ঢাকা | রবিবার
২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফিরতে হবে চাষাবাদে

ফিরতে হবে চাষাবাদে

এক লিটার সয়াবিন তেলের জন্য শতজনের হাত উঠছে। শুধু হাত ওঠাতেই থেমে থাকছে না, রীতিমতো পাড়াপাড়ি-হুড়িহড়ি। এতোসব লড়াইয়ের পর যে লোকটি তেলের বোতল হাতে পেয়েছেন তাকে দেখে মনে হয় যেন হিমালয় জয় করে ফেলেছেন। অনেকটা ঈদের আগে রেলের টিকিট পাওয়ার মতো ব্যাপারটা। কোথাও কোথায় আবার ভিন্ন চিত্র। শত শত হাতের মধ্যে কাকে রেখে কাকে তেল দেয়া হবে, সেই ভাবনা ভাবতে গিয়ে কাউকেই তেল না দিয়ে ট্রাক নিয়ে ভোঁদৌড়। ভোজ্যতেলের জন্য এমন হাহাকারের চিত্র এখন হরহামেশা।

অন্যদিকে যার সামর্থ নেই পাঁচ, দুই কিংবা নিতান্ত এক লিটার তেল কেনার, তিনি হয়তো খেলাবাজারে ছুটছেন। আধা লিটার কিংকা সিকি লিটার তেল কিনতে। তবে সেখানেও তার ভাগ্য আটকে যাচ্ছে নিয়মের বেড়াজালে। ব্যবসায়ীরা সুর তুলেছেন, খোলাবাজারে তেল বিক্রি করতে হলে নিতে হবে সরকারের অনুমতি। ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের ধারণা, তেলের দাম বৃদ্ধির জন্য খোলা তেল ব্যবসায়ীরা দায়ি।

কদিন আগে মিষ্টি নামে এক নারীর সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। সয়াবিন তেলের জন্য তিনি টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) ন্যায্যমূল্যের ট্রাকের খোঁজ করছিলেন। চোখেমুখে তার একরাশ চিন্তা আর দৈন্যতা। ছেলে-মেয়ে নিয়ে তার তিনজনের সংসার। স্বামী নিরুদ্দেশ। ঝিয়ের কাজ করে পরিবার চালান। কম পয়সার চলতে হয় বলে সয়াবিন ছাড়াও চাল, ডাল, পেঁয়াজও টিসিবি থেকেই কেনেন। তবে সমস্যা হয়েছে দিন পনের হলো। তিনি টিসিবির ট্রাকের সন্ধান পাচ্ছেন না। ট্রাক কখন আসে সেই হিসাব মেলাতে পারছিলেন না। তেল ছাড়াই প্রায় চলছে তার সংসার।

এতো গেল শহুরে মিষ্টিদের কথা। গ্রামের মিষ্টিদের সংসার কীভাবে চলছে? সেদিক নিয়ে ভাবতে গেলেই অতীত এসে সামনে দাঁড়ায়। আবহমানকাল ধরেই বাংলার ঘরে ঘরে সরিষা, তিল, তিসি, গর্জন, বাজনা জাতীয় তেলের চাষ হতো। গত শতকের আশির দশক থেকে দেশে সয়াবিন, সূর্যমুখী তেল আসতে শুরু হলো। যেসব তেল এতটাই প্রভাব বিস্তার করলো যে সরিষা যেন আর পেরে উঠছে না। তিল, তিসিও বইয়ের পাতায় স্মৃতি হয়ে গেল। গ্রামের মিষ্টিরাও এখন সয়াবিন তেলের পেছনে দৌড়ায়।

ময়মনসিংহ অঞ্চলের সত্তরোর্ধ আব্দুস সালাম ছোট বয়স থেকেই কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। একমাত্র ছেলে হওয়ায় বাবার পেশা কৃষিকাজেই সময় দিতেন। উচ্চমাধ্যমিক শেষে সংসারের হাল ধরেন। আব্দুস সালাম দৈনিক আনন্দবাজারকে জানান, এক সময় সরিষা, তিল ও ঋষি চাষ করতেন। আর বাজনা তেল পেতেন গাছ থেকে। এখন আর এসব চাষ করেন না। সংসারের প্রয়োজনীয় সব তেলই কিনে আনেন বাজার থেকে। বলা যায়, তেলে স্বনির্ভর গ্রাম এখন পরনির্ভর হয়ে পড়েছে।

টাঙ্গাইলের পঞ্চাশোর্ধ আবুল হোসেনের অভিজ্ঞাও একই রকম। তিনি দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, জন্মের পর থেকেই সরিষার তেল খেয়ে আসছি। আমাদের অঞ্চলে সরিষার প্রচুর আবাদও হতো। তবে এক পর্যায়ে ঘরের তেলের জায়গা দখল করে নিয়েছে বাজারের সয়াবিনের তেল। সরিষা চাষ কমে গেছে। অনেকে যেটুকু চাষ করেন তাও বিক্রি করে দেন। কেরোসিন তেলের মতোই এখন খাবার তেলও কিনতে হয়।

বাংলাদেশ আমদানি-রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ২০ লাখ টনে পৌঁছেছে। তার মধ্যে শুধু রমজান মাসেই দুই লাখ টন তেল প্রয়োজন। যার ৭০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ সরকারি বিভিন্ন হিসেবে, বাংলাদেশে ভোজ্য তেল উৎপাদন হয় সাড়ে তিন লাখ টনের মতো। বাকি প্রায় সাড়ে ১৬ বা ১৭ লাখ টন তেল করতে হয় আমাদানি।

আগে তো শুধু রান্নাবান্নায় তেল ব্যবহার হতো। এখন বেড়েছে এর বহুমুখী ব্যবহার। সরকারের একটি গবেষণায় দেখা যায়, গত চার বছরের ব্যবধানে দেশে জনপ্রতি তেল ব্যবহারের বা খাবার তেলের ভোগ প্রায় পাঁচ কেজি করে বেড়েছে। অর্থাৎ প্রতিনিয়তই ভোজ্য তেলের চাহিদা বাড়ছে। আর এই তেলের মধ্যে বেশি দরকার হয় সয়াবিন তেল। কারণ রান্নার কাজে এই তেল দেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের গবেষণায় জানা যায়, ২০১৫ সালে মাথাপিছু খাবার তেল ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ১৩ দশমিক ৮০ কেজি আর ২০১৯ সালে তা ৩৬ শতাংশ বেড়ে জনপ্রতি ১৮ দশমিক ৭ কেজিতে দাঁড়ায়। মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) ফরেন এগ্রিকালচারাল সার্ভিসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ সয়াবিন তেল আমদানিকারক দেশ। এখানে সয়াবিন তেলের বড় অংশই আমদানি করা হয়।

একজন মানুষের প্রতিদিন কী পরিমাণ তেল খাওয়া প্রয়োজন সে ব্যাপারে পুষ্টিবিদ চৌধুরী তাসনীম হাসিন জানান, ১-৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য দৈনিক ৩-৪ চা চামচ, ৬ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের জন্য ৭-৮ চা চামচ আর ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত একজন মানুষের দৈনিক ৬-৮ চা চামচ তেল প্রয়োজন। এরপর ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে যাদের বয়স, তাদের ক্ষেত্রে তেল গ্রহণের পরিমাণ তার ওজন অনুযায়ী কিছুটা কমিয়ে আনতে হবে। কারণ দৈনিক চাহিদার তুলনায় বেশি তেল খেলে স্বাস্থ্য-ঝুঁকি থাকে।

ব্রিটেনের ডি মন্টফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের লেস্টার স্কুল অফ ফার্মাসি এক গবেষণায় দেখিয়েছে যে, উচ্চ তাপমাত্রায় (১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি) রান্না করলে তেলচর্বিতে থাকা অণুর গঠন বদলে যায়। বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে বা অক্সিডেশন হয়। সেখান থেকে উৎপন্ন হয় অ্যালডিহাইডস এবং লিপিড পার অক্সাইড। আর অ্যালডিহাইডস নিঃশ্বাস বা খাবারের সঙ্গে অল্প পরিমাণে গ্রহণ করলেও সেটা হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। সূর্যমুখী তেল ও ভুট্টার তেলে উচ্চতাপে রান্না করলে অনেক বেশি হারে অ্যালডিহাইডস উৎপন্ন হয়।

এসব তো গেলো পুষ্টিবিদ ও গবেষকদের কথা। সাধারণ মানুষ তো এতো কিছু বোঝে না। তাদের প্রয়োজন রান্নাবান্নায় তেল। তেল ছাড়া জীবন যে থমকে যায় তাদের। অবশ্য এসব সমস্যা সমাধানে সরকার আমদানি পর্যায়ে ১৫ ও ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ কর তুলে নিয়েছে যাতে তেলের বাজার স্থিতিশীল থাকে। সেটিও কাজে আসবে না বলে ব্যবসায়ীরা মতামত দিচ্ছেন। তাদের দাবি, এসব তেল বেশি দামে তারা আগে কিনেছেন। তাই বিক্রিও করতে হবে বেশি দামে। অর্থাৎ স্থিতিশীল তেলের বাজার পেতে আরো অপেক্ষা করতে হবে ভোক্তাকে।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন দেশের ভোজ্যতেল পরিশোধন শিল্প নিয়ে একটি সমীক্ষা করেছিল। ওই সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে তখন পরিশোধিত ভোজ্যতেলের চাহিদা ছিল বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন। মাথাপিছু দৈনিক ৪০ গ্রাম ধরে ২০২১ সালে তেলের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ ৯১ হাজার টনে দাঁড়াবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। বর্তমানে ২০২২ সাল চলছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছে মাথাপিছু চাহিদা হবে গড়ে ১৪ দশমিক ৬ কেজি।

ভোজ্যতেল পরিশোধনকারীদের তথ্যমতে, দেশের বোতলজাত সয়াবিন তেলের বাজারে এখন বড় ব্যবসায়ী তিনটি কোম্পানি- বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের রূপচাঁদা, সিটি গ্রুপের তীর ও ফ্রেশ ব্র্যান্ডের তেল বাজারজাত করছে মেঘনা গ্রুপ। বোতলজাত সয়াবিন তেলের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ বাজার দখল রেখেছে এ তিন কোম্পানি। এ ছাড়া টিকে গ্রুপের পুষ্টি, নুরজাহান গ্রুপের নুরজাহান, এস আলম গ্রুপের মোরগ, এসএ গ্রুপের মুসকান, ইলিয়াস ব্রাদার্সের দাদা, মোস্তফা ভেজিটেবল তেলের মোস্তফা ও রুবাইয়া ভেজিটেবল তেলের রুবাইয়া ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল আছে বাজারে।

বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকসের (বিবিএস) কৃষি বিভাগের পরিচালক আলাউদ্দিন আল আজাদ দৈনিক আনন্দবাজারকে জানান, ২০১৮-১৯ সালে দেশে প্রায় ১১ লাখ হেক্টর জমিতে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টনের বেশি শসামি তিল, রেপ ও মোসতার্ড, লিনসেড, সয়াবিন, নারকেল, সূর্যমুখী তেল উৎপাদন হয়েছে। এটি ২০১৭-১৮ সালে ছিল ১১ লাখ ২১ হাজার ৬১৭ হেক্টর জমিতে ১০ লাখ ২৫ হাজার ৮৯৩ টন, ২০১৬-১৭ সালে প্রায় ১২ লাখ হেক্টর জমিতে ৯ লাখ ৭৪ হাজার ৫৫২ টন।

আলাউদ্দিন আল আজাদ জানান, ২০১৫-১৬ সালে ১১ লাখ ২৫ হাজার ২৪৫ হেক্টর জমিতে ৯ লাখ ৩৪ হাজার ২৪৮ টন ও ২০১৪-১৫ সালে ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৯১৮ হেক্টর জমিতে ৯ লাখ এক হাজার ৪৭৭ টন শসামি তিল, রেপ ও মোসতার্ড, লিনসেড, সয়াবিন, নারকেল, সূর্যমুখী তেল উৎপাদন হয়েছে। এই বিভাগের উপ-পরিচালক আখতার হাসান খান বলেন, মসুর ডাল থেকে অন্য শস্য ও সবজিতেও তেলের উপস্থিতি আছে। এসব জায়গা থেকেও তেল বের করার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষণ দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, দেশের চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ তেলই আমদানি করতে হয়। এটির স্থায়ী সমাধানে আমরা কৃষি মন্ত্রণায়কে অনুরোধ করেছি চাষাবাদে গুরুত্ব দিতে। কিনে খাওয়ার কারণে অন্যদেশের প্রতি আমাদের নির্ভর করতে হয়। এটির স্থায়ী সমাধান না হলে আমরা বার বার বিপদে পড়বো।

এদিকে ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারের (ইউএসডিএ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ লাখ টন সয়াবিন তেল উৎপন্ন হয়েছে। সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১৭তম। আমদানিতে তৃতীয়। ২০০৩ সালে ১১ হাজার টন সয়াবিন তেল উৎপাদন হয়। টানা কয়েক বছর পণ্যটির উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ২০০৪ সালে সয়াবিন উৎপাদন ৬৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার টনে।

২০০৫ সালে ২১ হাজার টন সয়াবিন তেল উৎপাদন হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। ২০০৬ সালে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজার টনে। আর ২০০৭ সালে দেশে সয়াবিন তেল উৎপাদন কমে দাঁড়ায় ২৭ হাজার টনে। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে দেশে ২৪ হাজার ও ২০ হাজার টন সয়াবিন তেল উৎপাদন হয়েছে। ২০১০ সালে সয়াবিন তেলের উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার টনে। ২০১৩ সালে আগের বছরের তুলনায় ৩৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ বেড়ে ১ লাখ ১৭ হাজার টনে উন্নীত হয়।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন