে পারি। ব্যাংকের যদি ক্ষতি হয় তাহলে আমি লভ্যাংশ পাওয়ার জন্য যোগ্য হব না। এটাই প্রচলিত এবং ইসলামী ধারা ব্যাংকের মধ্যে মূল পার্থক্য। আর এতেই আস্থা তৈরি করেছে গ্রাহকদের মাঝে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সাধারণ মানুষের ধারণা, ইসলামী ব্যাংকগুলোতে প্রচলিত ব্যাংকের মতো দুর্নীতি হয় না। লেনদেনে সুযোগ-সুবিধা বেশি। সাধারণত অনেকে সুদ দেয়া- নেয়ায় আগ্রহী নন। সব মিলিয়ে ইসলামী ব্যাংকিংয়ে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তারা।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের এক কর্মকর্তা জানান, ইসলামী ব্যাংকে আমানত হারানোর ভয় নেই। এখানে অনিয়ম-দুর্নীতি কম হয়। এ ছাড়া ব্যাংকটি শতভাগ সুদমুক্ত। প্রচলিত ব্যাংকগুলোর নির্ধারিত সুদহারের চেয়ে কম মুনাফা হলেও মেয়াদ শেষে গ্রাহকদের অন্য যেকোনও ব্যাংকের চেয়ে বেশি মুনাফা দেয়। এ কারণে ব্যাংকটিতে আমানতকারী বেড়েছে। এখন ব্যাংকটিতে এক কোটি ৬৬ লাখেরও বেশি আমানতকারী রয়েছেন।

ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুল মওলা বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলো আমানত ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চুক্তি অনুসারে লাভ- লোকসানের ঝুঁকি বহন করে। মুদারাবা ভিত্তিতে তহবিল আহরিত তহবিল বিনিয়োগ করে যে আয় হয় কমপক্ষে তার ৬৫ শতাংশ বিতরণ করে আমানতকারীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।

মনিরুল মওলা বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলো টেকসই উন্নয়নকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। অগ্রাধিকার খাতে বিনিয়োগের পাশাপাশি ক্ষুদ্র অর্থায়ণে গুরুত্ব দিচ্ছে। যে কারণে এসব ব্যাংক দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। তবে ইসলামী ব্যাংকগুলোর পৃথক আইন ও নীতিমালা জরুরি। এতে করে আইন থাকায় যেসব প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয় তা সমাধান হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটির সদস্য আবুল কাশেম মো. ছফিউল্লাহ আরিফ বলেন, স্বাভাবিকভাবে মানুষ সুদের সঙ্গে যুক্ত হতে চান না। ইসলাম ধর্মে সুদ নিষিদ্ধ থাকায় মানুষ সুদের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত হন। ইসলামী ব্যাংকগুলোর সাফল্য দেখে এর প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। এ আগ্রহ শুধু মুসলিমপ্রধান দেশে হচ্ছে তা নয়, অমুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রেও ইসলামি ব্যাংক গ্রহণযোগ্য হচ্ছে। ব্যবসায়িক মুনাফা নয়, সমাজ উন্নয়ন ও মানবতার সেবাই ইসলামি ব্যাংকিংয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য। বাংলাদেশে বিনিয়োগভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকিং অনেক বেশি সম্ভাবনাময়।

বিশ্বে প্রথম ইসলামী ধারার ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু হয় ১৯৬৩ সালে। আর বাংলাদেশে শুরু হয় ১৯৮৩ সালে। দেশে সর্বপ্রথম ব্যাংক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল)। বর্তমানে দেশে ইসলামী ধারার ব্যাংকের সংখ্যা ১০টিতে উন্নীত হয়েছে।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ছাড়া বাকি ৯ ব্যাংক হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল), শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল) ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। এর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড ও গ্লোবাল ইসলামী গত ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইসলামী ধারায় রূপান্তরিত হয়েছে। আর ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক, যাদের যাত্রা শুরু হয়েছে ২০১৩ সালে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন